ভূক্তভোগী

>>চক্রটির টার্গেট অবসরপ্রাপ্তরা
>>৩০ মাসে দ্বিগুণের প্রলোভন
>>প্রতারিতদের অধিকাংশই অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য

২০১৪ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ল্যান্স করপোরাল পদে থেকে অবসরে যান কুষ্টিয়ার মো. আইয়ুব হোসাইন। পেনশনের টাকায় শুরু করেন ব্যবসা। কিন্তু সে ব্যবসায় হয় লোকসান। অংশীদারি ভিত্তিতে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় দ্বিগুণ লাভের প্রস্তাব পান তিনি। লাখে ৬ হাজার ৩০০ টাকা দেওয়ার প্রস্তাবে এসএস আবাসন নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ৪ লাখ টাকা লগ্নি করেন তিনি। গতকাল (২৩ ফেব্রুয়ারি) লাভের ২৫ হাজার দুইশ টাকা তুলতে গিয়ে জানতে পারেন প্রতারণার শিকার হয়েছেন তিনি।

বুধবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সিআইডি কার্যালয়ে প্রতারণার শিকার অবসরপ্রাপ্ত এ সেনাসদস্য কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ভেবেছিলাম প্রতিষ্ঠানটিতে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যরাও আছেন। এখানে প্রতারণার সুযোগ নেই। লাখে ৬ হাজার ৩০০ টাকা পাবার আশায় ৪ লাখ টাকা লগ্নি করেছি। এখন তো লাভ তো দূরের কথা, আসল টাকাও নেই। আমার তো ভাই সব শেষ।”

ভুক্তভোগী আইয়ুব হোসাইন বলেন, আমি আসলে এসেছিলাম চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য। ইন্টারভিউ আর দেওয়া হয়নি। উল্টো না বুঝেই প্রতারণার ফাঁদে পড়ি। আমাকে কিছু ডকুমেন্ট দেওয়া হয়। তারা এক লাখে ৬ হাজার ৩০০ টাকা দেওয়ার কথা বলে। এরমধ্যে তারা ৬ লাখ টাকার ফেরত হিসেবে ৩ হাজার ৩০০ টাকা কেটে নেবে।

সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার যাই এসএস আবাসনের নতুন অফিসে। সেখানে গিয়ে দেখি সিআইডি পুলিশ। অফিসের অন্যদের সঙ্গে আমাকেও আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে আমি সব বলি। সিআইডি জানায়, এরা সবাই প্রতারক। এখন আমি টাকা ফেরত পাবো কিনা জানি না। একটি টাকাও লাভ পাইনি। এখন আসল ফেরত পাবো কিনা তাও জানি না।

শুধু আইয়ুব আলী নয় এমন ছয় শতাধিক ভুক্তভোগীর তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। সিআইডি বলছে, একেকজনের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ১৩ লাখ পর্যন্ত টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেছে এসএস আবাসন নামে ওই প্রতিষ্ঠানটি।

রিয়েল এস্টেট ব্যবসার আড়ালে গ্রাহকদের ৩০ মাসে দ্বিগুণ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎকারী চক্রের ৯ সদস্যকে মঙ্গলবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। এঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে আজ ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা হয়েছে।

গ্রেপ্তাররা হলেন, আল আমিন (৩৮), মো. মামুন (৩৯), মো. মোজাম্মেল হোসেন (৫০), সাইফুল ইসলাম (৫১), আব্দুল হালিম (৪৮), জাহাঙ্গীর আলম (৪২), শাহাদাত হোসেন সুমন (৩৮) ও আমিনুল ইসলাম (২৪)। এসময় তাদের কাছ থেকে প্লট/ফ্ল্যাট বুকিং আবেদন ফরম ৫০টি, এসএস আবাসনের লেনদেন সংক্রান্ত রেজিস্টার ৭টি, এসএস আবাসনের অর্থ বিনিয়োগ চুক্তিপত্র ১০০ টাকা সমমানের নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ১২টি, আবেদন ফরম ৩৫টি, লেনদেন সংক্রান্ত খাতা ১৭টি, ডেবিট ভাউচার ২টি, মানি রিসিট ৬টি, এসএস আবাসনের কমিশন শিট ৬ পাতা এবং নগদ ১৪ লাখ টাকা জব্দ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির ৯জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও মূলহোতা ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. রাশেদুর রহমান পলাতক রয়েছেন।

সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেট্রোর অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, গ্রেপ্তাররা পরস্পর যোগসাজশে গত দেড় বছর ধরে আবাসিক এলাকায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসার নামে বিভিন্ন লোভনীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গ্রাহকদের অধিক মুনাফা দেয়ার প্রলোভন দিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে আসছে। ছয় শতাধিক ভুক্তভোগীর তথ্য আমরা পেয়েছি। তাতে প্রায় ৭ কোটির বেশি টাকা আত্মসাতের তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তে প্রতারিতের সংখ্যা ও আত্মসাৎকৃত টাকার সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। সিআইডি ঢাকা মেট্রো-পশ্চিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, টাকা লগ্নি করলে লাখ টাকায় ৬ হাজার ৩০০ টাকা লাভের প্রলোভন দেখিয়ে এই চক্রটি ৬ শতাধিক লোকের কাছ থেকে সাত কোটি টাকার ও বেশি টাকা আত্মসাৎ করেছে। গ্রাহকদের টাকা নিয়ে তারা ঠিকানা পরিবর্তন করে বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন অফিস খুলে গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ করে আসছে।

প্রতারণার কৌশল

ক্যান্টনমেন্টের পাশেই মাটিকাটায় এসএস আবাসনের অফিস। ফ্লাট কিনতে আগ্রহীরা আসলে ৩০ মাসে টাকা দ্বিগুণের লোভনীয় প্রস্তাব দেওয়া হয়। আবার বিনিয়োগকারী যোগাড় করতে পারলে ৬ শতাংশ কমিশনের প্রলোভন দেখানো হয়। এই ফাঁদে পা দেয়াদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যের সংখ্যাই বেশি। এমন প্রলোভনে তারা টাকা বিনিয়োগ করে। অনেকে লাভ বাবদ টাকাও পায়। তবে কিছুদিন পর তা বন্ধ হয়ে যায় এবং অফিস পরিবর্তন করে যোগাযোগও বন্ধ করে দেয়।

সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইনে বিজ্ঞাপন প্রচার

ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, প্রতারক চক্রটি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ও অনলাইনে লোভনীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করে। অনেকেই লোভে পড়ে বিনিয়োগ করেন। বিনিয়োগের আগে কেউ অভিযোগ করেননি। প্রতারণার শিকার হবার পর সিআইডিতে শতাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন।

প্রতারক চক্রের মূলহোতা নজরদারিতে

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতারক চক্রটির মূলহোতা রাশেদুর রহমান নজরদারিতেই রয়েছেন। তার পালানোর সুযোগ নেই। এ ঘটনার সঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা কিংবা কোনো সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তার জড়িত থাকার তথ্য আমরা পাইনি। পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জেইউ/আরএইচ