ব্রিকসে যুক্ত হলে বাংলাদেশ কি লাভবান হবে?
ব্রিকস
বিশ্বের পাঁচ বৃহৎ উদীয়মান অর্থনীতির জোট ব্রিকস বা নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে (এনডিবি) বাংলাদেশকে যুক্ত হতে সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ভারতের শীর্ষ নেতার পক্ষ থেকে প্রস্তাব এসেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানও ব্রিকসে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। তবে ঢাকা ব্রিকসে যুক্ত হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে এখনও কোনো সবুজ সংকেত দেওয়া হয়নি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যত দ্রুত সম্ভব সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্রিকসে যুক্ত হতে। তবে ভারত প্রস্তাব দিয়েছে বলে নয়, বাংলাদেশের স্বার্থেই যুক্ত হতে হবে। কারণ ব্রিকসে যুক্ত হলে বাড়তি কিছু অর্থ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য একটি উৎস তৈরি হবে।
বিজ্ঞাপন
আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিকভাবে বাংলাদেশ এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক বা এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ছাড়া অন্য কোনো ব্যাংকেরই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি ব্রিকসে যুক্ত হয় দ্বিতীয় কোনো আন্তর্জাতিক ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া ব্যাংকটিতে যোগ দিলে ছাড়করা ঋণ পেতে বাংলাদেশের পথ সুগম হবে।
গত ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শীর্ষ ভার্চুয়াল সম্মেলন হয়। সম্মেলন শেষে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ব্রিকস ব্যাংকে বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানিয়েছেন। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন হাইকমিশনার।
বিজ্ঞাপন
দুই প্রধানমন্ত্রীর সম্মেলন শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনও একই তথ্য জানান। বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশ বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবে। তারপরই সিদ্ধান্তে যাবে।
বিশ্বের পাঁচ বৃহৎ উদীয়মান অর্থনীতির জোট ব্রিকসের উদ্যোগে চীনের সাংহাইয়ে ২০১৫ সালে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) নামে নতুন একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংক যাত্রা শুরু করে। এটি ব্রিকস ব্যাংক নামেও পরিচিত। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা—এ পাঁচটি দেশের আদ্যক্ষর নিয়েই নামকরণ হয় ব্রিকস জোটের।
ব্রিকসে বাংলাদেশে যুক্ত হওয়ার সমর্থন জানিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এ বি এম মির্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমিতো মনে করি এখানে যুক্ত হতে কোনো অসুবিধা নেই। কারণ ওখানে চীন-ভারত দুটো পরাশক্তি রয়েছে। সুতরাং সেখানে ভারতের ডমিনেন্ট থাকবে বলে মনে হয় না। বরং এটা একটা অলটারনেটিভ সোর্স অব এক্সটারনাল অ্যাসিসটেন্ট হতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটাতে যুক্ত হলে বাংলাদেশের কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না। তবে টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশানস অব জয়েনিং কী হবে সেটা বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটাতে আমি যুক্ত হতে সমর্থন করছি।’
ব্রিকসের অনুমোদিত মূলধন ১০০ বিলিয়ন ডলার। প্রাথমিকভাবে ব্যাংকটি ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার তহবিল দিয়ে যাত্রা শুরু করে। শুরুতে ব্যাংকের জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবকাঠামোখাতের প্রকল্পে ঋণ সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ দেবে ব্যাংকটি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্রিকসে আমাদের যুক্ত হওয়া উচিত। যদি সম্ভব হয় এটার যখন ফাউন্ডিং হয় তখনই হয়ে যাওয়া উচিত। তখন ফাউন্ডিং মেম্বার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। যুক্ত হতে হবে সেটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে ভারতের কথায় আমাদের যাওয়া ঠিক হবে না। আমরা যাব আমাদের স্বার্থে। এটাতে যুক্ত হয়ে বছরে যদি আমরা ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার পাওয়ার সুযোগ হয়, তাতে খারাপ কী? শুধু এডিবি বা বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভর না করে আমরা এখান থেকেও কিছু সাপোর্ট পেতে পারি। তবে এটাও সত্য যে ব্রিকসের ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ডেভলপ হতে আরও অন্তত তিন থেকে চার বছর সময় লেগে যাবে।’
ব্রিকসে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও দেখছেন এই অর্থনীতিবিদ। সমস্যার ব্যাখায় তিনি বলেন, ‘ব্রিকস ব্যাংকে কিছু সমস্যা রয়েছে। এখানে নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে। মাল্টিকন্টিনেন্ট একটা রেস্টিকশান, যেমন ভারত চাইবে আমরা তাদের সমর্থন করি; চীন-রাশিয়া ও ব্রাজিলের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হবে। তবে এটাতে আমাদের কিছু আসে যায় না।’
ব্রিকস প্রতিষ্ঠার শুরুতেই নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সদস্য দেশগুলো পালাক্রমে এ ব্যাংকের নেতৃত্ব দেবে। প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভারতের কুন্ডাপুর ভামান কামাথ চার বছর ১০ মাস দায়িত্ব পালনের পর গত মে মাসে ব্রিকসের নতুন প্রেসিডিন্ট করা হয় ব্রাজিলের অর্থমন্ত্রী মাক্সোস প্রার্ডো ট্রয়জোকে। আর ভাইস-প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান ভারতীয় ব্যাংকার অনিল কিশোরা (স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া)।
সিপিডির ফেলো, অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ব্রিকস ব্যাংকটা হচ্ছে নিউ ডেভলপমেন্ট ব্যাংক। বাংলাদেশ যুক্ত হতে চাইলে কিছু সিড মানিও দিতে হতে পারে। ভারত যেহেতু এটার একটা ফাউন্ডিং মেম্বার হিসেবে বাংলাদেশকে যুক্ত হতে বলছে, এটাকে আমি একটা স্বীকৃতি বলব। ধারণা হিসেবে এটা ভালো। বাংলাদেশ এ নতুন ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইলে এটার যে নিয়ম-কানুন হবে সেগুলো ভালোভাবে জেনেশুনে নিতে হবে। এটার সঙ্গে যুক্ত হলে ক্রেডিট পাওয়ার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের একটা সুবিধা হবে। আমার মনে হয় এটা ভাল, তাই ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। ফাউন্ডিং মেম্বার হওয়ার সুযোগ থাকায় যত দ্রুত সম্ভব যুক্ত হওয়া, এটা খুব ভাল হবে।’
ব্রিকস জোটে ২০১২ সালে এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ওঠে। কিন্তু এটির প্রধান কার্যালয়, ব্যবস্থাপনা ও তহবিল গঠন নিয়ে উদ্যোক্তাদের মধ্যে দর-কষাকষি দেখা দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা বিলম্বিত হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালে ব্যাংকটি যাত্রা শুরু করে।
এনআই/এসএম