বাবার সঙ্গে জেসমিন

রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর। লেকের পাড়ে বটগাছের ছায়ায় মাটিতে বিছানো মাদুরে শুয়ে আছে একটি শিশু। তার ডান হাতে ব্যান্ডেজ, চোখের চারদিকে জখমের কালচে দাগ। ঠোঁটে-নাকে-মুখে কয়েকটি মাছি বসছে। পাশেই বসে মাছিগুলো তাড়ানোয় ব্যস্ত মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি।

হারুন নামে মধ্যবয়সী ওই ব্যক্তি জানালেন, শিশুটি তার সন্তান। নাম জেসমিন। বয়স ১০ বছর। আম গাছ থেকে পড়ে এ অবস্থা হয়েছে। বিস্তারিত আলাপচারিতায় তিনি বললেন, ‘আমার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রামে। তবে এতটুকুই ঠিকানা। বাস্তবে আমি ভূমিহীন। গ্রামের বাড়িতে বাড়িঘর জমিজমা কোনো কিছুই নেই। বাবা-মায়ের হাত ধরেই ছোট্ট বেলায় ঢাকায় এসেছিলাম। দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর ধরে শহরের পথে-ঘাটে, ফুটপাতে, পার্কেই কাটছে জীবন।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িতে কাজ করে যে টাকা আয় হতো তা দিয়েই স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়েই সংসার চলত। কষ্টের এই জীবনে অর্ধাহারে-অনাহারে নানা রোগে এই ফুটপাতেই আমার স্ত্রী মারা গেছে। দীর্ঘদিন ময়লার গাড়িতে কাজ করায় গ্যাসের কারণে আমিও শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত। এখন বিপদে পড়েছি এক ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে। ছেলেটাও এখন ময়লার গাড়িতে কাজ করে। মেয়েটাকে নিয়ে ফুটপাতে থাকি। ছেলে মানুষ নিয়ে খোলা জায়গায় থাকতে সমস্যা হয় না। কিন্তু মেয়েটা বড় হচ্ছে। কী করব, কোথায় যাব- কিছুই বুঝতে পারছি না।’

শোয়া থেকে উঠে বসে শিশু জেসমিন। চেহারায় অযত্ন আর অবহেলায় ছাপ স্পষ্ট। তবুও জখমের ব্যথা আর গরমে কাতর শিশুটি খানিকটা হেসে বলল, ‘কলাবাগান খেলার মাঠে গেছিলাম খেলা দেখতে। খেলা যহন শেষ, তহন চইলা আওনের সময় লগের পোলাপানডি কইল আম খাইবো। আমিও তাগো লগে গেলাম। তহন গাছে উঠতে গিয়া মাটিত পইড়া যাই। তারপর আর কিছু মনে নাই।’

করোনার এই সময়ে সামাজিক দূরত্ব, হোম কোয়ারেন্টাইন, স্বাস্থ্যবিধি এসব কথা শুধুই বিলাসিতা শিশু জেসমিনের কাছে। দশ বছরের ছোট্ট এই জীবনে কখনও পরিচ্ছন্ন জামা, পেটভর্তি খাবার, সুন্দর বিছানা কপালে জোটেনি তার। অল্প বয়সেই হারাতে হয়েছে মাকেও। মায়ের স্মৃতি আর আদর প্রতিক্ষণেই তাড়িয়ে বেড়ায় তার শৈশবকে।

সে বলল, ‘আমাকে মা অনেক বেশি আদর করত। মা আমাকে রেখে চলে গেছে- এখনও এটা আমার বিশ্বাস হয় না। সবাই বলে আমার মা বাঁইচা থাকলে নাকি আমি এমন ব্যথা পাইতাম না। মা নাকি আমারে দেইখা রাখত।’

প্রাণঘাতী ভাইরাস করোনার বিষয়ে কোনো চিন্তা নেই তার। এমনকি এ বিষয়ে মোটেও আতঙ্কিত নয় সে। তার চিন্তা ক্ষুধা নিয়ে। বড় ভাই ময়লার গাড়িতে কাজ করে যে টাকা আয় করে, তা দিয়েই কোনরকমে খাবার জোটে। ভালো খাবার পেতে হলে অপেক্ষায় থাকতে হয় মানুষের সাহায্যের।  

জেসমিনের বাবা হারুন জানালেন, চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে তার হিমশিম খেতে হচ্ছে। যেদিন মেয়ের দুর্ঘটনা ঘটল, সেদিন এখানকার ময়লার গাড়ি থেকে পাঁচ টাকা করে চাঁদা তুলে তারপর মেয়ের চিকিৎসা করেছেন। তবে নিয়মিত ড্রেসিং করার কথা থাকলেও সেটি সম্ভব হয়ে উঠেনি। অনেক মানুষ সহযোগিতা করেছেন যার ফলে ঔষধ খাওয়ানো সম্ভব হয়েছে। 

তিনি জানালেন, অসুস্থ হয়ে কোনো কাজকর্ম করতে পারেন না তিনি। রাস্তার পাশে বসে চা বিক্রি করবেন, সেই সরঞ্জামাদিও নেই। ছেলেকে নিয়ে কখনো চিন্তা নেই, চিন্তা শুধু মা মরা মেয়েকে নিয়ে। কীভাবে এই মেয়ে বড় হবে, কী হবে তার ভবিষ্যৎ- কিছুই জানেন না তিনি। 

শুক্রাবাদ পথশিশু ফাউন্ডেশন স্কুলের কল্যাণে কেজি শ্রেণিতে ভর্তি হলেও পরবর্তীতে করোনার হানায় বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। জেসমিন বলল, ‘আমি নিজের নাম লিখতে পারি, বাবার নাম লিখতে পারি। ক-খ পড়তে পারি। তবে এখন আর পড়াশোনা করি না। সময় কাটে ধুলাবালিতে। মাঝে মাঝে বস্তা নিয়ে বোতল কুড়াই।’

বড় হয়ে কি হতে চাও? এমন প্রশ্নের উত্তরে খানিকটা সময় ভেবেচিন্তে জেসমিন উত্তর দিল-‘আমার মায়ের কাছে যেতে চাই।’ অনাদরে ক্লিষ্ট এই শিশুর ভবিষ্যৎ সামাজিক নিরাপত্তা, জীবনমান উন্নয়নের দুশ্চিন্তায় প্রতি মুহূর্তেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সময় কাটান বাবা হারুন। বলেন, ‘পুনর্বাসনে যদি সরকারি সহযোগিতা পেতাম তাহলে কিছুটা নিশ্চিন্ত হতাম।’

আরএইচটি/আরএইচ