জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা উপকূলীয় অঞ্চলের ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে দুর্যোগের ঝুঁকি’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে এ কথা বলেন। 

বৃহস্পতিবার (৩ জুন) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ভার্চুয়াল জাতীয় সংলাপে মূল বক্তব্য উত্থাপন করেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘লিডার্স’ এর নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মণ্ডল।

মন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। যা ইতোমধ্যে বিশ্ববাসীর কাছে প্রশংসিত হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আরও পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিশেষ করে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনসহ উপকূলীয় জনপদের উন্নয়নে কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ঝুঁকি আমাদের অদম্য অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারবে না উল্লেখ করে পরিবেশ মন্ত্রী বলেন, সরকার জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাব্য প্রভাব নিরসনে সরকার ডেল্টা পরিকল্পনা-২১০০ নামে একশ বছরের কৌশল প্রণয়ন করেছে। সরকার উপকূল জুড়ে ৪ হাজার ২৯১ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। এছাড়া দেশের বন্যার ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে অতিরিক্ত ৫২৩টি বন্যার আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতর কর্তৃক এডাপটেশন ফান্ডের অর্থায়নে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র তীরবর্তী ছোট দ্বীপগুলোতে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ভূমিকা রাখবে।

সংলাপে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানছে। যে কারণে ওই অঞ্চলের মানুষ ঝুঁকিতে আছে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ দ্রুততার সঙ্গে চলছে। স্থানীয় জনগণের সহায়তায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বাঁধ সংস্কারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। 

তিনি আরও বলেন, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য গৃহীত মেগা প্রকল্পগুলো অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। যার মধ্যে খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের ৩ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকার তিনটি প্রকল্প চলতি সপ্তাহে একনেক বৈঠকে পাস হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অনুষ্ঠানে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. রুহুল হক এলাকার সব জনপ্রতিনিধিদের টেকসই বেড়ি বাঁধ তৈরিতে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানান কারণে নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। নদী ড্রেজিং করা যেমন জরুরি তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধের স্থায়ী বা টেকসই সংস্কার জরুরি। তিনি বেড়িবাঁধ তৈরিতে এলাকাবাসীর অভিজ্ঞতা, বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের ভূ-প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।

সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, স্বার্থান্বেষীমহল নিজেদের স্বার্থে ৬০’এর দশকে নির্মিত দুর্বল বেড়িবাঁধে পাইপ ঢুকিয়ে, বাঁধের পাশে পুকুর খননসহ বিভিন্নভাবে ক্ষতি করছে। যে কারণে ওই অঞ্চলের ঝুঁকি বেড়েছে। এই ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ডেল্টা প্লান বাস্তবায়ন জরুরি। তিনি নিয়মিত নদী খনন ও টিআরএমের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা রক্ষা এবং বেড়িবাঁধকে নিজেদের সম্পদ হিসেবে রক্ষার আহ্বান জানান।

টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ কিংবা সংস্কারের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার কথা উল্লেখ করেন সংসদ সদস্য গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার। তিনি বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষগুলো একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরেকটির কবলে পড়ে। বেড়িবাঁধ সংস্কারে প্রতিবছর অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে পর্যাপ্ত কাজ হলেও নানান কারণে টেকসই হচ্ছে না। এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয়তার পাশাপাশি এলাকাবাসীর সচেতনতা জরুরি।

মূল প্রবন্ধে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে জনজীবনে সংকট প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এরপর করোনা পরিস্থিতি ও গত বছরের সুপার সাইক্লোন আম্পান এই সংকট আরও বাড়িয়েছে। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে খুলনা-সাতক্ষীরার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ায় ওই অঞ্চলের জনগণের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। সংকট মোকাবিলায় সুন্দরবনের তীরবর্তী দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলকে দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করে ঝুঁকিতে থাকা বেড়িবাঁধগুলো সংস্কারের প্রয়োজন। বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জরুরি তহবিল গঠন ও বাঁধ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করতে হবে। উপকূলীয় জনগণের নিরাপদ খাবার পানির সমস্যার টেকসই ও স্থায়ী সমাধান এবং উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড গঠনের সুপারিশ করা হয়।

নাগরিক সংগঠন ‘সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন’ এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘লিডার্স’ আয়োজিত এই সংলাপ সঞ্চালনা করেন সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র। 

আলোচনায় অংশ নেন পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম, সাতক্ষীরা-৩ আসনের সংসদ সদস্য ডা. আ ফ ম রুহুল হক, খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান বাবু, সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরামের সভাপতি কাওসার রহমান, আন্তর্জাতিক সংস্থা কেএনএইচ জার্মানির মাটিলদা টিনা বৈদ্য, স্কাস চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা, সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ, কয়রা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নাসিমা আলম, বাগেরহাট সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান রিজিয়া পারভীন, সাতক্ষীরার গাবুরা থেকে প্রধান শিক্ষক ইয়াশমিনুর রহমান লিংকন প্রমুখ।

এইউএ/ওএফ