করোনার বছর কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৭২৯ শ্রমিকের মৃত্যু
বিলসের পর্যালোচনা সভা
• ৫৯৬ জন শ্রমিক নির্যাতনের শিকার
• শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে ৫৯৩টি
• বকেয়া বেতনের দাবিতে ১৭৬টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা
করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালে বেশির ভাগ সময়ই বন্ধ ছিলো শিল্প কারখানা। তারপরও বছরটিতে এসব কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৭২৯ জন শ্রমিক নিহত এবং ৪৩৩ জন আহত হয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
এদিকে গত বছর কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫৯৬ জন শ্রমিক, যাদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে ২৩২ জন এবং এর বাইরে ৩৬৪ জন। বছরটিতে বিভিন্ন সেক্টরে মোট ৫৯৩টি শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ২৬৪টি-ই পোশাক খাতে।
শনিবার (৯ জানুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বিলসের উদ্যোগে “বাংলাদেশের শ্রম ও কর্মক্ষেত্র পরিস্থিতি বিষয়ে সংবাদপত্র ভিত্তিক বিলস্ জরিপ ২০২০” শীর্ষক এক পর্যালোচনা সভায় এ চিত্র তুলে ধরা হয়।
বিজ্ঞাপন
জরিপের প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিলস্ উপ-পরিচালক মো. ইউসুফ আল মামুন।
২০২০ সালে কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিক
জরিপের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনায় যে ৭২৯ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে এদের মধ্যে ৭২৩ জন পুরুষ এবং ৬ জন নারী শ্রমিক। সবচেয়ে বেশি ৩৪৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় পরিবহন খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় নির্মাণ খাতে। তৃতীয় কৃষি খাতে ৬৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
এছাড়া ৪৯ জন দিনমজুর, বিদ্যুৎ খাতে ৩৫ জন, ২৭ জন মৎস্য শ্রমিক, স্টিল মিল শ্রমিক ১৫ জন, নৌ-পরিবহন শ্রমিক ১৫ জন, মেকানিক ১৪, অভিবাসী শ্রমিক ১৫ এবং ইট ভাটা, হকার, চাতাল, জাহাজ ভাঙাসহ অন্যান্য খাতগুলোতে ৬০ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন।
এর আগের বছর ২০১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় বিভিন্ন খাতে ১ হাজার ২০০ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে ১ হাজার ১৯৩ জন পুরুষ এবং ৭ জন নারী শ্রমিক। ওই বছর সবচেয়ে বেশি নিহতের ঘটনা ঘটে পরিবহন খাতে ৫১৬ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটে নির্মাণ খাতে ১৩৪ জন। তৃতীয় সর্বোচ্চ শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটে কৃষি খাতে ১১৬ জন।
২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিক
গত বছর কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৪৩৩ জন শ্রমিক আহত হয়। এদের মধ্যে ৩৮৭ জন পুরুষ এবং ৪৬ জন নারী শ্রমিক। মৎস্য খাতে সর্বোচ্চ ৬৮ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নির্মাণ খাতে আহত হন ৪৯ জন শ্রমিক। এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে ৪৮, পরিবহন খাতে ৪৭, জুতা কারখানায় ২০ জন, নৌ-পরিবহন খাতে ১৬, তৈরি পোশাক শিল্পে ৩৭, জাহাজ ভাঙা শিল্পে ২৯, দিনমজুর ১৬, উৎপাদন শিল্পে ১৯, স্টিল মিলে ১৯ ও কৃষিতে ১০ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন। এছাড়াও অন্যান্য খাতে আহত হয়েছেন ৪০ জন শ্রমিক।
২০১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় বিভিন্ন সেক্টরে ৬৯৫ জন শ্রমিক আহত হন, এদের মধ্যে ৬৭৮ জন পুরুষ এবং ১৭ জন নারী শ্রমিক রয়েছেন। মৎস্য খাতে সর্বোচ্চ ১৩২ জন শ্রমিক আহতের ঘটনা ঘটে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১৭ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন নির্মাণ খাতে। তৃতীয় সর্বোচ্চ শ্রমিক আহতের ঘটনা পরিবহন খাতে ১০৪ জন।
২০২০ সালে শ্রমিক নির্যাতন
সংবাদপত্র জরিপ অনুযায়ী ২০২০ সালে ৫৯৬ জন শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন। এদের মধ্যে ৩১৬ জন নিহত, ২২৯ জন আহত, ৮ জন নিখোঁজ, ২৪ জনের ক্ষেত্রে আত্মহত্যা, অপহৃত ১৪ জনকে উদ্ধার এবং ৫ জনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের ধরণ উল্লেখ করা হয়নি। নির্যাতিতদের মধ্যে ৪৫৪ জন পুরুষ এবং ১৪২ জন নারী শ্রমিক। এদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে ২৩২ জন, কর্মক্ষেত্রের বাহিরে ৩৬৪ জন শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
সবচেয়ে বেশি ১০৯ জন শ্রমিক হতাহতের ঘটনা ঘটে পরিবহন খাতে। যাদের মধ্যে ৯০ জন নিহত, ১৩ জন আহত, ৪ জন শ্রমিক আত্মহত্যা করেন এবং অপহৃত দুজন শ্রমিককে হাত পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭৮ জন শ্রমিক হতাহত হন তৈরি পোশাক শিল্পে। এদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে ৩ জন (১ জন নিহত ও ২ জন আহত) এবং কর্মক্ষেত্রের বাইরে বাকি ৭৫ জন নির্যাতিত হন। এই সারিতে ২৫ জন নিহত, ৪৮ জন আহত, ১ জন নিখোঁজ, ৩ জন শ্রমিক আত্মহত্যা করেন এবং ১ জনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের ধরণ উল্লেখ করা হয়নি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভিবাসী খাতে ৬৫ জন শ্রমিক হতাহত হয়েছেন। এরমধ্যে ৫২ জন নিহত, ১১ জন আহত, ১ জন নিখোঁজ এবং ১ জনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের ধরণ উল্লেখ করা হয়নি। নির্মাণ খাতে ৬৩ জন শ্রমিক হতাহত হন। এদের মধ্যে ৮ জন নিহত, ৫২ জন আহত এবং ৩ জন শ্রমিক আত্মহত্যা করেন। কৃষি খাতে ৫৮ জন শ্রমিক হতাহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৪২ জন নিহত, ১১ জন আহত, ১ জন নিখোঁজ, ৩ জন আত্মহত্যা এবং ১ জন অপহৃত শ্রমিককে উদ্ধার করা হয়। গৃহশ্রমিক খাতে হতাহতের সংখ্যা ৪৪ জন শ্রমিক। এদের মধ্যে ১৬ জন নিহত, ২৩ জন আহত, ৪ জন আত্মহত্যা করে এবং ১ জনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের ধরণ উল্লেখ করা হয়নি।
২০১৯ সালে নির্যাতনের শিকার হন ১ হাজার ২৯২ জন শ্রমিক। তাদের মধ্যে খুন বা হত্যার শিকার হন ৩৩২ জন শ্রমিক, আহত ৮১০ জন, ৬৭ জন নিখোঁজ, ২৬ জন আত্মহত্যা এবং ৫৭ জনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের ধরণ উল্লেখ করা হয়নি। তার আগের বছর ২০১৮ সালে নির্যাতনে ৭৬৪ জন শ্রমিক হতাহতের ঘটনা ঘটে। এই সংখ্যায় ২৭৯ শ্রমিক খুন বা হত্যার শিকার হন। নির্যাতনে আহতের সংখ্যা ২৬৩, নিখোঁজ ১৭০ জন শ্রমিক এবং ৩১ জন শ্রমিক আত্মহত্যা করেন।
২০২০ সালে শ্রমিক আন্দোলন
২০২০ সালে বিভিন্ন সেক্টরে সবমিলিয়ে ৫৯৩টি শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা ঘটে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৬৪টি শ্রমিক আন্দোলন হয় তৈরি পোশাক খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৯টি আন্দোলনের ঘটনা ঘটে পাট শিল্পে। এছাড়া চিনি শিল্পে ৪৬টি, পরিবহন খাতে ৪৫টি, কৃষি খাতে ২৩টি, নৌ-পরিবহন খাতে ১৯টি, গণমাধ্যমে ১৮টি, অভিবাসী শ্রমিক ১৮টি, সরকারি কর্মচারী ১৫টি, স্বাস্থ্য খাতে ১৫টি, বিড়ি শিল্পে ১৩টি এবং অন্যান্য সেক্টরে ৬৮টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে।
এর আগের বছর ২০১৯ সালে বিভিন্ন খাতে সবমিলিয়ে ৪৩৪টি শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে বেশি ১৩৪টি আন্দোলন হয়েছিল তৈরি পোশাক খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬৮টি শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা ঘটে পাট শিল্পে। এছাড়া পরিবহন খাতে ঘটে ৬১টি, গণমাধ্যমে ২৬টি, কৃষিতে ১৮টি, হকার ১৭টি, নৌ পরিবহন খাতে ১৫টি, শিক্ষা খাতে ১১টি, চা শিল্প এবং সিটি কর্পোরেশনে ৯টি এবং অন্যান্য সেক্টরে ৬৬টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে।
আন্দোলন করতে গিয়ে এ সময় ৯৯ জন শ্রমিক আহত হন। আহতদের মধ্যে ৬৪ জন পুরুষ এবং ৩৫ জন নারী শ্রমিক। সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক শিল্পে ৫৪ জন শ্রমিক আহত হয়েছিলেন। এছাড়া স্পিনিং মিলে ৩১ জন, পাট শিল্পে ১২ এবং চা শিল্পে ২ জন শ্রমিক আহত হন।
জরিপ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৭৬টি শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা ঘটে বকেয়া বেতনের দাবিতে। এছাড়াও, দাবি আদায়ে ১৩৮টি, অধিকার আদায়ে ১১৫টি, বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে ৪৫টি, বোনাসের দাবিতে ৩৪টি, লে-অফের কারণে ৩০টি, ভাতার দাবিতে ২৯টি এবং অন্যান্য দাবিতে ২৬টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে।
সংবাদ সম্মেলনে বিলস্ ভাইস চেয়ারম্যান শিরীন আখতার, বিলস্ নির্বাহী পরিষদ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, বিলস্ ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসাইন এবং আমিরুল হক আমিন, বিলস্ উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য নইমুল আহসান জুয়েল, নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাকিল আখতার চৌধুরী, ডিইউজে সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ, বাংলাদেশ লেবার রাইটস জার্নালিস্ট ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এনএম/এইচএন/এমএইচএস