প্রাণ নিয়েছে অনেক, শিখিয়েছেও বেশ
রোগী নিয়ে হাসপাতালে ছুটছেন স্বজনরা
২০২০ সালের ৮ মার্চ। বছরের অন্য দিনগুলোর মতো ওইদিনও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু করেন দেশবাসী। বেলা গড়িয়ে দুপুরের পর হঠাৎ এক খবরে থমকে যান সবাই। কারণ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এক ব্রিফিংয়ে দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের তথ্য জানায়। সেদিন দেশে তিনজন রোগী শনাক্তের কথা বলা হয়। যে খবরে প্রায় সবার মধ্যে এক অজানা ভয়-আতঙ্ক ভর করে।
করোনা নিয়ন্ত্রণে ১৮ দিন পর ২৬ মার্চ দেশে লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এরই মধ্যে দেশে ৩৯ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়। ওই সময় পর্যন্ত মারা যান পাঁচজন। সরকার সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। সবধরনের পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন করণীয় ঘোষণা আসতে থাকে।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের মার্চে পাঁচজন, এপ্রিলে ১৬৩ জন, মে মাসে ৪৮২ জন, জুনে এক হাজার ১৯৭ জন, জুলাইয়ে এক হাজার ২৬৪ জন, আগস্টে এক হাজার ১৭০ জন, সেপ্টেম্বরে ৯৭০ জন, অক্টোবরে ৬৭২ জন, নভেম্বরে ৭২১ জন, ডিসেম্বরে ৯১৫, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ৫৬৮ জন এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
এর মধ্যে বাড়তে থাকে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। সংক্রমণ রোধে সবাইকে বারবার হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা আর মুখে মাস্ক পরিধানের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ করোনা বিষয়ক বুলেটিনে দেখা যায়, রোববার (৭ মার্চ) পর্যন্ত বাংলাদেশে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার ৩৩০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে আট হাজার ৪৬২ জনের। আক্রান্তদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন পাঁচ লাখ তিন হাজার তিনজন।
বিজ্ঞাপন
করোনার এক বছরের চিত্র
করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের মার্চে পাঁচজন, এপ্রিলে ১৬৩ জন, মে মাসে ৪৮২ জন, জুনে এক হাজার ১৯৭ জন, জুলাইয়ে এক হাজার ২৬৪ জন, আগস্টে এক হাজার ১৭০ জন, সেপ্টেম্বরে ৯৭০ জন, অক্টোবরে ৬৭২ জন, নভেম্বরে ৭২১ জন, ডিসেম্বরে ৯১৫, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ৫৬৮ জন এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
আক্রান্ত হয়েছেন ২০২০ সালের মার্চে ৫১ জন, এপ্রিলে সাত হাজার ৬১৬ জন, মে মাসে ৩৯ হাজার ৪৮৬ জন, জুনে ৯৮ হাজার ৩৩০ জন, জুলাইয়ে ৯২ হাজার ১৭৮ জন, আগস্টে ৭৫ হাজার ৩৩৫ জন, সেপ্টেম্বরে ৫০ হাজার ৪৮৩ জন, অক্টোবরে ৪৪ হাজার ২০৫ জন, নভেম্বরে ৫৭ হাজার ২৪৮ জন, ডিসেম্বরে ৪৮ হাজার ৫৭৮ জন। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ২১ হাজার ৬৩০ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে সংক্রমণ কমে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৭৭ জনে।
২০২০ সালে করোনায় দৈনিক রোগী শনাক্তের হার প্রতি মাসের প্রথম ও শেষ সপ্তাহে যথাক্রমে- এপ্রিলে ৯ ও ১৩ শতাংশ, মে মাসে ১০ ও ২২ শতাংশ, জুনে ২১ ও ২০ শতাংশ, জুলাইয়ে ২১ ও ২১ শতাংশ, আগস্টে ২৫ ও ১৮ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ১৬ ও ১১ শতাংশ, অক্টোবরে ১৩ ও ১২ শতাংশ, নভেম্বরে ১৩ ও ১৭ শতাংশ এবং ডিসেম্বরে ১৫ ও ৮ শতাংশ। এভাবে ২০২১ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শনাক্তের হার ৮ শতাংশ, শেষ সপ্তাহে তা কমে নেমে আসে ৩ শতাংশে। তবে ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে শনাক্তের হার ১৪ শতাংশ, শেষের দিকে ১৩ শতাংশে দাঁড়ায়।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের বাবা মমিনুল হক৷ নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘আমার চোখের সামনে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাবা মারা গেছেন৷ আমি নিজে দেখেছি, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা কতটা চেষ্টা করেছেন৷ কিন্তু তখন আমরা জানতামই না, অক্সিজেনের এত দরকার৷ কিছু অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে, কিন্তু হাইফ্লো অক্সিজেন দিলে যে কাজ হয় সেটা তো তখন আমরা বুঝতে পারিনি৷ এখন বুঝেছি৷ করোনা অনেক প্রাণ নিলেও আমরা অনেক কিছু শিখেছিও।’
তিনি বলেন, ‘সারাদেশে ১৭৮টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা হয়েছে৷ চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতার জায়গাগুলোও আমরা দেখেছি৷ এখন সেগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে৷’
অধ্যাপক ডা. খুরশীদ আলম মনে করেন, ‘প্রস্তুতির কিছুটা অভাব ছিল সত্য, কিন্তু সেটা গাফিলতি নয়, বুঝতে না পারা৷’ ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘এই মহামারি সবার জন্যই নতুন অভিজ্ঞতা৷ বিশ্বও প্রস্তুতি নিতে পারেনি, আমরাও পারিনি৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুতিও বেড়েছে৷ এখন কিন্তু একই হাসপাতালে কোভিড, নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে৷ ডাক্তার-নার্সরা দক্ষ হয়ে উঠেছেন৷ প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্বাস্থ্য বিভাগের প্রশংসা করেছেন৷ এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিভাগ ভালো করেছে বলেই তো ব্লুমবার্গের করোনা ‘নিরাপদ’ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ২০-এর মধ্যে স্থান পেয়েছে৷ আমেরিকা, জার্মানির মতো বড় দেশ তা পারেনি৷ এই স্বীকৃতির কারণে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার সুযোগ নেই৷ তবে এটা তো একটা স্বীকৃতি তা মানতে হবে৷’
আপনার দৃষ্টিতে করোনাকালীন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের ব্যর্থতাগুলো কী ছিল—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো করোনা আসার পর তা আমরা বুঝতে পারিনি। আমাদের চিকিৎসকরা তখন কোনো গাইডলাইন পায়নি, কীভাবে চিকিৎসা দিতে হবে; এগুলো আমরা জানাতে পারিনি। এমনটা শুধু আমরাই না, সারা বিশ্বে হয়েছে। এছাড়া ওই সময়টাতে করোনাকে পুঁজি করে কিছু লোক অন্যায় করেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপরও যে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি, এটাই আমাদের বড় অর্জন।’
স্বাস্থ্য মহাপরিচালক বলেন, ‘করোনার সময়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার অনেক মানুষ মারা গেছেন। ২০২০ সালে করোনায় আমরা এতসব গুণী মানুষকে হারিয়েছি, যা কখনও ভোলার মতো নয়। আমাদের অসংখ্য ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন, বিশেষ করে এই সময়টাতে অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মারা গেছেন। যা আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। সেজন্য আমরা অত্যন্ত শোকাহত।’
তিনি আরও বলেন, ‘মৃত্যু তো সবারই আছে। প্রত্যেককে কোনো না কোনো সময় চলে যেতে হবে। কিন্তু করোনার কারণে একসঙ্গে এতগুলো মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।’
প্রথম রোগী শনাক্ত
বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। সেদিন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিনজন রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন নারী ও দুজন পুরুষ। দুজন ইতালি থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছেন। অপর একজন তাদের সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।
এ সময় সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি মাস্ক ব্যবহার করতে বলা হয়। ওই ঘোষণা আসার পর দেশে মাস্ক, স্যানিটাইজারের তীব্র সংকট দেখা দেয়। অতিরিক্ত দাম রাখার কারণে বেশ কয়েকটি ফার্মেসি সিলগালা করে দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর পরে কয়েকদিন নতুন কোনো রোগী শনাক্তের খবর জানায়নি আইইডিসিআর।
আমার চোখের সামনে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাবা মারা গেছেন৷ আমি নিজে দেখেছি, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা কতটা চেষ্টা করেছেন৷ কিন্তু তখন আমরা জানতামই না, অক্সিজেনের এত দরকার৷ কিছু অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে, কিন্তু হাইফ্লো অক্সিজেন দিলে যে কাজ হয় সেটা তো তখন আমরা বুঝতে পারিনি৷ এখন বুঝেছি৷ করোনা অনেক প্রাণ নিলেও আমরা অনেক কিছু শিখেছিও
ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদফতর
১১ এপ্রিল সংস্থাটি জানায়, যে তিনজন ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে দুজন সুস্থ হওয়ার পথে। আরেকটি পরীক্ষায় নেগেটিভ এলে তাদেরকে সুস্থ জানিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। একই দিন করোনাভাইরাসকে মহামারি বলে ঘোষণা দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)।
১৩ মার্চ আইইডিসিআর জানায়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিনজনের মধ্যে একজন সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গেছেন। নতুন রোগী পাওয়া যায়নি। তবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহ হলে যোগাযোগের জন্য বেশ কয়েকটি হটলাইন নম্বর চালু করা হয় সংস্থাটির পক্ষ থেকে। অনেকেই অভিযোগ করেন, বারবার চেষ্টা করেও তারা এসব হটলাইনে সংযোগ স্থাপন করতে পারেননি।
স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা
১৬ মার্চ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, ১৮ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সব স্কুল-কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকীর ছুটির সঙ্গে মিলে কার্যত পরদিন থেকেই ছুটি শুরু হয়। পরে অবশ্য সরকারের ঘোষিত সাধারণ ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে ছুটি ধাপে ধাপে বাড়ে।
করোনাভাইরাসে প্রথম মৃত্যু
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। আইইডিসিআর জানায়, আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ওই ব্যক্তি আজ মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন—উল্লেখ করে মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, ওই রোগীর কিডনি রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ফুসফুসে সমস্যা এবং হার্টের অসুখ ছিল। হার্ট সমস্যার কারণে সম্প্রতি তাকে রিংও পরানো হয়। তিনি গত কয়েকদিন হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলেন।
তিনি আরও জানান, বিদেশফেরত সত্তরোর্ধ্ব ওই ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার কারণে আরও একজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
এদিন আইইডিসিআর জানায়, বাংলাদেশে আরও চারজন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। পরদিন আরও তিনজন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার তথ্য জানানো হয়। এদের তিনজনই বিদেশফেরতদের সংস্পর্শে এসে সংক্রমিত হয়েছেন।
২০ মার্চ আরও তিনজনের সংক্রমিত হওয়ার তথ্য জানানো হয়। তারা সবাই ইতালিফেরত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে সংক্রমিত হয়েছেন বলে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়। এ নিয়ে বাংলাদেশে মোট করোনা সংক্রমণ রোগী দাঁড়ায় ২০ জনে।
১০ দেশের সঙ্গে প্লেন চলাচল ও ভিসা বন্ধ
২১ মার্চ (শনিবার) সরকারের এক ঘোষণায় জানানো হয়, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ১০টি দেশের সঙ্গে সবরকম প্লেন চলাচল ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। দেশগুলো হলো- কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুর ও ভারত। এসব দেশ থেকে যাত্রীবাহী কোনো প্লেন বাংলাদেশে নামতে দেওয়া হবে না। ফলে কার্যত আন্তর্জাতিক উড়োজাহাজ চলাচল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বাংলাদেশ। তবে যুক্তরাজ্য, চীন, হংকং ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে প্লেন চলাচল অব্যাহত থাকে। পরে চীন ছাড়া অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এর আগে ১৪ মার্চ ইউরোপ থেকে বাংলাদেশে সব ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রথমে ৩১ মার্চ পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পরে তা বাড়িয়ে ১৪ এপ্রিল করা হয়।
প্রস্তুতির কিছুটা অভাব ছিল সত্য, কিন্তু সেটা গাফিলতি নয়, বুঝতে না পারা৷ এই মহামারি সবার জন্যই নতুন অভিজ্ঞতা৷ বিশ্বও প্রস্তুতি নিতে পারেনি, আমরাও পারিনি৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুতিও বেড়েছে
ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদফতর
১৪ মার্চ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এক ঘোষণায় জানান, ইউরোপ থেকে ফ্লাইট আসা বন্ধের পাশাপাশি যেসব দেশ বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে, তাদের জন্য বাংলাদেশ ভিসা দেবে না। সেই সঙ্গে সব দেশের নাগরিকদের জন্য অন-অ্যারাইভাল ভিসাও বন্ধ থাকবে।
পরে ২৮ অক্টোবর করোনা মহামারির কারণে সাত মাসেরও বেশি সময় বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্লেন চলাচল শুরু হয়। আর করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্লেনযাত্রীদের বিশেষ কিছু নির্দেশনা মেনে চলতে বলা হয়।
২১ মার্চ দ্বিতীয় মৃত্যু
২১ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন আরও চারজন। পরদিন আরও তিনজন রোগী শনাক্তের তথ্য জানানো হয়। ২৩ মার্চ আরও ছয়জন রোগী শনাক্তের তথ্য জানায় আইইডিসিআর। তাদের মধ্যে একজন চিকিৎসক ও দুজন সেবিকা রয়েছেন। এদিন একজনের মৃত্যুর খবর জানানো হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষ ও এক-তৃতীয়াংশ নারী বলে জানানো হয়।
২৪ মার্চ আরও একজনের মৃত্যুর খবর জানায় আইইডিসিআর। এদিন আরও ছয়জনের আক্রান্ত হওয়ার খবর দেওয়া হয়। ২৫ মার্চ নতুন করে কারো কারোনা সংক্রমিত হওয়ার খবর না জানালেও, একজনের মৃত্যুর খবর জানানো হয়। মরদেহ দাফন করার জন্য ঢাকার একটি কবরস্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ ছুটি
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। পরে সেই ছুটি বাড়িয়ে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়।
২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে কোনো ধরনের আয়োজন করার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এ সময় সব ধরনের যানবাহন, রেল, নৌ ও প্লেন চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। জনসাধারণের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে দেশজুড়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
যদিও যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করার আগেই বিপুল মানুষের ঢল নামে, যারা কোনোরকম সামাজিক দূরত্বের পরোয়া না করে বাড়ির পথে রওনা হন।
ব্লুমবার্গের করোনা ‘নিরাপদ’ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ২০-এর মধ্যে স্থান পেয়েছে৷ আমেরিকা, জার্মানির মতো বড় দেশ তা পারেনি৷ এই স্বীকৃতির কারণে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার সুযোগ নেই৷ তবে এটা তো একটা স্বীকৃতি তা মানতে হবে
ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদফতর
সাধারণ ছুটির মধ্যে ওষুধ, কাঁচাবাজার ছাড়া সবরকমের দোকানপাট বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এসব দোকান বন্ধ করার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়। বাতিল করা হয় পহেলা এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা।
শর্তসাপেক্ষে খালেদা জিয়ার মুক্তি
২৪ মার্চ করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দুটি শর্তে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত রেখে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। নির্বাহী আদেশে এই মুক্তি দেওয়া হয়। শর্ত দুটি হলো- তিনি বিদেশে যাবেন না এবং বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেবেন।
সাধারণ ছুটি বাড়ল
সরকারি এক ঘোষণায় সাধারণ ছুটি আরও এক সপ্তাহ বাড়িয়ে প্রথমে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। পরে তা বাড়িয়ে পহেলা বৈশাখের ছুটির সঙ্গে মিল রেখে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
এর আগে ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে যেন কোনো ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং জমায়েত থেকে মানুষ যেন বিরত থাকে, সেই নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এর মধ্যেই তৈরি পোশাক খাতের অনেক কারখানার কর্মীদের কাজে যোগ দেওয়ার জন্য কিছু কিছু কোম্পানি নির্দেশ দিলে অসংখ্য কর্মী ট্রাকে, পিকআপে অথবা হেঁটে ঢাকার পথে রওনা দেন।
২০২০ সালে করোনায় আমরা এতসব গুণী মানুষকে হারিয়েছি, যা কখনও ভোলার মতো নয়। আমাদের অসংখ্য ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন, বিশেষ করে এই সময়টাতে অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মারা গেছেন। যা আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি
ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদফতর
লোকচলাচল ঠেকাতে পুলিশ সদরদফতর থেকে ‘কাউকে ঢাকার ভেতরে ঢুকতে বা বের হতে না দেওয়ার’ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা ঘোষণা
করোনাভাইরাসের আর্থিক ক্ষতি কাটাতে ৫ এপ্রিল ৭২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে তিনি তৈরি পোশাক খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন। প্রণোদনার এই অর্থ জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। মূলত ক্ষুদ্র, মাঝারি ও রফতানি খাতের জন্য এই প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়।
মুসল্লিদের ঘরে নামাজ পড়ার নির্দেশ
ধর্ম মন্ত্রণালয় এক ঘোষণায় মুসল্লিদের ঘরে নামাজ পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, শুধু ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমরা মসজিদে নামাজ আদায় করবেন। বাইরের মুসল্লিরা কেউ মসজিদে জামাতে অংশ নিতে পারবেন না। কেউ এই নির্দেশ অমান্য করে মসজিদে ভিড় করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ব্যবস্থা নেবে। অন্য সবাইকে বাসায় নামাজ পড়তে বলা হয়।
প্রথম লকডাউন
১৯ মার্চ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য প্রথম লকডাউন ঘোষণা করা হয় মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা। উপজেলায় ওষুধের দোকান এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান ছাড়া সব দোকান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ৭ এপ্রিল আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর নারায়ণগঞ্জকে লকডাউন ঘোষণা করে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।
৩০ জুন একদিনেই ৬৪ জনের মৃত্যুর খবর জানানো হয় সরকারের তরফ থেকে। এটি করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। ২ জুলাই ৪ হাজার ১৯ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়, যা একদিনের সর্বোচ্চ শনাক্ত।
জীবন ও জীবিকার এই অসম সমীকরণ মেলাতে গিয়ে অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও মে মাসের শেষদিকে বিধিনিষেধ শিথিল করা শুরু হয়। টানা ৬৬ দিনের লকডাউন ওঠার পর ৩১ মে থেকে অফিস খোলার পাশাপাশি গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। ধীরে ধীরে শুরু হয় ফ্লাইট চলাচল। আগস্টে বিনোদন কেন্দ্রও খুলে দেওয়া হয়।
দ্রুত বাড়তে থাকে শনাক্ত ও মৃত্যু
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ৩০ জুন একদিনেই ৬৪ জনের মৃত্যুর খবর জানানো হয় সরকারের তরফ থেকে। এটি করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। ২ জুলাই ৪ হাজার ১৯ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়, যা একদিনের সর্বোচ্চ শনাক্ত।
লকডাউনের মধ্যে নিদারুণ কষ্টে পড়ে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্যও স্থবির হয়ে পড়ে। সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া হলেও কল-কারখানা বন্ধ থাকায় এবং অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়ায় বড় ধরনের অর্থনৈতিক জটিলতার দিকে যেতে থাকে পরিস্থিতি।
বিধিনিষেধে বর্ষবরণ, ঈদ-পূজার সব আয়োজন
মহামারির কারণে এ বছর বিধিনিষেধের মধ্যে কেটেছে বাঙালির বর্ষবরণের উৎসব, দুই ঈদ, দুর্গা পূজাসহ ধর্মীয় সব আয়োজন। রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতাগুলোও সীমিত করে আনতে হয়েছে। স্থগিত রাখতে হয়েছে মুজিববর্ষের আয়োজন।
বছরের শেষদিকে এসে মোটামুটি সব খুলে দেওয়া হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও বন্ধ। উচ্চ মাধ্যমিকের পাশাপাশি পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাও এবার নেওয়া যায়নি।
করোনা মোকাবিলায় দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশ
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক আঘাত মোকাবিলায় সক্ষমতাসহ বিভিন্ন সূচকের ওপর ভিত্তি করে গত কয়েক মাস ধরে ‘করোনা সহনশীল’ দেশের আন্তর্জাতিক র্যাংকিং প্রকাশ করছে প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ। ডিসেম্বরে ব্লুমবার্গ প্রকাশিত ওই র্যাংকিংয়ে ২০ নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।
জীবনযাত্রার মান নির্ণায়ক সূচকগুলোর মধ্যে জিডিপি আর যোগাযোগ ব্যবস্থার গতির দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও, বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে রয়েছে জনজীবনে লকডাউনের প্রভাব আর স্বাস্থ্যসেবার মানের দিক থেকে।
ব্লুমবার্গের ‘কোভিড রেজিলিয়েন্স র্যাংকিং’-এ দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, সৌদি আরব, সুইজারল্যান্ডের মতো উন্নত দেশগুলোর চেয়েও এগিয়ে বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের ধারে কাছে নেই দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশই। এই তালিকার ভারত-পাকিস্তানের ঠাঁই হয়েছে তালিকার নিচের দিকে।
তবে ব্লুমবার্গের হিসাবে, জীবনযাত্রার মান নির্ণায়ক সূচকগুলোর মধ্যে জিডিপি আর যোগাযোগ ব্যবস্থার গতির দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও, বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে রয়েছে জনজীবনে লকডাউনের প্রভাব আর স্বাস্থ্যসেবার মানের দিক থেকে।
কমছে করোনা সংক্রমণ
যদিও দেশে শীতের মৌসুমে করোনার সংক্রমণ বাড়বে বলে আশঙ্কা ছিল। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। সে আশঙ্কা দূর করে চলতি বছরের প্রথম মাস থেকেই কমতে শুরু করেছে সংক্রমণের হার।
সংক্রমণের ১০ মাসে চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি দেশে প্রথম করোনা শনাক্তের হার ৬ শতাংশের নিচে নামে। অর্থাৎ সেদিন পরীক্ষা অনুপাতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরের ৩ ও ৪ এপ্রিল শনাক্তের হার ২ শতাংশের ঘরে ছিল। তবে তখনও রোগটি সামাজিকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি এবং পরীক্ষার সংখ্যাও ছিল সীমিত, অর্থাৎ ৫শ’র কম। এর আগে ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর প্রথম এক মাস সংক্রমণের মাত্রা ছিল খুবই কম। তখন পরীক্ষা কম হওয়ার পাশাপাশি শনাক্তও কম ছিল।
দেশজুড়ে টিকাদান শুরু
সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি এক হাজার পাঁচটি হাসপাতালে ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি করোনার টিকা দেওয়া হয়। সেদিন থেকে সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত এ টিকাদান কর্মসূচি চলে।
টিআই/জেডএস/এমএআর/