বিলাসবহুল বে ওয়ান ক্রুজ

‘‘এটা জাহাজ না রাজপ্রাসাদ! গুলিয়ে ফেলছি। তবে ‘জলের দরে’ চলছি সাগরপথে। যাচ্ছি সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম থেকে ‘জলপরী’ সেন্টমার্টিনের বুকে’’।

এভাবেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন সদ্য বিবাহিত রাকিব-নাবিলা। মধুচন্দ্রিমা ভ্রমণে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে তারা যাচ্ছেন কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন।

রাকিব হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জাহাজে এসেছি না তারকা হোটেলে! ফাইভ স্টার হোটেলের মতো সব সুযোগ-সুবিধা। অতিথি আপ্যায়নও বেশ ভালো লেগেছে। খাবার-দাবার দারুণ। রুমও অনেক ভালো লেগেছে। খরচ নাগালের মধ্যে’।

ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এ যেন এক দারুণ সুখবর। চট্টগ্রাম থেকে সাগরপথে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার এ সুযোগ মিলছে প্রতি সপ্তাহেই। এ সুবিধা মিলছে বেসরকারি কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের ‘বে ওয়ান ক্রুজ’ জাহাজে।

বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) পতেঙ্গার ১৫ নম্বর ঘাট থেকে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে বিলাসবহুল এ জাহাজ। সপ্তাহে একদিন জাহাজটি চট্টগ্রাম থেকে সাগরপথে সেন্টমার্টিন যাবে বলে জানিয়েছে ‘বে ওয়ান ক্রুজ’ কর্তৃপক্ষ।

জাহাজটির যাত্রা শিডিউল এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম বিমানের ফ্লাইটের যাত্রীরা প্রমোদতরীর শিডিউল ধরতে পারবেন।

জাহাজ তো নয় যেন তারকা হোটেল : এতদিন কোথায় ছিলেন?

‘‘অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; ...‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’’

জীবনানন্দের মতো এমন জিজ্ঞাসা ভ্রমণ পিপাসুদেরও- এতদিন কোথায় ছিল ‘বে ওয়ান ক্রুজ’?

জানা গেছে, জাপান থেকে আনা এই জাহাজ গত ৯ সেপ্টেম্বর পূর্ব চীন সাগর অতিক্রম করে। ১৫ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের পথে রওনা দেয়। আন্দামান ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে ১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে এসে পৌঁছে এই প্রমোদতরী। আনুষঙ্গিক মেরামতের মাধ্যমে জাহাজটিকে নতুন করে বিলাসবহুল রূপ দেওয়া হয়েছে।

এরপর প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সেটি শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে কর্ণফুলী নদীর ওয়াটার বাস টার্মিনালে নোঙর করে। ৪৫০ ফুট লম্বা, ৫৫ ফুট প্রস্থের বিলাসবহুল জাহাজটিতে ১৭ জন ক্রু এবং যাত্রীসেবার জন্য দেড়শ’ স্টাফ আছেন।

জাহাজটি ২৮ বছরের পুরনো। আইন অনুযায়ী ২৫ বছরের পুরোনো জাহাজ সাগরে ভাসানোর ওপর নিষেধ আছে। এ বিষয়ে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ রশিদের বক্তব্য, বিদেশে প্যাসেঞ্জার জাহাজ ৫৫-৬০ বছরের পুরোনো হলেও চলে। আমাদের দেশের আইনটি যুগোপযোগী করতে আবেদন করেছি আমরা।

‘প্রথমে দর্শনধারী’
বাইর থেকে দেখতে জাহাজ মনে হলেও, ভেতরে যেন তারকা হোটেল। ফাইভ স্টার হোটেলের মতো প্রেসিডেন্ট স্যুট, রয়েল স্যুট, বাংকার বেড কেবিন, টু ইন বেড কেবিন আছে দেশের প্রথম বিলাবহুল জাহাজটিতে। আছে অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আরামদায়ক চেয়ারসহ আধুনিক ব্যবস্থা।

জাপানের কোবে শহরের মিতসুবিশি হেডি ইন্ডাস্ট্রিজে নির্মিত জাহাজটির ইন্টেরিয়র ও আসবাবে নতুনত্ব এনেছে কর্তৃপক্ষ। বাইরে মেঝেতে বসানো হয়েছে কৃত্রিম ঘাসের গালিচা। দেশি-বিদেশি খাবার নিয়ে উন্নতমানের রেস্তোরাঁ, স্বয়ংক্রিয় ভেন্ডিং মেশিন, কয়েন পরিচালিত ঝর্ণা। করোনা সচেতনতায় মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজারও রয়েছে প্রতিটি ফ্লোরে।

ঝড়-তুফানেও নিরাপদ : ‘মাঝি বাইয়া যাও রে’

‘অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা’- সে কীভাবে পৌঁছাবে ‘জলপরী’ সেন্টমার্টিনের বুকে? এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেন না ঘটে সেদিকে পূর্ণ দৃষ্টি আছে ‘বে ওয়ান’র।

কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দুই হাজার যাত্রী নিয়ে সৌদি আরব পর্যন্ত যেতে সক্ষম এ জাহাজ। ঝড়-তুফানেও জাহাজে কোনো সমস্যা হবে না। এর দুইপাশে দুটি পাখা আছে। সাগরে সতর্ক সংকেত তিন-চার বা এর বেশি থাকলেও জাহাজে নিরাপত্তা সমস্যা হবে না। ১০ নম্বরের মতো সতর্ক সংকেত থাকলে জাহাজ কিছুটা কাত হবে, দুলবে।’

‘টাকা আনা পাই’ : ভাড়া সর্বনিম্ন ২ হাজার, সর্বোচ্চ ৫০ হাজার
সর্বনিম্ম দুই হাজার টাকা থেকে প্রত্যেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা ভাড়ায় এই প্রমোদতরীতে ভ্রমণ করতে পারছেন। তবে রুমের সংখ্যা বেশি তিন থেকে চার হাজার টাকার মধ্যে। নাস্তা-খাবারসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থাকবে। জাহাজে রাতযাপন, সমুদ্র বিনোদনের সুযোগ তো আছেই।

ও কে জাহাজিয়া ভাই’ : কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স
কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের যাত্রা শুরু ১৯৯৪ সালে। প্রথমে বন্দরের জন্য পাঁচটি টাগবোট তৈরি করে তারা। এরপর বড় বড় জাহাজ তৈরি ও সংস্কারকাজে সুনাম কুড়িয়েছে। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ‘বাংলার সৌরভ’ জাহাজ মেরামত করে এ প্রতিষ্ঠান।

কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স এ পর্যন্ত এক হাজার ২০০ জাহাজ তৈরি করেছে। সংস্কার করেছেন সাত-আটশ' জাহাজ। 'কর্ণফুলী এক্সপ্রেস' নামে প্রতিষ্ঠানটির আরেকটি বিলাসবহুল জাহাজ গত বছর জানুয়ারি থেকে কক্সবাজার-টেকনাফ রুটে চলাচল করছে।

এইচকে