চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে দেশের ইতিহাসে প্রথম টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। টানেলের নামকরণ করা হয়েছে ’বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। করোনা মহামারির এই সময়েও পতেঙ্গা ও আনোয়ারায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের কাজ চলছে পুরোদমে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। 

চট্টগ্রামের বৃহৎ এ প্রকল্পের এখন পর্যন্ত ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে। টানেল নির্মাণ কাজ শেষ হলে কর্ণফুলী নদীর আনোয়ারা অংশে অর্থাৎ দক্ষিণ চট্টগ্রামে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান, ইকোনমিক জোন গড়ে উঠবে বলে আশাবাদ এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই টানেল দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

কাজের অগ্রগতির বিষয়ে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত প্রকল্পটির ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু করোনার কারণে কাজে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। এরপরও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টানেলের কাজ শেষ করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সময় তো এখনও অনেক আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘টানেল বস্তবায়ন শেষ হলে এটি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। চট্টগ্রামের দক্ষিণ অংশে অর্থাৎ আনেয়ারা অংশে শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে।’

টানেল সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পটি বাংলাদেশ ও চীন সরকারের (জি টু জি) যৌথ অর্থায়নে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা আর চীন সরকারের ঋণ পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। 

২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী ‘টানেল বোরিং’ কাজের উদ্বোধন করেন। দেশে প্রথমবারের মতো নির্মাণাধীন এ টানেলের চট্টগ্রাম নগরীর প্রান্তের কাজ শুরু পতেঙ্গা নেভাল একাডেমির পাশ থেকে। এটি কাফকো ও সিইউএফএল সীমানার মাঝখান দিয়ে উঠে কর্ণফুলী-আনোয়ারা প্রান্তে সংযোগ ঘটাবে। 

টানেল সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক দশমিক ৩১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেন থাকবে। মূল টানেলের সঙ্গে নদীর দুই প্রান্তে মোট ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযুক্ত সড়ক থাকবে। এছাড়াও ৭২৭ মিটার দীর্ঘ একটি ফ্লাইওভার আছে আনোয়ারা অংশে। 

টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ বলেন, ‘নগরীর পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে শুরু হওয়া প্রথম টিউবের কাজ গত বছরের দুই আগস্ট শেষ হয়েছে। নদীর আনোয়ারা প্রান্ত থেকে টিউবের কাজ শুরু হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরে। ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দ্বিতীয় টিউবটির কাজ এখন পর্যন্ত শেষ হয়েছে ১ হাজার ৭৯০ মিটার।

তিনি বলেন, টানেলের পতেঙ্গা এবং আনোয়ারা অংশের সংযোগ সড়ক এবং আনোয়ারা অংশে ওভারব্রিজের কাজও এগিয়ে চলছে। সব মিলিয়ে টানেলের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।’

টানেলের কাজ শেষ হলে চীনের সাংহাইয়ের আদলে চট্টগ্রামে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক। 

ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের পরিকল্পনার পর নতুন নতুন কারখানা স্থাপন করা হচ্ছে আনোয়ারা অংশে। অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। টানেল নির্মাণ শেষ হলে শুধু আনোয়ারা নয়, বাঁশখালী থেকে কক্সবাজারে পর্যন্ত বিনিয়োগের বিশাল সম্ভবনা তৈরি হবে। যোগাযোগ সুবিধার কারণে শিল্পকারখানার কাঁচামাল যেমন সহজে আনা নেওয়া করা যাবে, তেমনি এখানকার উৎপাদিত পণ্য সারা দেশে সহজে আনা নেওয়া করা যাবে টানেল ব্যবহার করে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, টানেলের সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ারা অংশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে। বিশেষ করে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ যেসব সুযোগ সুবিধা দরকার তা দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে।

বিজিএমইএ এর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, 'টানেলের কারণে চট্টগ্রামের আনোয়ারা অংশে বিনিয়োগের জন্য ভালো হবে। সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। এতে করে অনেকের কর্মসংস্থান হবে। যা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।'

তিনি বলেন, 'শিল্পকারখানা স্থাপনের আগে যোগাযোগ ব্যবস্থার চিন্তা করা হয়। আনোয়ারা অংশে শিল্পকারখানা স্থাপন করলে টানেল ব্যবহার করে সহজেই শিল্প কারখানার কাঁচামাল আনা-নেওয়া এবং প্রস্তুত পণ্য সারা দেশে সহজে পরিবহন করা যাবে। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে যোগাযোগও করা যাবে সহজে। ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে এখন নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে কোনো বাধা থাকবে না।'

তিনি আরও বলেন, 'সরকার একটি পরিকল্পনা করেই চট্টগ্রামে এতে বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি হলে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন হয়। টানেলের মাধ্যমে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নয়ন হবে। সেই কারণে দক্ষিণ চট্টগ্রামে যে বিশাল জায়গা আছে তা কাজে লাগানো যাবে। সেখানে শিল্প জোন গড়ে উঠবে। আমরা জেনেছি জাপান এবং চীন দক্ষিণ চট্টগ্রাম শিল্প জোন স্থাপন করার জন্য সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। শিল্প কারখানা হলে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।'

বিজিএমইএর এই নেতা আরও বলেন, 'দক্ষিণ চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ-গ্যাসের সুবিধা ও ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করতে হবে। তাহলেই টানেলকে কেন্দ্র করে যেসব শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে।'

চট্টগ্রাম চেম্বারের সহ-সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, 'নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হলে আমাদের জন্য ভালো। সরকার চট্টগ্রাম উন্নয়নের ব্যাপারে অনেক আন্তরিক। টানেল কাজ শেষ হলে এর সুফল পুরো দেশ পাবে। দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।'

তিনি আরও বলেন, 'টানেল বাস্তবায়ন হচ্ছে, কাজও শেষ পর্যায়ে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও ভালো না হলে টানেলের পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাবে না। টানেলের অংশ হিসেবে আনোয়ারা রাস্তাঘাটও উন্নয়ন করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে কক্সবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে সরকার রেললাইন স্থাপনসহ যে কার্যক্রম চালচ্ছে তার খুবই ভালো উদ্যোগ। দক্ষিণ  চট্টগ্রামকে শিল্পাঞ্চল হিসেবে উন্নয়ন করার জন্যই এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে মনে করি। টানেল নির্মাণ ছিল বর্তমান সরকারের সময়োপযোগী ও সূদুর প্রসারী চিন্তা।’

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, টানেল নির্মাণের জন্য চাইনিজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিসিসিসি লিমিটেড ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের মধ্যে ২০১৫ সালের ৩০ জুন বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরে বাংলাদেশ সরকার (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) ও চীন সরকারের (দ্য এক্সিম ব্যাংক অব চায়না) মধ্যে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর ঋণ চুক্তি কার্যকর হয়। আর ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী ‘টানেলের নির্মাণ’ কাজের উদ্বোধন করেন। 

প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৩৮২ দশমিক ৮২১ একর ভূমির মধ্যে ৩৬২ দশমিক ৩২২১ একরের অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে। অবশিষ্ট ১৯ দশমিক ৭৬ একর ভূমিও দ্রত অধিগ্রহণ করার প্রক্রিয়া চলছে।  

কেএম/এসএম