খিলখিল করে হাসত পাঁচ বছর বয়সের ইয়াসিন। খেলাধুলায় ছিল বেশ আগ্রহ। কিন্তু ইয়াসিনের হাসি থেমে যায় ২০২১ সালের মার্চে, ৯নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে লাগা ভয়াবহ আগুনে। বাবা আইনজি মোল্লা আগুনের ওই ঘটনার পর অন্যত্র বিয়ে করে ঘর ছাড়েন। মায়ের সঙ্গে পোড়া সেই ক্যাম্পেই এখনো বসবাস ইয়াসিনের, শুধু তার খিলখিল হাসিটা আর ফেরেনি।

মা জামালিদা বলেন, আগুনের সময় পানি আনতে গিয়েছিলাম। ঘরে একা ছিল ইয়াসিন। ধোঁয়া দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে আকস্মিক আগুনের কুণ্ডলীর মুখে পড়ে জ্ঞান হারায় সে। আগুন নিভলেও আর স্বাভাবিক হয়নি আমার ছেলে। ভয়াবহ আগুনে আতঙ্কিত ইয়াসিন ভয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই থেকে আগুন দেখলে, আগুনের কথা শুনলে চমকে ওঠে সে। আতঙ্ক ভর করে তার মধ্যে, কখনো কখনো ডুকরে কেঁদে ওঠে।

কুতুপালংয়ের ৯ নম্বর ক্যাম্প, আগুনে পুড়ে গিয়েছিল এর প্রায় ৭০ শতাংশ/ ছবি- ঢাকা পোস্ট
ঘরে একা ছিল ইয়াসিন। ধোঁয়া দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে আকস্মিক আগুনের কুণ্ডলীর মুখে পড়ে জ্ঞান হারায় সে। আগুন নিভলেও আর স্বাভাবিক হয়নি আমার ছেলে। ভয়াবহ আগুনে আতঙ্কিত ইয়াসিন ভয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই থেকে আগুন দেখলে, আগুনের কথা শুনলে চমকে ওঠে সে। আতঙ্ক ভর করে তার মধ্যে, কখনো কখনো ডুকরে কেঁদে ওঠে

শুধু ইয়াসিন নয়, গত দুই বছরে শতাধিক ছোট-বড় আগুনে ভয় আর আতঙ্কে দিন কাটছে উখিয়ার বালুখালি, কুতুপালং, লম্বাশিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কয়েক হাজার শিশুর। ইয়াসিনের আতঙ্ক ও মানসিক ট্রমা মনে করিয়ে দেয় আগুনের ভয়াবহতা।

২০২১ সালের ২২ মার্চ কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালির ৮ (ডব্লিউ) নম্বর ক্যাম্প থেকে ওই আগুনের সূত্রপাত হয়। যা ৮ (ই), ৯ ও ১০ নম্বর ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ে।

অন্তত পাঁচ ঘণ্টা স্থায়ী ওই আগুনে ১৫ জনের মৃত্যু হয় বলে দাবি জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কমিশন ইউএনএইচসিআর-এর। সংস্থাটির মতে, তাৎক্ষণিকভাবে চারশরও বেশি নিখোঁজ আর ৪৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা তাদের আশ্রয় হারান। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এমন বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি।

আরও পড়ুন >> তড়িঘড়ি করলে মিয়ানমারের ফাঁদে পড়বে বাংলাদেশ 

আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চিত্র/ ছবি : ইউনিসেফ

গত ১৬ ও ১৭ আগস্ট সরেজমিনে উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালি এলাকার অগ্নিদুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা পরিবার, শিশু ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগুনে ঘরহারা রোহিঙ্গা নাগরিকরা ইউএনএইচসিআর, সমাজসেবা অধিদপ্তর, ইউনিসেফ, ব্র্যাক, তুর্কির দাতা সংস্থার সহযোগিতায় পেয়েছেন নতুন ঘর। কারও কারও ঘর সংস্কার করে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত লার্নিং স্কুল ও হাসপাতাল মেরামত করা হয়েছে। কিন্তু অনেক রোহিঙ্গা শিশুর মাঝে রয়ে গেছে ভয়াবহ ওই অগ্নিদুর্ঘটনার দুঃসহ আতঙ্কের স্মৃতি।

গত দুই বছরে শতাধিক ছোট-বড় আগুনে ভয় আর আতঙ্কে দিন কাটছে উখিয়ার বালুখালি, কুতুপালং, লম্বাশিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কয়েক হাজার শিশুর। ইয়াসিনের আতঙ্কের আঁচ মনে করিয়ে দেয় আগুনের ভয়াবহতা। ২০২১ সালের ২২ মার্চ কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালির ৮ (ডব্লিউ) নম্বর ক্যাম্প থেকে ওই আগুনের সূত্রপাত। যা ৮ (ই), ৯ ও ১০ নম্বর ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ে

কথা হয় ক্যাম্প-সি-৯ এর ১৬ নম্বর ব্লকের চার সন্তানের জনক মো. ইউসুফের (৫০) সঙ্গে। ভয়াবহ সেই অগ্নিদুর্ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘আগুনের দৃশ্য ছিল খুবই ভয়াবহ, যার ব্যাপ্তি ছিল দৃষ্টিসীমার বাইরে। আগুন যেন লাফিয়ে লাফিয়ে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে ছড়িয়ে পড়ছিল। যদি দ্রুত পানির গাড়ি আসতো তাহলে আগুন দ্রুত নেভানো যেত।’

আরও পড়ুন >> মিয়ানমারে নিবন্ধন ও নাগরিকত্বের সমাধান চান রোহিঙ্গারা 

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর পুনর্নির্মাণ করা কক্সবাজারের একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প / ছবি- ঢাকা পোস্ট

‘আগুনের লেলিহান শিখা দেখে পরিবারের সদস্যরা কান্নাকাটি করতে শুরু করে। ঘর থেকে মূল্যবান কিছুই বের করতে পারিনি। হনেমতে (কোনো রকম) জীবন বাঁচাইছিলাম। ক্যাম্পের যে রেজিস্টার্ড আইডি কার্ড ছিল, সেটিও পুড়ে যায়।’ আগুন নিভলেও আতঙ্ক কাটে না সন্তানদের। তিনি বলেন, ‘এহনো গুমের (ঘুম) মধ্যে ১১ বছরের রাবেয়া, ১৬ বছরের ফাতেমা, ১৭ বছরের মো. তৈয়ব চমকি চমকি ওডে (ওঠে)। এহনো ওইন দেহিলে ডরায়, চমকি চমকি ওডে (এখনও আগুন দেখলে ভয় পায়, চমকে ওঠে )।’

উখিয়ার বালুখালি ক্যাম্প-সি-৯ এর ১৬ নম্বর ব্লকের নিজ ঘরের উঠানে দুই বছর বয়সী নাতনি সুমাইয়া বিবিকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন মুছানা বেগম। আগুনের ওই ঘটনায় নাতনি ও তার বাঁচার কথা ছিল না। কারণ, ক্যাম্পের চারদিকে যখন আগুন তখনও নাতনিকে নিয়ে ঘরেই অবস্থান করছিলেন মুছানা বেগম।

আরও পড়ুন >> রোহিঙ্গা সংকট: রাষ্ট্রহীন এই মানুষদের ভুলে গেছে সারা বিশ্ব? 

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি শিক্ষাকেন্দ্র/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

সেদিনের ভয়াবহ আগুনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে মুছানা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ওহন (আগুন) যহন সামনে আয়েইক্কা আয়ে, ডাটাগান (কাগজপত্র) লই সোনালী পাড়া গিয়েগই (চলে যাই)। ওবাজি ওহন দেহিলে এহনো আডু রথ ভাঙ্গি জাগৈ (এখনও আগুন দেখলে পা চলে না)। আতিক্কা ওইন দেক্কিদে ইতাল্লা এন্ডিলা (হঠাৎ আগুন দেখে আতঙ্কিত হয়েছিলাম)।

এখনও ঘুমের ঘোরে আঁতকে ওঠে শিশু মেসবাহ। নিজ দেশ মিয়ানমারের জান্তা সরকারের অমানবিক নির্যাতন আর বৈষম্য থেকে বাঁচতে শিশু মেসবাহসহ পাঁচ সন্তানকে নিয়ে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের পথে পা বাড়ান বাবা হাশিম মিস্ত্রি ও মা সায়েরা বেগম। অবশেষে আশ্রয় হয় বাংলাদেশে। ঠাঁই মেলে বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। নতুন করে স্বপ্ন বুনতে থাকে পরিবারটি। অথচ ২২ মার্চের আগুনে সেই স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হলেও সেই আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে শিশু মেসবাহ।

আরও পড়ুন >> আটকে আছে প্রত্যাবাসন, নবাগতরাও বাড়াচ্ছে উদ্বেগ 

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একাংশ/ ছবি: ইউনিসেফ

ঢাকা পোস্টকে সে বলে, ‘আর জীবনত প্রতম অত্তর ওইন দেক্কিদে। এহনো ডরে হইল্লা হাপে। গুমের মধ্যেও আত্তু এহনো ডর লাগে (জীবনে প্রথম এত বড় আগুন দেখি। ভয়ে এখনও কলিজা কাঁপে। এখনও ঘুমের মধ্যে ভয় লাগে)।’ মা সায়েরা বেগম জানান, তার পাঁচ সন্তান। মেসবাহ (১২), হুসনামা (৯), রিফা (৮), মোহাম্মদ (৬) ও আহমদ (৬)। ‘দিনত দোয়া বাজে, ওইন লাগে। নোয়াজ ফড়ি বাককাদ্দে এডে ওইন দরে। ফোয়াইন বেকগুন ফোন্নাত গিওন। এডে দেহি ওইন লাগে। ওহন আর চোখেমুখে কিছু ন দেহি। ফরে জীবন বাঁচাইবার লাই নিজেও গিগৈ। পোফাইনদর হোনো হবর ন ফাই (দুপুর ২টায় আগুন লাগে। মাত্র নামাজ পড়ে ভাত খেয়ে বসেছি। ঠিক তখনই আগুন লাগার খবর পাই। ছেলে-মেয়েরা তখন ছিল মাদ্রাসায়। দুই চোখে কিছুই দেখছিলাম না। শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন বাঁচাতে ক্যাম্প ছাড়ি। ছেলে-মেয়েদেরও কোনো খোঁজ ছিল না।’

২০২১ সালে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ৬৫টি এবং ২০২০ সালে ৮২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। যদিও রোহিঙ্গাদের হিসাবে এ সংখ্যা আরও বেশি৷ চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ছোট-বড় সাতটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে

বহু খোঁজাখুঁজির পর তিনদিনের মাথায় নিখোঁজ সন্তানদের ফিরে পাই। ওই দিনগুলো কী আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার মধ্যে কেটেছে, বলতে পারব না। শিশুদের আতঙ্ক আজও কাটেনি— বলেন মা সায়েরা বেগম।

পরিবারের জন্য পানি সংগ্রহ করছে রোহিঙ্গা শিশুরা/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

মিয়ানমারের বলিবাজার ক্যাংশন এলাকায় থাকতেন নুরুল হাই। ২০১৭ বাংলাদেশে আসেন পরিবারের সাত সদস্যকে নিয়ে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘ওইন লাগা শুরু ওয়ে দে জোরের ওগ্গে বাজে। আইওএম হাজত গেলাম। হাজরেনতু আসি ছাইদদে ওইন এডে আইগিও দৌড়ি দৌড়ি আইতে আইতে ওইন আর গরত আইগিও। ছাইদে ফোয়াইনচোয়াইন বেগগুন ঘরেনত দৌড়াদৌড়ি করে। শার্টের পকডত ডাটাখান রাক্কিলাম। তহন এন্নাও এড থাকি গিও। ও বাজি আর নাতি বেশি গুজারাগুজিরি গৈজ্জি। এতে আর নাতি এহনো ওইনের নাম ফুনিলে ডরা। আরে ওহনো ওইন দেহিলে আর নাতি আরে চুবি দরে। (দুপুর ১টার দিকে আগুন লাগে। তখন আমি আইওএম সংস্থার অধীন কাজে ছিলাম। সেখান থেকে দৌড়ে আসতে আসতে দেখি আগুন আমার ঘরের কাছে। ঘরে এসে দেখি ছেলে-মেয়েরা ছোটাছুটি করতেছে। শার্টের পকেটে আইডি কার্ডটা তখনও ছিল। আমার নাতি বেশি চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল। সে এখনও আগুন দেখলে ভয় পায়। আমাকে শক্ত করে জড়ায় ধরে।)

আরও পড়ুন >> ‘রেমিট্যান্সে’ বৈধ হচ্ছে ইয়াবা কারবারের অর্থ!

ক্যাম্পপ্রধান সুলতান মাঝি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগুন লাগার পর সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতায় ঘর ফিরে পাই। কিন্তু আগুনের যে ভয়াবহতা তা এখনও রয়ে গেছে, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।

উখিয়ার কুতুপালংয়ের এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পটি পুরোটাই পুড়ে গিয়েছিল আগুনে/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বারবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। ফলে প্রাণহানি যেমন বাড়ছে, নিঃস্ব হচ্ছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা পরিবারগুলো৷ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে শিশুরা। বই-খাতা, স্কুল, পোশাকসহ বাসস্থান যেমন পুড়ছে, তেমনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে তারা।

আরও পড়ুন >> এমপিটি সিমে যোগাযোগ, বন্ধ হচ্ছে না মাদক 

স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ৬৫টি এবং ২০২০ সালে ৮২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। যদিও রোহিঙ্গাদের হিসাবে এ সংখ্যা আরও বেশি৷ চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ছোট-বড় সাতটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷

গত ১১ জানুয়ারি উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের শফিউল্লাহ কাটা রোহিঙ্গা শরণার্থী-শিবিরে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে হতাহতের খবর পাওয়া না গেলেও প্রায় ৬০০ ঘর পুড়ে যায়। ৮ মার্চের অগ্নিকাণ্ডে চার বছরের শিশু মো. আয়াস নিহত হয়। উখিয়ার ৫ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের সাড়ে চারশো ঘরবাড়ি পুড়ে যায়।

বাংলাদেশে শিশুদের স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও কল্যাণে ১৯৫২ সাল থেকে কাজ করছে ইউনিসেফ। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদেরও সহায়তা করছে সংস্থাটি। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি ও মার্চ মাসে দুটি বড় অগ্নিকাণ্ডে ছয় শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্র পুড়ে যায়। ১৬ ও ৫নং ক্যাম্পে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাঁচ শতাধিক আশ্রয়স্থল আংশিক পুড়ে যায়। যা চার হাজারেরও বেশি মানুষকে প্রভাবিত করে।

আরও পড়ুন >> গল্পগুলো ভয়ংকর, মামলা হলেও বিচার মন্থর!

অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক সময় অসাবধানতার কারণে সেখানে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। তাছাড়া ঘিঞ্জি পরিবেশ, ত্রিপলের ছাউনিতে বাঁশ-কাঠের ঘর। আগুন লাগলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়মিত অগ্নিপ্রতিরোধ বিষয়ক মহড়া হয়। অগ্নিপ্রতিরোধে বিভিন্ন সরঞ্জামাদিও সরবরাহ করা হয়। কিন্তু আগুনের ভয়াবহতায় এর কিছুই ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি।

দাদার সঙ্গে আগুনের ভয়াবহতার শিকার এক রোঙ্গিা শিশু/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

‘এখন প্রতি সপ্তাহে মহড়া নয়, আগুন যাতে না লাগে সেজন্য সপ্তাহে ৩/৪ দিন সচেতনতামূলক গণসংযোগ চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে শিশুসুরক্ষা, শিশুদের অগ্নিভীতি দূর করতে মানবিক সহায়তা এবং কাউন্সিলিং-এর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উখিয়া ও টেকনাফে ফায়ার সার্ভিসের বেশকিছু স্যাটেলাইট ইউনিট স্থাপনের চেষ্টা চলছে৷ ইতোমধ্যে উখিয়ার ৪ নম্বর ক্যাম্পে একটি ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে’— বলেন ওই কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (উপ-সচিব) মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আর যাতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা না ঘটে সেজন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। আগুন লাগলেও তা যাতে দ্রুত নেভানো যায় সেজন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হয়েছে। শুধুমাত্র রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সেখানে নতুন ফায়ার স্টেশন চালু করা হয়েছে।

আরও পড়ুন >> সেনাবাহিনীর অধীনে ক্যাম্পগুলো দিলে অপরাধ বন্ধ হতো

নাশকতার গন্ধ পাচ্ছেন রোহিঙ্গারা
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কেন বারবার আগুন লাগছে। এটা কি কেবল অসাবধানতা— প্রশ্ন রাখা হয় রোহিঙ্গাদের মাঝে। তাদের অভিযোগ, বারবার আগুন লাগার পেছনে কোনো নাশকতামূলক তৎপরতা রয়েছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখা উচিত। অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটি হয়। কিন্তু সেই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন এবং তাদের সুপারিশ কখনও আলোর মুখ দেখে না।
 
আরও পড়ুন >> পাহাড়ে গর্ত করে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখে তারা

রোহিঙ্গা নেতা ও রোহিঙ্গা ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা খিন মং (Khin Maung) এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই কেন বারবার আগুন, এটা এখন শুধু আমাদের প্রশ্ন নয়; প্রশাসনকেও ভাবাচ্ছে। আগুন লাগছে নাকি লাগানো হচ্ছে, এটা স্পষ্ট হওয়া উচিত। কারও যোগসাজশে বা কূটচালে আগুনের ঘটনা ঘটছে কি না, তার সঠিক তদন্ত হওয়া দরকার।’
 
তিনি বাংলাদেশ সরকার, ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ, আইএলওসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন দাতা সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আগুনের কারণে রোহিঙ্গা অনেক শিশু ট্রমায় ভুগছে। এক ট্রমা থেকে বেরিয়ে আমরা বাংলাদেশে মানবিক আশ্রয়ে আছি। কিন্তু এখানে বারবার আগুনের ঘটনায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে অনেক শিশু। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি কাজের প্রয়োজন।

এ বিষয়ে অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘করোনাকালে বেশি আগুনের ঘটনা ঘটেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে আন্তর্জাতিক সংস্থা, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।  আগুনের কারণে রোহিঙ্গা শিশুদের মাঝে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে। অনেক শিশু নতুন করে ট্রমায় ভুগছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এটা শিশু অধিকারেরও অংশ।’

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা শিবিরে মায়ের কোলে এক শিশু/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)–এর পরিচালক ড. সি আর আবরার ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটা ট্রমা থেকে মুক্তি পেতে রোহিঙ্গারা নিজ জন্মভূমি থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। শিশুরা তো বটেই, বয়স্ক রোহিঙ্গা নাগরিকরাও ট্রমায় ভুগছে। সম্প্রতি বেশকিছু ছোট-বড় আগুনের ঘটনা তাদের নতুন করে ট্রমায় ফেলেছে। আগুনের ঘটনা তাদের সর্বস্বান্ত করছে।’

‘প্রত্যেকটি আগুনের ঘটনার তদন্ত হওয়া দরকার। আগুন যাতে না ঘটে সেজন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’

তার ভাষায়, ‘শিশু তো শিশুই। রোহিঙ্গা শিশু বলেই তাদের মানসিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টির অধিকার নেই; ব্যাপারটা এমন নয়। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শিশুসনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। সেজন্য আমাদের কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। শুধু বাংলাদেশি শিশু নয়, বিদেশি কিংবা রিফিউজি শিশুর অধিকারও রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। একটা ট্রমাটাইজ (আঘাত পাওয়া) শিশুকে যদি আমরা মানসিক সুস্থতা দিতে না পারি, সেটা আমাদের জন্যই ক্ষতিকর। বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থা নিয়ে তারা অন্যের উপর নির্ভরশীল কিংবা অন্যের ব্যবহারের হাতিয়ার হয়েও উঠতে পারে। এ কারণে রোহিঙ্গা শিশুদের পড়াশোনা, খেলাধুলা, বিনোদন ও পুষ্টিকর খাবারের যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য ডোনারের অভাব হবে না। শুধু কার্যকর উদ্যোগ দরকার।’

কক্সবাজারের একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প, এখানকার শিশুরা এখনো আগুন আতঙ্কে ভোগে / ছবি- ঢাকা পোস্ট

এদিকে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য নতুন করে সমর্থন এবং সহায়তা প্রদানের জন্য আবেদন করেছে ইউএনএইচসিআর। গত ২৩ আগস্ট জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির মুখপাত্র শাবিয়া মান্টু বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এখন অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। মানবিক সহায়তা বিষয়ক একাধিক সমীক্ষার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে বেশি অপূর্ণ চাহিদার মধ্যে রয়েছে সঠিক পুষ্টি, আশ্রয়ের উপকরণ, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং জীবিকার সুযোগ। বিশেষ করে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কার্যকর সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন। শিশু ও মহিলাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, বিশেষ করে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, চিকিৎসা, মানসিক-সামাজিক বা অন্যান্য সহায়তার সুযোগ থেকে বঞ্চিত তারা।

এদিকে, ট্রমায় ভোগা রোহিঙ্গা শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে ব্যাপকভাবে কাজ করছে ইউনিসেফ। যোগাযোগ করা হলে সংস্থাটির কমিউনিকেশন কনসালটেন্ট ময়ূখ মাহতাব ঢাকা পোস্টকে বলেন, শরণার্থী-শিবিরে অগ্নিকাণ্ডে শিশুদের দুটি শিক্ষাকেন্দ্র, ১৮৮টি পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন সুবিধা-সম্বলিত ব্যবস্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এগুলো পুনর্গঠন করা হয়েছে। ইউনিসেফ, সমাজসেবা অধিদপ্তর ও বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতে শিশু-সুরক্ষামূলক পরিষেবা প্রদানের কাজ চলছে।

অগ্নিকাণ্ডের কারণে নিজ নিজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ২৩ শিশুকে কেস ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসের মাধ্যমে তাদের পিতা-মাতার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ইউনিসেফ ও অংশীদাররা মর্মান্তিক অগ্নিদুর্ঘটনার কারণে শিশু এবং তাদের পরিবারের ক্ষতিকর মানসিক প্রভাব মোকাবিলায় মনস্তাত্ত্বিক প্রাথমিক চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করেছে। সমাজকর্মী ও সাইকো-সোশ্যাল সাপোর্ট ফ্যাসিলিটেটররা ক্রমাগতভাবে শিশু ও তাদের পিতা-মাতার উদ্বেগ এবং নিরাপত্তাহীনতার সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে মানসিক-সামাজিক সহায়তা প্রদান করছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে পৃথক অগ্নিনিরাপত্তা কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে— জানান ওই কর্মকর্তা।

দ্বিতীয় পর্বে থাকছে
নিষিদ্ধ শিশুশ্রমে ‘নীল’ ওদের শৈশব

জেইউ/এমএআর