বদলে যাচ্ছে রামপুরা খালের চিত্র
রামপুরা খাল
কিছুদিন আগেও রামপুরা ব্রিজ থেকে বনশ্রী প্রধান সড়ক ধরে এগোতে থাকলে রামপুরা খালে ময়লা ছাড়া কিছুই চোখে পড়ত না। দুই পাড় ছিল আবর্জনায় ভরা। বলতে গেলে পুরো পাড়ই ছিল ময়লার ভাগাড়। সেই সঙ্গে দুর্গন্ধ আর কচুরিপানায় অতিষ্ঠ হতে হতো পথচারীদের। কিন্তু সেই পরিস্থিতি এখন পাল্টে গেছে।
পরিচ্ছন্ন আর পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে পুরো খালটি পরিষ্কার করা হয়েছে। ঢালাই করে বাঁধানোর কাজ চলছে খাল পাড়। তার ঠিক পাশেই মাটি ফেলে তৈরি করা হচ্ছে ওয়াকওয়ে। আগেই নির্মাণ করা ফুটপাতের পাশে বসানো হচ্ছে সিমেন্টের রেলিং। চলছে সৌন্দর্যবর্ধনের নানা কাজ। সব মিলিয়ে বদলে যাচ্ছে রামপুরা খালের রূপ।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, সংস্কারের পাশাপাশি রামপুরা খালের দুই পাশের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করছে ঢাকা ওয়াসা। খালের রূপ ফিরিয়ে আনতে অনেক আগেই এই প্রকল্প হাতে নেয় ঢাকা ওয়াসা। প্রথমে দীর্ঘ দিন ধরে খাল পরিষ্কার, পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে বর্জ্য অপসারণ করা হয়। এরপর বর্তমানে খালের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলমান রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি রামপুরা খাল সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, খাল থেকে বর্জ্য অপসারণের পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিশেষ গাড়ির মাধ্যমে দুই পাড়ে মাটি দিয়ে উঁচু করে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি খাল পাড়ের রামপুরা অংশ থেকে বনশ্রীর কিছু অংশে ইতোমধ্যে সিমেন্ট ঢালাই করার কাজ হয়ে গেছে। আগেই নির্মাণ করা ফুটপাতের পাশে বসেছে ঢালাই রেলিং। রেলিংয়ের কিছু অংশ নির্মাণকাজ শেষে চলছে রং করার কাজ। বেশ কিছু শ্রমিকরা কাজ করছেন এখানে।
কাজে অংশ নেওয়া নির্মাণ শ্রমিক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমার জানা মতে বেশ কয়জন ঠিকাদার এখানে কাজে অংশ নিয়েছেন। আমরা এখানে এখন পাড় ঢালাইয়ের কাজ করছি। সামনের অংশে চলছে ফুটপাত সংলগ্ন রেলিং নির্মাণের কাজ। পাশাপাশি কিছু অংশে রং করারও কাজ চলছে। নিচের দিকে মাটি ফেলে তৈরি করা হচ্ছে ওয়াকওয়ে। আমাদের কাজগুলো শেষ হলে এখানে গাছ লাগানোসহ সৌন্দর্য্যবর্ধনের কাজ হবে। সব কাজ শেষ হলে এটা দেখতে আরেকটা হাতিরঝিলের মতো লাগবে।
অন্যদিকে ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, আগের প্রকল্পের পদক্ষেপ অনুযায়ী জলবদ্ধতা নিরসনে ১৫টি খালের ২০ কিলোমিটার ও ৩শ’ কিলোমিটার স্টর্ম ওয়াটার পাইপ ড্রেন পরিষ্কার করছে তারা। এছাড়া চারটি স্থায়ী ও ১৫টি অস্থায়ী পাম্পের মাধ্যমে পানি অপসারণ পরিকল্পনাও ছিল সংস্থাটির। এরই অংশ হিসেবে তারা রামপুরা খাল পরিষ্কার করেছে।
ঢাকা ওয়াসার পরিচালক (কারিগরি) এ কে এম সহিদ উদ্দিন বলেন, ওয়াসার ৩৭০ কিলোমিটার পাইপ ড্রেন, ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট, চারটি স্থায়ী পাম্পিং স্টেশন এবং ১৬টি অস্থায়ী পাম্পিং স্টেশন আছে। আমরা আমাদের দায়িত্বের জায়গা থেকে চেষ্টা করেছি জলবদ্ধতা নিরসনে কাজ করতে।
এলকাবাসী যা বলছেন:
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, নড়াই নদের উন্মুক্ত অংশের দৈর্ঘ্য ৫ কিলোমিটার। রামপুরা ব্রিজ থেকে বনশ্রী মেরাদিয়া হয়ে এটি সোজা পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়েছে। মিশেছে কায়েতপাড়ায় গিয়ে বালু নদীর সঙ্গে। সরকারি কাগজপত্রে কোথাও এ খালকে বেগুনবাড়ি খাল, কোথাও হাতিরঝিল, কোথায় আবার রামপুরা খাল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বনশ্রীর বাসিন্দা শাহিনুর রহমান রামপুরা খাল বিষয়ে নিজের অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, আগে এই খাল ময়লার ভাগাড় ছিল। এই পথ দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় নাকে বাজে গন্ধ আসতো। তবে এখন এই খালের চিত্রে পরিবর্তন করে দেওয়ার লক্ষ্যে উন্নয়নকাজ চলছে। কাজের বেশ কিছু অংশ এখন দৃশ্যমান হয়েছে। তবে আমরা চাই এই পথে নৌকা চলুক হাতিরঝিলের মতো করে। এছাড়া সামনে একটা হাট বসে। ভালোভাবে নৌকা চলাচল করলে হাটে আসা মানুষের উপকার হবে। পাশাপাশি এই পথে নতুন বাহনে চলাচলে সাধারণ মানুষ উপকৃত এবং আনন্দিত হবে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের চাকরিজীবী এবং বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা সাজ্জাত হোসেন বলেন, আমি একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করি, রামপুরা শাখায়। কাছেই অফিস হওয়ায় এই পথে আমি প্রতিদিন হেঁটে অফিস করি। এছাড়া ভোরে হাঁটতে বের হই। রামপুরা খালের পাশে দিয়ে এত সুন্দর পরিবেশ, হেঁটে যাওয়ার সুন্দর পরিস্থিতি তৈরি হতে যাওয়ায় সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানাই। পাশাপাশি দাবি জানাতে চাই, এখানে যেন একটা নৌপথ সৃষ্টি করা হয়। যাতে হাতিরঝিলের মতো এখানেও যাতাযাতে নতুন মাত্রা যোগ হয়।
স্থানীয়রা জানান, আশির দশকের শুরুর দিকে এই খাল হয়ে বর্তমান হাতিরঝিল দিয়ে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত নৌপথ চালু ছিল। তখন এ খাল দিয়ে হাতিরঝিল হয়ে নৌপথে কাঁচামালসহ অন্যান্য মালামাল কারওয়ান বাজারে যেত। বিজিএমইএ ভবনের পাশে মাছের পাইকারি বাজারটিতে একসময় শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদীর মাছ এনে নামানো হতো।
খালের সামনে গ্রামীণ আবহের হাট:
গ্রামগঞ্জে সাপ্তাহিক হাটের সঙ্গে সবাই পরিচিত। নির্দিষ্ট দিনে মাছ, মাংস থেকে শুরু করে শাক-সবজি, খাবার-দাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, এমনকি খেলনাসহ শত শত পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। হাটে কেনাকাটা করতে দূর-দূরান্ত থেকে আসে মানুষ। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে সরগম হয়ে ওঠে পুরো হাট।
ইট-পাথরের নগরজীবনে সাপ্তাহিক হাটের বিষয়টি অনেকের কাছেই অপরিচিত। তবে ঢাকার পূর্বাঞ্চলে যারা বাস করেন, তাদের অনেকেই এই সাপ্তাহিক হাটের সঙ্গে পরিচিত। নগর জীবনে তাদের এই গ্রামীণ হাটের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত করে রেখেছে শত বছরের পুরোনো মেরাদিয়া হাট। অনেকে এই হাটকে বলেন ‘মেরাইদ্দা হাট’। প্রতি বুধবার বসে এই হাট। রামপুরা ব্রিজ থেকে খাল পাড় ধরে সামনে এগুলেই বনশ্রীর পরেই বসে এই ঐতিহ্যবাহী হাটটি।
জানা যায়, রাজধানীর বনশ্রী সংলগ্ন এই হাটে দীর্ঘকাল থেকেই রাজধানীর আশপাশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ কেনাবেচা করে আসছেন। হাটের দিন সড়ক বা নৌপথে ক্রেতা-বিক্রেতারা আসছেন এখানে। হাটের দিন নড়াই নদীর বা রামপুরা খাল পাড়ে এসে অনেক নৌকা ভিড়ত আগে। এখনো নৌকা আসে, তবে সে সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে।
খাল রক্ষায় নদীপ্রেমীদের আহ্বান:
রামপুরা খালের একটু সামনে প্রতীকী নৌকা ভাসিয়ে দখল ও দূষণে হারাতে বসা নড়াই নদ রক্ষার আহ্বান জানিয়েছে একদল নদীপ্রেমী। সম্প্রতি রাজধানীর বনশ্রীর মেরাদিয়া হাটের পাশে নড়াই নদের পাড়ে নোঙর, নদী রক্ষা জোট, নিরাপদ পানি আন্দোলন ও রিভার জাস্টিসের কর্মীরা নদ রক্ষার অহ্বান জানাতে এই কর্মসূচি পালন করেন।
নোঙরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুমন শামস বলেন, রামপুরা খাল একসময় ছিল নড়াই নদ। মেরাদিয়া বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত নড়াই নদে দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। রাজধানীর ৪৭ খালের ২৬টির অস্তিত্ব এখনও কিছুটা আছে। এগুলো আমাদের রক্ষা করে প্রসারে কাজ করতে হবে।
ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব এখন দুই সিটি করপোরেশনের:
গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব (খাল ও ড্রেনেজ) আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ফলে এখন থেকে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের পুরো দায়িত্ব পেয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। আগে এ দায়িত্বের সিংহভাগ পালন করত ঢাকা ওয়াসা।
সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ১৯৮৮ সালের আগে ঢাকার খালগুলো তদারকি করত তৎকালীন ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওই খালগুলো ওয়াসার কাছে গেল তার সঠিক কারণ জানা যায়নি। তাই এতদিন খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণে অনেকটা সমন্বয়হীনতা ছিল। এখন ঢাকার ২৬টি খাল ওয়াসার কাছ থেকে ডিএনসিসি এবং ডিএসসিসিকে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ওই দুটি সংস্থা করবে। এতে নগরে আর জলাবদ্ধতা হবে না।
এএসএস/এইচকে