পাকিস্তানি শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন দেশে হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেওয়ার ৪৯ বছর পার হতে চলেছে। জাতিকে মেধাশূন্য করতে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাসই চেষ্টা চালিয়ে গেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বাঙালির বিজয় যতো সুনিশ্চিত হয়েছে, হত্যার  মাত্রা ততো বেড়েছে। গোটা দেশজুড়ে চলতে থাকে এ হত্যাযজ্ঞ। 

এর শেষ আঘাতটি এসেছিল ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর। সেদিন মুনির চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ আরও অনেককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাদের অনেকের লাশ পাওয়া যায় বধ্যভূমিতে। অনেককে আর কখনও খুঁজেই পাওয়া যায়নি।  

জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর পর দীর্ঘ সময় পার করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এখনও এই হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেওয়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আলবদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে দেশে ফিরিয়ে ফাঁসি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

প্রায় সাত বছর আগে দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আদালতের রায়ের পরও এদের দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর না হওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন এ দুই বদর নেতা ও তাদের সহযোগীদের হাতে নিহত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর সন্তান আসিফ মুনীর।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে একান্ত আলাপে শহীদ পরিবারের এই সন্তান দুই খুনিকে দেশে ফেরানোর অগ্রগতি কোন পর্যায়ে, সে প্রসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো তথ্য জানানো হচ্ছে না বলেও আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন।  

আসিফ মুনীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরাতো ভিকটিম ফ্যামিলি। বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে আমাদের শহীদ পরিবারগুলো সাক্ষ্য দিয়েছে। তাদের ফেরানো নিয়ে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানি না। কিন্তু সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিচ্ছে, নিয়ে থাকলে সেটা কোন পর্যায়ে আছে এটা জানতে চাই। আমরা যেহেতু মামলাটার একটা পক্ষ, আমাদের জানার অধিকার আছে। আমরা জানার দাবি জানাই।’

জানা যায়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আশরাফুজ্জামান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আর মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন।

পলাতক আশরাফুজ্জামান ও মুঈনুদ্দীনের বর্তমান অবস্থার প্রসঙ্গে নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর সন্তান জানান, বিভিন্ন সূত্রের বরাতে শহীদ পরিবারের সন্তানেরা জানতে পেরেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে থাকা আশরাফুজ্জামান ও মঈনুদ্দীনের বিষয়ে দুই দেশের সরকারের কাছে তাদের ফেরতের বিষয়ে কোনো লিখিত তথ্য নেই।

এদিকে গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার দুই হোতাকে এখনও দেশে ফিরিয়ে না আনতে পারাকে খুবই দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন। একইসঙ্গে মন্ত্রী এদের একদিন দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের সম্মুখীন করতে পারবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার দুই হোতাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর সন্তান সরকারের স্বদিচ্ছা বা আন্তরিকতার অভাব দেখছেন না। তবে স্বচ্ছতার বিষয়ে অভিযোগ তুলে আসিফ মুনীর বলেন, ‘সরকারের স্বদিচ্ছা নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। তবে এখানে স্বচ্ছতার অভাব আছে।’

বুদ্ধিজীবীদের দেশে ফেরানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য সরকারের বিভিন্ন অজুহাতের কারণে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকলেও এই দুই খুনিকে দেশে ফেরাতে ঝামেলা হচ্ছে।

পলাতক আশরাফুজ্জামান ও মঈনুদ্দীনকে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া কঠিন বলেই মনে করছেন আসিফ মুনীর। তবে সরকারের সঙ্গে ব্যক্তি, সংগঠন এবং তাদের বসবাসরত বাঙালি কমিউনিটিকে একসঙ্গে যোগ করা হলে এটা সম্ভব বলেই বিশ্বাস করেন শহীদ বুদ্ধীজীবীর এই সন্তান।

আসিফ মুনীর বলেন, উদ্যোগটা শুধু সরকারিভাবে নিলে হবে না। এটা একসঙ্গে কাজ করার ব্যাপার। যতদূর জানি দুইজন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে থাকেন। ওখানকার কমিউনিটি প্রবাসী বাংলাদেশিরাও যেন সেখানকার কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানায়। বাংলাদেশে এটা নিয়ে যারা কথা বলেন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ আমাদের সংগঠন প্রজন্ম-৭১ আছে। এসব বিষয়ে হতে পারে আমাদেরও সাজেশান থাকতে পারে...কিভাবে করা যেতে পারে কাজটা।’

‘সব মিলিয়ে ব্যাপারটা কঠিন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, একটা চাপ দেওয়া যায় বা উচিত। আমরা সরকারকে বিভিন্ন সময়ে বলেছি, প্রথমত তারা যখন ওইসব দেশে গিয়ে আশ্রয় নিল, সেখানে তার কাগজপত্র নেওয়ার ক্ষেত্রে, নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে, অনুসন্ধান করা হয়েছে কি-না? এটাতে কিন্তু ওই সরকারেরও একটা জবাবদিহিতার জায়গা আছে। সেই জায়গায় আমাদের সরকার চাপ দিতে পারে।’ 

২০১৩ সালের শেষের দিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১১টি অভিযোগের সবগুলোতেই সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকার করার নির্দেশ দেন আদালত।

জামায়াতে ইসলামী তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের এই দুই কেন্দ্রীয় নেতা মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ শিক্ষক, ছয় জন সাংবাদিক ও তিনজন চিকিৎসকসহ ১৮ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যা করেন।

বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। 

এনআই/এনএফ