ড. জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ

স্বাধীনতার সময় দেশে অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান— এ তিন মৌলিক চাহিদা পূরণের সক্ষমতা তাদের ছিল না। এ সংখ্যাটা মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। এটা দেশের উল্লেখযোগ্য বড় অর্জন— মনে করেন বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, সব সেক্টরেই উল্লেখযোগ্য সফলতা এসেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। দেশ স্বাধীনের শুরুতে সম্পূর্ণ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ছিল আমাদের। ওই সময় প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। সেখান থেকে বর্তমানে কৃষি অর্থনীতি ৪০-৪২ শতাংশে নেমে এসেছে। বেশির ভাগই এখন সেবা, শিল্প ও নির্মাণ খাতে জীবিকা নির্বাহ করছে। বর্তমানে কৃষির বহুমুখীকরণ হয়েছে। তার মানে, কৃষিতে এখন আধুনিকায়নের ছোঁয়া লেগেছে, প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। বাণিজ্যিকভাবে কৃষির উৎপাদন হচ্ছে। স্বাধীনতার পর পাট ও চা ছিল রফতানি আয়ের প্রধান উৎস। সেখান থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে শিল্প-পণ্যভিত্তিক রফতানিতে রূপান্তরিত হয়েছে দেশ। সুতরাং রফতানিতে একটা পরিবর্তন ঘটেছে।

সাক্ষরতার বিষয়ে তিনি বলেন, উন্নয়নের সঙ্গে সাক্ষরতার হারও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেশির ভাগ মানুষের অক্ষর জ্ঞান ছিল না। বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশে উঠে এসেছে। প্রাইমারি স্কুলে এনরোলমেন্ট প্রায় শতভাগ। মাধ্যমিকেও অনেক বেড়েছে। শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে ব্যাপক। এটাও উন্নয়নের আরেকটা অর্জন।

কৃষিতে এখন আধুনিকায়নের ছোঁয়া লেগেছে, প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। বাণিজ্যিকভাবে কৃষির উৎপাদন হচ্ছে। স্বাধীনতার পর পাট ও চা ছিল রফতানি আয়ের প্রধান উৎস। সেখান থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে শিল্প-পণ্যভিত্তিক রফতানিতে রূপান্তরিত হয়েছে দেশ। সুতরাং রফতানিতে একটা পরিবর্তন ঘটেছে

ড. জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ

স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতির বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য এ অর্থনীতিবিদ বলেন, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক ধরা হয় আয়ুষ্কাল। আগে যেখানে মানুষ ৪০-৪১ বছর বাঁচত, এখন সেটা ৭০-এর ওপরে। তার মানে, ৫০ বছরে গড় আয়ুষ্কাল ৩০ বছর বেড়েছে। এগুলো উন্নয়নের চূড়ান্ত ফলাফল।

ড. জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ

জন্মনিয়ন্ত্রণেও অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে বিষয়টি দুঃস্বপ্নের মতো ছিল। দেশে তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষ। বছরে তিন শতাংশ হারে জনসংখ্যা বাড়ছিল। এভাবে যদি মানুষের সংখ্যা বাড়ত তাহলে দেশ দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ে থাকত। সেখানে ১৯৮০ সাল থেকে ব্যাপকভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। এটা বিশাল কাজে দিয়েছে।

আবাসন খাতের উন্নয়নের বিষয়ে তিনি বলেন, আজ ঢাকায় যে বড় বড় ভবন হচ্ছে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যবিত্তরা ঘরের মালিকানার স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এমন আবাসনের সুযোগ ছিল না। নির্মাণ খাতে বড় ধরনের একটা পরিবর্তন ঘটেছে।

স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক ধরা হয় আয়ুষ্কাল। আগে যেখানে মানুষ ৪০-৪১ বছর বাঁচত, এখন সেটা ৭০-এর ওপরে। তার মানে, ৫০ বছরে গড় আয়ুষ্কাল ৩০ বছর বেড়েছে। এগুলো উন্নয়নের চূড়ান্ত ফলাফল

ড. জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ

যোগাযোগ খাত প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, স্বাধীনতার পর দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ হলে যোগাযোগের একটা বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি হবে। অন্যদিকে গ্রামীণ যোগাযোগ ও বিদ্যুতায়নে সরকার ব্যাপক উন্নয়ন করেছে।

কৃষিতে এখন আধুনিকায়নের ছোঁয়া লেগেছে, প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে : ড. জাহিদ হোসেন

‘বর্তমানে মডার্ন ইকোনমি ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক’ উল্লেখ করে ড. জাহিদ বলেন, ‘দেশের ইকোনমিটা কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। ঢাকা এখন বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ হচ্ছে এবং এর বিস্তারও ঘটছে না। সুতরাং নগরায়ণের ব্যবস্থাপনাটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেসব উপশহর এখন গড়ে উঠছে আগামীতে সেগুলোর যেন একই পরিণতি না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে।’

‘উচ্চ আয়ের দেশে যাওয়া মানে সবাইকে নিয়ে যাওয়া, গড়পড়তা নয়। ওই পর্যায়ে যেতে হলে প্রযুক্তির উন্নয়ন, ব্যক্তি ও সরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রয়োজন। এটা বড় চ্যালেঞ্জ। সেই বিনিয়োগ যাতে হয়, এজন্য ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের জন্য সরকারি খাতের বিনিয়োগও গুরুত্বপূর্ণ। এসবের সঙ্গে প্রয়োজন দক্ষ শ্রমশক্তির। দক্ষ শ্রমশক্তির উন্নয়নে মৌলিক শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন করতে হবে। বিজ্ঞানচর্চা বাড়াতে হবে। এজন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’

দক্ষ শ্রমশক্তির উন্নয়নে মৌলিক শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন করতে হবে। বিজ্ঞানচর্চা বাড়াতে হবে। এজন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে

ড. জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ

‘আমাদের শিক্ষার প্রসার ঠিকই হয়েছে কিন্তু কোয়ালিটির দিক থেকে এখনও পিছিয়ে’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে যে শিক্ষা সাড়ে ছয় বছর বয়সে পাওয়ার কথা সেই শিক্ষা পেতে আমাদের সময় লাগে ১১ বছর। কাজেই এখানে সাড়ে চার বছরের ঘাটতি আছে। ঘাটতি থাকা মানে অতিরিক্ত ব্যয়। শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নে এখানেই বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের।’

শুধু চিফ লেবারের ভিত্তিতে আমরা বেশি দূর এগোতে পারব না : ড. জাহিদ হোসেন

উন্নয়ন টেকসই করতে হলে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে— মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। তার মতে, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারি বা বেসরকারিপর্যায়ের অনেক কিছুই ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। সরকারি খাত ও প্রশাসনে যেসব দুর্নীতি হয়, সেসব খাতে ঘুষ নিলেও প্রাপ্য সার্ভিসটা নিশ্চিত করতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে পারলে দুর্নীতি থাকা সত্ত্বেও দেশ এগিয়ে যাবে।’

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) অর্জনে ঝুঁকি আছে। বিশ্বে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যিক সুবিধা চলে যাবে। বর্তমানে আমরা এলডিসির সবচেয়ে বড় সুবিধা পাই কানাডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) ও ইউকে থেকে। বড় এ বাজারগুলোতে শুল্কমুক্ত, কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার আছে। সেটা উঠে যাবে। তবে এর পরিবর্তে কী আসবে সেটা নির্ভর করছে আমরা চতুরতার সঙ্গে কতটুকু রিনেগোশিয়েট করছি। কারণ এখনও অনেক দেশ আছে, যারা এলডিসিতে নেই কিন্তু এলডিসির সুবিধা পাচ্ছে। বাণিজ্যচুক্তি বা আন্তর্জাতিক অর্থনীতির জোটের ভেতরে ঢুকে এগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে। কাজেই এলডিসি চলে গেলে যে সব সুবিধা একেবারে হারিয়ে যাবে, সেটা নির্ভর করছে আমরা কতটা দক্ষতার সঙ্গে প্রস্তুতি নিচ্ছি তার ওপর। এজন্য ইকোনমির ডিপ্লোম্যাসিগুলো আরও স্মার্টলি করতে হবে। তা না হলে এলডিসি থেকে বের হওয়ার ঝুঁকিগুলো বাস্তবে আমাদের জন্য ক্ষতিকর হবে।’

বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারি বা বেসরকারিপর্যায়ের অনেক কিছুই ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। সরকারি খাত ও প্রশাসনে যেসব দুর্নীতি হয়, সেসব খাতে ঘুষ নিলেও প্রাপ্য সার্ভিসটা নিশ্চিত করতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে পারলে দুর্নীতি থাকা সত্ত্বেও দেশ এগিয়ে যাবে

ড. জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ

এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে দেশের ওষুধ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে ড. জাহিদ বলেন, ইন্টেলেকচুয়াল টিপসের অধীনে ওষুধ শিল্পের একটা ওয়েবার আছে ২০৩১ সাল পর্যন্ত। একেবারে জেনেরিক প্রোডাক্টের পেটেন্ট ছাড়া কোনো রয়েলিটি টিপস দিতে হয় না। এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে এ সুবিধাগুলো থাকবে না। এটা এলডিসির ভিত্তিতে দেওয়া। তবে এখনও সময় আছে। এর মধ্যেই রিনেগোশিয়েট করতে পারলে ধরে রাখা সম্ভব।’

প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে : ড. জাহিদ হোসেন

রিনেগোশিয়েটের যোগ্যতা আমাদের হয়েছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিদেশে আমাদের যেসব অর্থনীতিবিদ আছেন, তার বসে বসে কবিতা লেখেন। আমার মনে হয় সরকারের লক্ষ্যের দিকে তাদের বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার। রিনেগোশিয়েটের জন্য তাদের কাজ করতে হবে। কারণ তারা ওই দেশের অর্থনীতি বোঝেন। তারা যদি সরকারকে ওই সব দেশের পরিস্থিতি না জানান তাহলে সরকার এটা বুঝতে পারবে না। তাদের বিদেশে বসে অর্থনীতিচর্চা করতে হবে।’

এলডিসি চলে গেলে যে সব সুবিধা একেবারে হারিয়ে যাবে, সেটা নির্ভর করছে আমরা কতটা দক্ষতার সঙ্গে প্রস্তুতি নিচ্ছি তার ওপর। এজন্য ইকোনমির ডিপ্লোম্যাসিগুলো আরও স্মার্টলি করতে হবে। তা না হলে এলডিসি থেকে বের হওয়ার ঝুঁকিগুলো বাস্তবে আমাদের জন্য ক্ষতিকর হবে

ড. জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ

পোশাক শিল্পে আমাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম। তাদের সঙ্গে ফাইট করে দেশের পোশাক শিল্প কতটা এগোতে পারবে— এমন প্রশ্নের জবাবে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পোশাক শিল্পের সম্ভাবনা কিন্তু ফুরিয়ে যায়নি। শুধু চিফ লেবারের (স্বল্পমূল্যের শ্রম) ভিত্তিতে আমরা বেশি দূর এগোতে পারব না। এছাড়া, এ শিল্পে কথায় কথায় নীতিসহায়তা দেওয়া হয়। এটা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নিজেদের মধ্যে গলাকাটা প্রতিযোগিতা না করে অন্য দেশের সঙ্গে করতে হবে।

শ্রমিকদের অধিকারের প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের অবস্থার যদি উন্নতি না হয় তাহলে বিদেশিরা মুখ ফিরিয়ে নেবে। এ  শিল্পের ভাবমূর্তি আরও উন্নত করতে হবে। অন্যথায় পরিবর্তিত বিশ্বে এর সমৃদ্ধি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে— বলেন ড. জাহিদ হোসেন।

এসআর/এসএসএইচ/এমএআর/