রাজধানীতে বসে বনের জীবন্ত প্রাণী দেখার বিনোদনের একমাত্র জায়গা জাতীয় চিড়িয়াখানা। এই চিড়িয়াখানায় স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে যুক্ত হতে যাচ্ছে ‘ট্রাভেল কার’। কর্তৃপক্ষ বলছে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দর্শনার্থীদের জন্য এটা তাদের উপহার। 
 
জাতীয় চিড়িয়াখানায় বর্তমানে রয়েছে প্রায় ১৩৫ প্রজাতির ২৯০০ এর মতো প্রাণী। ধীরে ধীরে ৭১ বছরের এই পুরনো জাতীয় চিড়িয়াখানার বিভিন্ন অবকাঠামো আধুনিকায়ন করা হলেও সামনে আসছে এক বিরাট পরিবর্তন, তৈরি হচ্ছে ‘মহাপরিকল্পনা’।

চিড়িয়াখানার বর্তমান অবস্থা 
করোনার মহামারিতে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে গত ১ নভেম্বর খুলেছে জাতীয় চিড়িয়াখানা। আর এতে করে সংরক্ষিত প্রাণীদের আবারও কাছ থেকে দেখার সুযোগ মিলছে দর্শনার্থীদের। দর্শনার্থী ফিরতে শুরু করায় বদলে গেছে সেখানকার চিত্রও। করোনায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর চিড়িয়াখানায় জমেছিল শ্যাওলা। তবে এখন আর সেখানে নেই শ্যাওলা। নেই কোনো চিপসের প্যাকেট ও অন্যান্য ময়লা। কিছু সময় পরপরই পরিছন্নতাকর্মীদের রাস্তাসহ আশপাশের জায়গা পরিষ্কার করতে দেখা গেছে। পরিষ্কার করা হয়েছে বিশ্রামাগারও। দর্শনার্থীদের জন্য চিড়িয়াখানায় স্থাপন করা হয়েছে ১২টি সুপেয় খাবার পানির ট্যাংক। খাবারের জন্য দুটো ক্যান্টিন খোলা হয়েছে, যেখান থেকে দর্শনার্থীরা নায্যমূল্যে খাবার কিনতে পারবেন।

তবে গুচ্ছ দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য নির্মিত আলাদা দুটি পিকনিক স্পট বন্ধ রয়েছে। কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করেছে, যারা পিকনিক স্পট ভাড়া নেন, তারা সেখানে উচ্চ শব্দে গান বাজনা শোনেন। ফলে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের সমস্যা হয়। এছাড়া স্পট দুটি লেকের পাশে হওয়ায় তারা বিভিন্ন ময়লা লেকের পানিতে ফেলে পানি দূষণ করেন। সার্বিক বিবেচনায় এটি এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

হকারমুক্ত পরিবেশে সন্তুষ্ট দর্শনার্থীরা 
গেল মাসের শেষ দিকে জাতীয় চিড়িয়াখানা ঘুরে কোনো হকারকে দেখা যায়নি। আর এমন পরিবেশে সন্তুষ্ট প্রকাশ করেছেন দর্শনার্থীরা। তবে এখনও কোনো অপরিচিত মানুষের ডাকে সাড়া দিতে আগ্রহবোধ করে না কেউই। দর্শনার্থীরা এখনও ভিতচিত্তে থাকেন, কার ডাকে সাড়া দিয়ে কী ঝামেলায় জড়াতে হয়। তাই, যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা যায় সেভাবেই চলেন তারা।

কিন্তু তারপরেও চিড়িয়াখানার পাবলিক টয়লেটগুলোর সামনে কিছু ছোট টেবিলে সিগারেট ও অন্যান্য পণ্য বিক্রি করতে দেখা গেছে। তারা নিজেরাই জানিয়েছেন, তাদের দোকান অবৈধ। 

হকারদের দাপট আগের চেয়ে কমলেও এখনও বিক্রি হচ্ছে সিগারেট

চিড়িয়াখানায় সপরিবারে ঘুরতে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এ তাহার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘চিড়িয়াখানা এখন আগের চেয়ে অনেক নিরাপদ মনে হয়েছে। কোনো হকারের উপদ্রব নেই।’

পুলিশ সদস্য জসিম উদ্দিন বলেন, ‘চিড়িয়াখানার পরিবেশ এখন ঠিক আছে। কিন্তু করোনা পরবর্তী টিকিটের মূল্যটা বেশি মনে হচ্ছে। আগের মূল্যই ঠিক ছিল।’

করোনার ২৮০ দিনে চিড়িয়াখানায় জন্ম ১১৫ প্রাণী 
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত ২৬ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালের বন্ধ ঘোষণা করা হয় জাতীয় চিড়িয়াখানা। তার ২৮০ দিন পর ১ নভেম্বর সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয় জাতীয় চিড়িয়াখানা। বন্ধের এই সময়টাতে চিড়িয়াখানার প্রাণীরা ছিল দর্শনার্থীদের জ্বালাতন থেকে মুক্ত। একেবার নিজেদের মতো করে সময় কাটানোর একটা সুযোগ পেয়েছিল তারা। এ সময় নিশ্চিত করা হয়েছে তাদের খাবারের মান। রোগপ্রতিরোগ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তাদের ইমিউনিটি সিস্টেমের দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। আর এই সময়ে চিড়িয়াখানায় নতুন অতিথি হয়ে জন্ম নিয়েছে ১১৫ প্রাণী। 

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত ২৬ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালের বন্ধ ঘোষণা করা হয় জাতীয় চিড়িয়াখানা

১ নভেম্বর সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয় জাতীয় চিড়িয়াখানা

বন্ধের সময়টাতে চিড়িয়াখানার প্রাণীরা ছিল দর্শনার্থীদের জ্বালাতন থেকে মুক্ত

নতুন জন্ম নেওয়া প্রাণীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- জিরাফ, ইম্পালা, কমন ইলেন, জলহস্তী, চিত্রা হরিণ, ময়ূর, ময়না ও টিয়া। এছাড়া ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত চিড়িয়াখানায় মোট জন্মেছে ১২৬ প্রাণি। তবে ২০২০ সালে চিড়িয়াখানা থেকে চিরবিদায় নিয়েছে ৪/৫ প্রাণী। তাদের আয়ুষ্কাল শেষ বা স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

ট্রাভেল কারে বসে দেখা যাবে পুরো চিড়িয়াখানা 
আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ৫০ বছরে পা দেবে বাংলাদেশ। এ উপলক্ষে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তার ধারাবাহিকতায় আগামী এক বছরের মধ্যে চিড়িয়াখানায় যুক্ত হচ্ছে ট্রাভেল কার। একটি পুরো পরিবার একসঙ্গে বা প্রতিবন্ধী মানুষরাও যেন পুরো চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখতে পারেন, সেই চিন্তা থেকেই নতুন এই সংযোজনটি আনতে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া থাকছে রোকওয়ে, লেকে প্যাডেল সিস্টেম নৌকার ব্যবস্থা, শিশুপার্কে থাকবে ইলেকট্রিক ট্রেন, মেরি গো রাউন্ডসহ আরও তিন-চারটি আইটেম। একইসঙ্গে প্রাণী যাদুঘর ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা হচ্ছে এবং নতুন নতুন আরও প্রজাতির প্রাণী অ্যাকুরিয়ামে স্থাপন করা হবে।

যা থাকছে ‘মহাপরিকল্পনায়’ 
আগামী ২০৪১ সালে উন্নত বিশ্বে পদার্পণ করবে বাংলাদেশ। তার ধারাবাহিকতায় জাতীয় চিড়িয়াখানা যেন পিছিয়ে না পড়ে সেজন্য চিড়িয়াখানাকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে এক মহাপরিকল্পনা। তা বাস্তবায়ন হলে চিড়িয়াখানা হবে আধুনিক ও আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত। চিড়িয়াখানা হবে জোনভিত্তিক। প্রতিটি সেক্টরের জন্য আলাদা আধুনিক জোন তৈরি করা হবে। যেমন- সুন্দরবনকেন্দ্রিক জোন, নাইট সাফারি পার্ক (সিঙ্গাপুরের আদলে)। একই সঙ্গে লেক দুটোকে করা হবে আধুনিক। সেখানে ডলফিন রাখার পরিকল্পনাও রয়েছে কর্তৃপক্ষের।

আগামী এক বছরের মধ্যে চিড়িয়াখানায় যুক্ত হচ্ছে ট্রাভেল কার

চিড়িয়াখানা হবে জোনভিত্তিক। প্রতিটি সেক্টরের জন্য আলাদা আধুনিক জোন তৈরি করা হবে

লেকে ডলফিন রাখারও পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের

সার্বিক বিষয় নিয়ে জাতীয় চিড়িয়াখানার কিউরেটর ডা. মো. আব্দুল লতীফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি যখন জাতীয় চিড়িয়াখানায় যোগদান করেছি তখন কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবে চিড়িয়াখানা বন্ধ ছিল। সরকারি নির্দেশনায় এটা আমরা পহেলা নভেম্বর থেকে খুলে দিয়েছি। কিন্তু সেটা কিছু শর্তসাপেক্ষে। আমি এখানে আসার পর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায়। দর্শনার্থীদের ইতোমধ্যে বিষয়টা খুবই পছন্দ হয়েছে। একই সঙ্গে প্রাণীদের সঠিক খাবার মান নিশ্চিত করেছি। আর সকলের সহযোগীতায় শতভাগ হকার মুক্ত করেছি’।

টয়লেটের সামনে দোকান বসানো ও টিকিটের দাম নিয়ে জানতে চাইলে কিউরেটর বলেন, ‘আমরা যাদের কাছে টয়লেট ইজারা দিয়েছি, তারা স্থানীয়দের দিয়ে প্রভাব খাঁটিয়ে এটা করতে পারে। তবে আমরা যখন পর্যবেক্ষণে যাই তখন তারা হয়তো সরিয়ে ফেলে, তাই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারিনা। তবে এখন বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গে দেখবো। আর দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে আরও টয়লেট প্রস্তুত করা হয়েছে। যা আগামী জুন মাসে চালু করা হবে। তখন চিড়িয়াখানায় মোট টয়লেটের সংখ্যা দাঁড়াবে ৬টিতে।

টিকিটের দামের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দামটা নির্ধারণ করে উপদেষ্টা পরিষদ। আমাদের করার কিছু থাকে না। এ বছর দাম ৫০ টাকা নির্ধারণ করেছে ঠিকই, তবে একটা চমকও রেখেছে। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রতিমাসের প্রথম রোববার সকলের জন্য টিকিট ফ্রি করা হয়েছে। যা এ বছর ১৬ মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।’

দর্শনার্থী ফিরতে শুরু করায় বদলে গেছে চিড়িয়াখানার চিত্র

গেল মাসের শেষ দিকে জাতীয় চিড়িয়াখানা ঘুরে কোনো হকারকে দেখা যায়নি। আর এমন পরিবেশে সন্তুষ্ট প্রকাশ করেছেন দর্শনার্থীরা।

তিনি আরও বলেন, ‘চিড়িয়াখানার উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। ২০৪১ সালে আমরা ‘ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডে’ পদার্পণ করব। এর ধারাবাহিকতায় এই চিড়িয়াখানা নিয়ে মহাপরিকল্পনা হচ্ছে। যার কাজ ইতোমধ্যে ৪৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। আশা করছি এ বছর জুন মাসের ৩১ তারিখ আমরা মহাপরিকল্পনাটা হাতে পাবো। এরপরই এটা বাস্তবায়নে যাবো। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে পুরো চিড়িয়াখানার চেহারাটাই বদলে যাবে।’

ডা. মো. আব্দুল লতীফ বলেন, ‘অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে বর্তমানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের গতি বাড়িয়ে দিয়েছি। প্রাণিগুলোর প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে, মানসম্মত খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে এবং তাদের ব্যালেন্স ডায়েট নিশ্চিত করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, যারা আমাদের এই খাবারগুলো সাপ্লাই দিয়ে থাকে তাদের কাছ থেকে নিয়ে এবং প্রি-ইন্সপেকশন করে প্রাণীদের খাবার দেওয়া পর্যন্ত আমাদের কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত থাকেন। আমাদের এখানে এখনও ৭০-৮০টি পদ খালি আছে। যদি এগুলো পূরণ করা যায় তবে কাজে আরও গতি আসবে’।

এমএইচএন/এনএফ