দুটি ওড়না-এক লুঙ্গিতে জীবন বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা
দুটি ওড়না-এক লুঙ্গিতে ভর করে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল একটি পরিবার/ ছবি: সুমন শেখ
রাত তখন ৩টা ১৮ মিনিট। হঠাৎ গোডাউন থেকে বিস্ফোরণে দাও দাও করে আগুন জ্বলে ওঠে আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানসনে। চারিদিকে যখন আর্তনাদ তখন ভবনের ৩তলায় রাস্তার পাশের ফ্ল্যাটে থাকা লোকজন দুটি ওড়না আর একটি লুঙ্গি গ্রিলের সঙ্গে পেঁচিয়ে নিচে নেমে জীবন বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালান। তবে এতেও অনেক ঝুঁকি। কেননা ওড়না ও লুঙ্গি ধরে নামলেও তাদের ৮-১০ ফুট উপরে থেকে লাফ দিতে হতো।
জীবন বাঁচানোর এমন প্রচেষ্টা দেখে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাদের ঝুঁকি নিতে বারণ করেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আশ্বস্ত করেন নিরাপদে তাদের নামিয়ে আনা হবে। এমন আশ্বাস পেয়ে পরিবারটি আর ঝুঁকি নেয়নি। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভবনের ৩তলা থেকে ল্যাডারের মাধ্যমে তাদের নিরাপদে উদ্ধার করেন।
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) দিবাগত রাত ৩টা ১৮ মিনিটে আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানসনে আগুনের সূত্রপাত ঘটার ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে ভবনের ৩তলা থেকে বাঁচার জন্য ওড়না ও লুঙ্গি ঝুলানো হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা ঢাকা পোস্টকে জানান।
বিজ্ঞাপন
মো. ইলিয়াস হোসেন নামে একজন প্রত্যক্ষদর্শী ঢাকা পোস্টকে জানান, আমরা পাশের গলিতে ছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পেয়ে ঘটনাস্থলে দৌড়ে এসে দেখি হাজী মুসা ম্যানসনে আগুন লেগেছে। এর মধ্যেই ভবন থাকা লোকজন জানালার কাঁচ ভেঙে যেভাবে পারছেন বাঁচার জন্য আর্তনাদ করছেন। এমন সময় ভবনের ৩তলার রাস্তার পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা দুইটি ওড়না ও একটি লুঙ্গি একসঙ্গে বেঁধে গ্রিলের সঙ্গে পেঁচিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি উপস্থিত হয়। এভাবে ভবন থেকে তাদের নামার চেষ্টার দৃশ্য দেখে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাদের মাইকিং করে এভাবে না নামার অনুরোধ জানায় এবং তাদের নিরাপদে উদ্ধার করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ফায়ার সার্ভিসের কথা শুনে তারা ভেতরে চলে যান। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাদের ল্যাডারের সাহায্যে নিরাপদে নিচে নামিয়ে আনে।
এদিকে আগুন নিয়ন্ত্রণের সময় ও পরে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যায়। এ সময় ভবনটি থেকে ফায়ার সার্ভিসের উড়ন্ত সিঁড়ির মাধ্যমে প্রায় অর্ধশতাধিক লোককে উদ্ধার করে নিরাপদে নিয়ে আসা হয়। এছাড়া হাজী মুসা ম্যানসনের সঙ্গে লাগোয়া অনেক ভবনের ছাদেও উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, আগুন লাগার ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১৭ জন। এদের মধ্যে ১৪ জন ভবনের বাসিন্দা। আর বাকি তিনজন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী। আহতদের ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া এ ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছেন।
অগ্নিকাণ্ডের সার্বিক বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বলেন, হাজী মুসা ম্যানসনে প্রচুর পরিমাণে কেমিক্যাল রয়েছে। এগুলো অবৈধ কেমিক্যালের দোকান। আমার জানা মতে ফায়ার সার্ভিস এদের কোনো ধরনের লাইসেন্স দেয়নি। তবে আমি জানি না সিটি করপোরেশন তাদের ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে কি না। সম্পূর্ণ অবৈধভাবে এ কেমিক্যাল গোডাউনে গড়ে উঠেছে। নিচ তলায় কেমিক্যাল আর উপরে মানুষে বসবাস, এর মানে অগ্নিকুণ্ডে বসবাস করা ছাড়া আর কিছুই না। এজন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এছাড়া আমরা যখন ঘটনাস্থলে প্রথম আগুন নেভাতে আসি, কেমিক্যালগুলোর জন্য আগুন নেভাতে আমাদের অনেক সমস্যা হয়েছে।
তিনি বলেন, আগুন লাগার কারণ তদন্তের পর জানা যাবে। আমরা ভবনে আটকে পড়াদের দ্রুত উদ্ধার করতে পেরেছি। আহতদের দ্রুত উদ্ধার করতে পারায় তারা বেঁচে গেছেন। তাদের কেউই আশঙ্কাজনক অবস্থায় নেই।
অন্যদিকে ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী হাজী মুসা ম্যানসনের পাশে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এটিএম বুথের সিকিউরিটি গার্ড বজলুর রহমান ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৩টা ১৫ মিনিটে এটিএম বুথের দরজা খুলে আমি ভেতরে রেস্ট নিচ্ছিলাম। সেখান থেকে হাজী মুসা ম্যানসন দেখা যাচ্ছিল। দুই-তিন মিনিট পর ভবনটিতে আলোর জ্বলকানি দেখতে পাই। তখন বিকট শব্দ হয়। দৌড়ে ভবনটির সামনে যাই, তখন আগুন অল্প ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন দ্রুত ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, তখন রাস্তায় থাকা একজনকে নিয়ে ভবনটির নিচ তলার কেঁচি গেইটটি ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করি। ভেতরে ঢুকেই একজনকে নিচে আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি। তখন আমরা তাকে উদ্ধার করে বাইরে নিয়ে আসি। তারপর আমরা দুজন দোতলায় যাই। কিন্তু আগুন বেড়ে যাওয়ায় আমরা দ্রুত বের হয়ে আসি ভবন থেকে। তখনও আগুন বাড়ছিল। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
এদিকে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা শুধু মানুষের জীবনই বাঁচাননি, বাঁচিয়েছেন পাখির জীবনও। হাজী মুসা ম্যানসনে সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ অভিযানের শেষ দিকে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টায় ভবনের দ্বিতীয় তলায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দেখেন, একটি টিয়া পাখি খাঁচার ভেতরে ছটফট করছে। তখন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা টিয়া পাখিটির দিকে যতই এগোচ্ছিলেন, পাখিটির ছটফট করা আরও বেড়ে যায়। যেন বাঁচার আকুতি জানাচ্ছিল পাখিটি। এ অবস্থা দেখে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ল্যাডারের মাধ্যমে পাখিটি উদ্ধার করে নিচে নিয়ে আসেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) দিবাগত রাত ৩টা ১৮ মিনিটে আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানসনে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। ওই ভবনের দোতলা থেকে পাঁচতলায় মানুষ বসবাস করে। আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের ছয়টি ও ভয়াবহতা বেড়ে গেলে আরও চারটিসহ মোট ১০টি ইউনিট পাঠানো হয়। পরে শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) সকালে ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
স্থানীয়রা বলছেন, এখানকার প্রায় প্রতিটি ভবনের নিচে কেমিক্যালের গোডাউন রয়েছে। আগে এই এলাকায় সব ছিল কেমিক্যালের গোডাউন। ধীরে ধীরে মানুষের বসবাস শুরু হয়। ভবনও বহুতল হতে থাকে। এটি বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবেই বেশি পরিচিত।
ভবনটিতে ১৮টি পরিবার বসবাস করে। ঘটনার সময় অতিরিক্ত ধোঁয়ার কারণে আশপাশের ভবন থেকেও বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয়। আটকে পড়া অনেককেই মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। গ্রিল কেটে, গ্রিল ভেঙে, জানালা ভেঙে, ছাদের দরজা ভেঙে আটকে পড়াদের উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
আরও পড়ুন: আরমানিটোলায় আগুন : চিলেকোঠা থেকে আরও ২ মরদেহ উদ্ধার
এমএসি/এআর/এসএসএইচ