মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইং

রাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণ করার আটদিনের মাথায় মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইং- এর বক্তব্যে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিজভূম রাখাইনে ফেরানোর কথা এলো। স্বল্প সময়ে সামরিক সরকার প্রধানের এমন বার্তা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে ঢাকা। তবে পূর্ব অভিজ্ঞতায় এখনই স্বস্তির শ্বাস নিতে পারছে না ঢাকা।

মিয়ানমারের সেনা প্রধানের এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা পোস্টকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় এমন ‘আশা’ ও ‘শঙ্কা’র কথা জানালেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, রোহিঙ্গা নিয়ে কাজ করা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা এটাকে স্বাগত জানাচ্ছি। এ ধরনের স্টেটমেন্ট ভালো। তবে বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণে রাখছি। মুখে তো অনেক কিছুই বলে, কিন্তু অনেক সময় কার্যকরী হয় না। তবে ভালো খবর হচ্ছে, আগে আর্মি সরকারে থাকা অবস্থায় দুই দুইবার অর্থাৎ ৭৮ এবং ৯২ সালে কিন্তু রোহিঙ্গা ফেরত নিয়েছে। আমরা আশাবাদী।’ 

গত ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চিসহ মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দল এনএলডির জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তার করে দেশটির সেনাবাহিনী। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটিতে আগামী এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করে সেনাবাহিনী। জোর করে ক্ষমতা দখল করার আটদিনের মাথায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইং।

সেই ভাষণে মিয়ানমারের রাখাইনের বাস্ত্যুচুত লোকজনকে বেসামরিক সরকারের আমলের চুক্তি অনুযায়ীই বাংলাদেশ থেকে ফেরত নেওয়ার কথা জানান সেনাপ্রধান। তবে ভাষণে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফেরানোর কথা এলে তাদের 'রোহিঙ্গা' বলে সম্বোধন করেনি সেনাপ্রধান।

রোহিঙ্গা নিয়ে কাজ করা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মিয়ানমারের সামরিক সরকার এত দ্রুত রোহিঙ্গাদের ফেরানো নিয়ে কথা বলবে সেটা প্রত্যাশিত ছিল না। যেহেতু সেনাপ্রধান এটা নিয়ে কথা বলেছে, বিষয়টা ইতিবাচক। তবে মিয়ানমারের পূর্ব অভিজ্ঞতাতো ভালো না। তারা এ নিয়ে কয়েকবার কথা দিলেও তা রাখেনি।’

আরেক কর্মকর্তার ভাষ্য, মিয়ানমারের ওপর আস্থা রাখা যায় না। তবে সেনাপ্রধান যেহেতু বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে, আমরা আশাবাদী। 

মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের রোহিঙ্গাদের ফেরানোর বক্তব্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরাও। এক্ষেত্রে তারা বক্তব্যের ফল পেতে আরও অপেক্ষা করার পাশাপাশ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দেশের গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাদের দেওয়া স্টেটমেন্ট বার বার প্রচার করা এবং বক্তব্য মনে করিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন।

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের প্রায় সাড়ে তিন বছরের মত সময়ে বেশ কয়েকবার প্রত্যাবাসন ইস্যুতে ঢাকার সঙ্গে নেইপিদোর চুক্তি, আশ্বাস এবং তৃতীয় পক্ষ হিসেবে বন্ধুরাষ্ট্র চীনকে সংশ্লিষ্ট করার পরও মিয়ানমারের নানা টালবাহানায় প্রক্রিয়াটি আজও শুরু করা যায়নি।

মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের ভাষণে রোহিঙ্গাদের ফেরানো নিয়ে বেসামরিক সরকারের আমলের চুক্তি অনুযায়ীই বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরানোর কথা জানান। মূলত করোনায় আকটা পড়া দেশটির নাগরিকদের দেশে ফেরানোর সঙ্গে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি সামনে আনেন সেনাপ্রধান মিন। 

শুধু তাই নয়, দেশটির অভ্যন্তরে থাকা বাস্ত্যুচুতদের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করবেন বলেও জানান সেনাপ্রধান মিন।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবে আপাতত দেখছি। তবে সেনাপ্রধান খুব কম সময়ে রোহিঙ্গাদের ফেরানোর কথা বলছেন, এটার কারণটা জানা দরকার; হতে পারে তারা তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার জন্য এখন এমনটা বলছে। আমাদের অপেক্ষা করতে, দেখা যাক কী হয়। কারণ এর আগেও তারা কথা দিয়েছে, কিন্তু সেটা আস্থা তৈরি করতে পারেনি।’

এদিকে, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার পর মিয়ানমারের সামরিক প্রশাসন রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বলে জানা যায়। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন ঢাকায় একটি অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের জানান, মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর নতুন কমান্ডাররা সেখানকার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়েছিলেন। তারা সেখানে রোহিঙ্গাদের মুরুব্বিদের সঙ্গে আলাপ করেছেন।

কক্সবাজারে আশ্রিত রো‌হিঙ্গা‌দের প্রত‌্যাবাস‌নের ক্ষেত্রে এটা ভালো খবর বলেও সেদিন মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান বলেন, ‘এটা অবশ্যই ইতিবাচক স্টেটমেন। আমাদের উচিত আশাবাদী হওয়া। আমাদের মূল কাজটা হবে যে কথাটা হ্লেইং বলেছে, আমরা আস্থা রাখার চেষ্টা করি। বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আছে তারা মিয়ানমারকে তাদের এ বক্তব্য বার বার স্মরণ করিয়ে দেবে, এতে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি হবে।’

এই আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতার জায়গাটা হচ্ছে, তাদের বক্তব্যকে আমরা প্রচার করি না। আমাদের কূটনীতি বা পররাষ্ট্রনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তাদের স্মরণ করিয়ে দেবে, তারা তাদের স্টেটসেন্টের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে। তারা যেন নিজেদের বক্তব্যবের প্রতি শ্রদ্ধা দেখায়।’

জানা যায়, সেনাবাহিনীর হাতে মিয়ানমার নেত্রী অং সান সু চির পতনের খবর পেয়ে কক্সবাজার শিবিরের রোহিঙ্গারা খুশি হয়ে উঠেন। তবে কিছু কিছু রোহিঙ্গা নেতাদের পক্ষ থেকে বিষয়টি প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক বলে দেশের গণমাধ্যমে খবর আসে। 

গত ১৯ জানুয়ারি চীনের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। সেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসার বিষয়ে দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়। কিন্তু এর আগেই দেশটির রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকটি করা সম্ভব হয়নি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য নেইপিদোর সঙ্গে বৈঠকের জন্য তাকিয়ে আছে ঢাকা। এক্ষেত্রে বেইজিংয়ের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা ছাড়াও তাদের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখছে ঢাকা। 

অভ্যুত্থানের দুইদিন পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীনের ওপর আস্থা রাখছে বাংলাদেশ সরকার। প্রত্যাবাসন নিয়ে চীন বেশ অগ্রসর হয়েছে বলেও জানান মোমেন। 

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি।

এনআই/এসএম