নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সাধারণ পরিষদের ৬৯তম অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ভাইস প্রেসেডেন্ট জো বাইডেন  

মহামারিতে টালমাটাল সময়ে নতুন দিশার স্বপ্ন দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসেছেন জো বাইডেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই উত্তরসূরিই আগামী চারবছর নেতৃত্ব দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কার্যত এই সময়ে কেন্দ্রে থাকবেন বিশ্ব রাজনীতির।      

বিশ্ব রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই বাকবদলে বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও নতুন করে খুলছে পাওয়া-না পাওয়ার হিসাবখাতা। খেপাটে বলে পরিচিতি পাওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে যা পাওয়া গেছে, ঢাকার প্রত্যাশা এবার স্বাভাবিকভাবেই তার চেয়ে বেশি কিছু।

কিন্তু সরকার বদল হলেও যুক্তরাষ্ট্রের চালকের আসনে থাকাদের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে খুব একটা পরিবর্তন না আসার অতীত অভিজ্ঞতায় ওয়াশিংটন থেকে ঢাকা বাড়তি কী সুবিধা পেতে পারে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন। তবে আশা জাগানিয়া বিষয় হচ্ছে- ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন নতুন প্রেসিডেন্ট। এতে দেশটির অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কিছু সুবিধা পাওয়ার আশা করতে পারে ঢাকা।

আশা করা হচ্ছে, বাইডেন যুগে ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খুব আহামরি বৃদ্ধি না পেলেও কিছুটা বাড়তে পারে। একইসঙ্গে বাইডেনের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় (ডব্লিউএইচও) প্রত্যাবর্তন, অভিবাসননীতিতে নমনীয়তা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা সুফল পাবে ঢাকা।

গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন জো বাইডেন। ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ৪৮ মিনিটে দেশটির প্রধান বিচারপতি জন রবার্টসন নতুন প্রেসিডেন্টকে শপথ বাক্য পাঠ করান। ওয়াশিংটনে মার্কিন কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ের ওয়েস্ট ফ্রন্টে এই শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর আগে প্রথা অনুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন কমলা হ্যারিস। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান ও প্রথম দক্ষিণ এশীয় হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পেলেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী দিনগুলোতে হোয়াইট হাউসের নেতৃত্বের কাছে বেশ কিছু প্রত্যাশা থাকবে ঢাকার। বিশেষ করে-দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, জিএসপি সুবিধা, বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আন্তরিক সমর্থনের ক্ষেত্রে। 

নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে যাত্রা শুরু করা বাইডেনকে দায়িত্বের শুরুতেই করোনা মোকাবিলা, করোনায় ভেঙে পড়া অর্থনীতি, ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন ও সম্প্রতি দেশটিতে ঘটে যাওয়া সহিংসতা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বেশ বেগ পেতে হবে। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রেখে যাওয়া এই চ্যালেঞ্জিং অবস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে উত্তরণে ব্যস্ততায় বিশ্বের দেখভাল করাটাই যেখানে কিছুটা কঠিন হয়ে পড়বে সেখানে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বাড়ানো বা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার বিষয়টি কতটা নতুন মাত্রা পেতে পারে তার জন্য সময়ের অপেক্ষায় থাকতে হবে।  

আশা করছি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে তারা কাজ করবে

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন

বাইডেন প্রশাসন যুগে দেশটির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নতুন করে কী ধরনের সুবিধা পেতে পারে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জো বাইডেন সরকারের সময়ে আশা করছি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে তারা কাজ করবে। আমাদের কারও সঙ্গে শত্রুতা নেই, সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। আমাদের অর্থনীতি খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে। এই করোনাকালেও এশিয়ায় আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি ছিল। আমাদের বিশ্বাস, দুই দেশের সুসম্পর্ক বজায় থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের এই সরকার প্যারিস চুক্তিতে ফিরলে আমরা তার সুবিধা পাবো।’

ঢাকা এবং ওয়াশিংটনে যেই ক্ষমতায় থাকুক না কেন দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক নিয়মেই চলে। গত চার বছরে ট্রাম্প প্রশাসনে দুই দেশের সম্পর্ক খুব ভালো কিংবা খুব খারাপও ছিল না। ট্রাম্পের উগ্র মানসিকতা বিশ্বের কিছু দেশের সঙ্গে থাকলেও ঢাকায় এর আঁচ লাগেনি। বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের মধ্যে সন্ত্রাসবাদবিরোধী পারস্পারিক সহযোগিতা জোরদার হওয়ার পাশাপাশি ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আলোচনা, বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর বিষয়ে অগ্রগতি, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের কয়েকজন সেনার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞাসহ এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের পাশে থাকার অব্যাহত আশ্বাস; রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণে অর্থায়ন ও করোনাকালে বাংলাদেশের পাশে থাকার বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছিল।

তবে চার বছরের ক্ষমতার শেষের দিকে ট্রাম্প প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর বাংলাদেশে আল-কায়েদার হামলা নিয়ে করা মন্তব্য সব শেষ করে দেয়। বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আল-কায়েদা বাংলাদেশে হামলা করেছে; ভুলবশত এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা ভবিষ্যতেও আছে। অবশ্য ঢাকা ওয়াশিংটনের এই বক্তব্যের কড়া প্রতিবাদ জানায়।

একইসঙ্গে গত চার বছর ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা আবার চালু করার ব্যাপারে বাংলাদেশ বেশ জোরালো প্রচেষ্টা চালানোর পরও ওয়াশিংটন এ বিষয়ে কোনো কর্ণপাত করেনি।  

এক নজরে জো বাইডেন 
জো বাইডেনের রাজনৈতিক জীবন সুদীর্ঘ, প্রায় ৫০ বছরের। ব্যক্তি জীবনেও বহু কঠিন সময় পার করে আসতে হয়েছে তাকে। হারিয়েছেন স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে। এক সময়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলের রাজনীতিই করবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে ১৯৮৭ সালেও নেমেছিলেন তিনি।  
• জো বাইডেনের কৈশোর কেটেছে অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে 
•  অনেক প্রতিকূলতা কাটিয়ে টিকে থাকা একজন ব্যক্তি হিসেবে সুখ্যাতি রয়েছে বাইডেনের 
• ১৯৭২ সালে এক দুর্ঘটনায় স্ত্রী ও মেয়েকে হারিয়ে একেবারেই বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন তিনি 
• মাত্র ৩০ বছর বয়সে দুই মেয়াদে সিনেটার থাকা রিপাবলিকান প্রার্থীকে হারিয়ে তিনি সিনেটে আসন জয় করেন 
• ২০১২ সালে ইরাক যুদ্ধের অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল তার ওপর 

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে খুব পরিবর্তন না এলেও বাইডেন সরকার থেকে বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকভাবে কিছু সুবিধা পাবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফেরার কারণে বাংলাদেশ কিছু তহবিল পাবে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় ফিরে গেলে সেখানেও কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে। তবে বাণিজ্যে বা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি কিছু আমি আশা করতে পারছি  না।

গত ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসে বাইডেনের বিজয়ের স্বীকৃতি দেওয়ার দিনে কংগ্রেস ভবনে হামলা চালায় ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকেরা। এতে পাঁচজন নিহত হন, আহত হন কয়েক শ। কংগ্রেস ভবনে হামলার ইস্যুতে ট্রাম্পের ক্ষমতা শেষ হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে রিপাবলিকান অনেকের ভোটে কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিত হন ট্রাম্প। তার নিজের দলের ১০ জন সদস্য বিপক্ষে গিয়ে ভোট দিয়ে তাকে অভিশংসিত করেন। ট্রাম্পের অভিশংসনের পক্ষে ২৩২ ভোট এবং বিপক্ষে ১৯৭ ভোট পড়ে। ট্রাম্পই যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি দুই বার অভিশংসিত হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ভূ-রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে। সেই বিষয়টি ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় লক্ষ্য করেছে। আমি মনে করি, বাইডেন সরকার এটাকে গুরত্ব দেবে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বাইডেন ফেরত আসছে, এতে বাংলাদেশ সুবিধা পাবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কিছুটা সুফল পেতে পারে বাংলাদেশ। তাছাড়া দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বাণিজ্য; বিশেষ করে পোশাক খাতে ডিউটি ফ্রি সুবিধা চাচ্ছে, সেটা এই সরকারের সঙ্গে নতুন করে আলোচনার মাধ্যমে অর্জন করে নিতে হবে।’

এনআই/এনএফ