বিকাশ বিশ্বাসের বয়স ৫২ বছর। ৩০ বছর ধরে সুন্দরবনের দুবলার চরে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ভাড়া ট্রলার আর নিজের জালে ৮/১০ জনের দল নিয়ে বছরের অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পাঁচ মাস মাছ ধরেন। লাভের আশায় এবারো দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে সুন্দরবনে এসেছেন। এজন্য তাকে প্রতি মাসে সুদ দিতে হবে ২৫ হাজার টাকা (প্রতি লাখে ৫ হাজার)। যা পাঁচ মাসে দাঁড়ায় এক লাখ ২৫ হাজার টাকা (আসল বাদে)।

শুধু বিকাশ বিশ্বাস নন, সুন্দরবনের দুবলার চরে ৫ মাসের জন্য মাছ ধরতে আসা অন্য জেলেদেরও উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েই আসতে হয় দুবলার চরে। তবে সমুদ্র থেকে মাছ ধরে ডাঙায় আনার পরই নিয়ন্ত্রণ হারায় জেলেরা। এরপর সবই ঠিক করেন প্রভাবশালীরা। জেলেরা তাদের ডাকেন ‘সাহেব’ বলে।

‍সুন্দরবনের ‘নিয়ন্ত্রক’ ১৫ সাহেবে জিম্মি হয়ে আছেন জেলে-মহাজনসহ ৩০ হাজার মৎস্যজীবী। কারা মাছ ধরবেন, কোন ব্যবসায়ীদের কাছে মাছ বিক্রি হবে, কোন মাছের কতো দাম! এর সবই ঠিক করেন ১৫ সাহেব। যে কারণে মাছ বেশি ধরা না পড়লে লোকসানের মুখ দেখতে হয় জেলেদের।

বন বিভাগ থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে মাছ ধরার কার্ড সংগ্রহ করতে হয়। যার নবায়ন ফি বাৎসরিক ৭৫০ টাকা। এ বছর বন বিভাগ থেকে ১৫ ব্যবসায়ী মাছ ধরার অনুমতি পেয়েছেন। তাদের অধীনে ৯৮৫ জন জেলে-মহাজন দুবলার চরে অস্থায়ী বসতি গড়ে মাছ ধরছেন।

সাধারণ জেলে-মহাজনদের অভিযোগ, এ যেন নব্য ইংরেজ বেনিয়া শাসনের নীল চাষের নামে দাদন প্রথারই নামান্তর। সুন্দরবনে জলদস্যু আতঙ্ক কাটলেও এই দাদনচক্রের হাত থেকে রেহাই মেলেনি এখানকার জেলেদের। সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করতে পারলে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে সুদ।

গত ৩ নভেম্বর সুন্দরবনের দুবলার চরে গিয়ে দেখা যায়, মাছ ধরার ট্রলার নিয়ে সমুদ্র থেকে ঘাটে ফিরছেন জেলেরা। টানা ৩/৪ দিন মাছ ধরে ডাঙায় ফিরে খাঁচায় ও জালে মাছ নামানো হয়। এরপর সেসব মাছ বরফ ঢেকে চলে যায় আড়তে। অনেক মাছ আবার রোদে শুকিয়ে করা হয় শুঁটকি।

দুবলার চরে নেমেই দেখা যায়, রোদে মাছ শুকাতে ব্যস্ত সাতক্ষীরার তালা থানার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা জেলে বিকাশ বিশ্বাস। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন আরও ৭/৮ জন।

বিকাশ বিশ্বাস বলেন, অধিকাংশ জেলেরই নেই নিজস্ব ট্রলার। এখানে ঘর ভাড়াও নিতে হয় বন বিভাগ থেকে। ভাড়ার টাকা যায় সাহেবদের মাধ্যমে। আবার মাছের ন্যায্যমূল্যও পাই না। ন্যায্যমূল্য পেলে এখানকার জেলেদের দুর্দশা কেটে যেত।

গত বছর দুবলার চরে মাছ বিক্রি থেকে ৩ কোটি ২২ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করেছে সরকার। প্রতি ১০০ কেজি মাছ বিক্রিতে ৫০০ টাকা রাজস্ব পায় বন বিভাগ।

আজাদ শেখ (৪৫) নামে আরেক জেলে বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে সুন্দরবন এলাকায় সমুদ্রে মাছ ধরি। প্রতিবছর ঋণ নিয়ে আসি। আমার সঙ্গে ৫ জেলেসহ ১৮ জন সহযোগী। সবাইকে নিয়ে লাভের আশায় সমুদ্রে পড়ে থাকি। সবার ভরণপোষণ সবই দিতে হয় আমাকে। মাছ ধরে দুবলার চরে ‘সাহেবদের’ নিয়োজিত লোকদের কাছে বিক্রি করে দিতে হয়। দিনশেষে মাছ বিক্রি করলেও তেমন আয় হয় না। বছর শেষে উল্টো ঋণের জালে বন্দি থাকতে হয়।

বিশ্বজিত রায় সুন্দরবনের হিরণপয়েন্টে মাছ ধরা বন্ধের পর আসেন দুবলার চরে। তিনি বলেন, আমার দলে এমনও জেলে আছে যাকে ৫ মাসে দিতে হয় দেড় লাখ টাকা। কাজের গুরুত্ব অনুযায়ী বেতন। তাদের ভরণপোষণও দিতে হয়। একেক ট্রলারে ৬ জন করে থাকে। ৯ লাখ টাকা খরচা করে এখানে আসছি। এখানে নির্ধারিত কোনো আয় নেই। মাছের উপর নির্ভর করে থাকতে হয়। মাছ বেশি ধরা পড়লে লাভ হয়।

তিনি বলেন, মহাজনের কাছ থেকে পাঁচ মাসের জন্য ৯ লাখ টাকা নিয়ে আসছি। এজন্য সব মিলিয়ে সুদই দিতে হবে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। এ মৌসুমে ৩০ লাখ টাকার মাছ ধরতে না পারলে লোকসান হবে। এখানে জেলেদের প্রতিবাদের সুযোগ নেই। যে মহাজনের টাকায় মাছ ধরতে আসি, তার কাছেই মাছ বিক্রি করতে হয়। কিন্তু ন্যায্যমূল্যটাও পাই না। যেমন- আগে মাত্র ৩০ টাকা দরে এক কেজি চিংড়ি দিতে হতো মহাজনকে। এখন সেটা ৯৫ টাকা করা হলেও বাজারের তুলনায় তা খুবই কম। এমন অবস্থা সব জেলের।

প্রকৃত জেলেও পায় না বনবিভাগের মাছ ধরার কার্ড

জেলের থাকে জাল-নৌকা। তবে গভীর জলে ট্রলারই ভরসা। সেক্ষেত্রে সাহেব কিংবা আড়তদার মহাজনদের কাছ থেকে মাছ বিক্রির শর্তে নিতে হয় ট্রলার। প্রতিকূল পরিবেশ যেখানে নিত্যসঙ্গী সেখানে পানি থেকে মাছ ধরে ডাঙায় আনতেই মাছের মালিক হয়ে যায় প্রভাবশালী সাহেবেরা। প্রকৃত জেলেরা বন বিভাগ থেকে মাছ ধরার লাইসেন্স বা অনুমতিপত্র পান না বলে অভিযোগ জেলেদের।

উদয় শঙ্কর নামে এক জেলে বলেন, এখানে ট্রলার পার্টি আছে ৫০ জনের বেশি। যারা এখানে রুপচাঁদা মাছ নিয়ে খুলনা যায়। কিন্তু আমরা ভালো দাম পাই না। তাদের নির্ধারণ করা মূল্যেই মাছ বিক্রি করতে হয়। প্রকৃত জেলেরা বন বিভাগ থেকে মাছ ধরার জেলে কার্ড বা অনুমতিপত্র পান না। এখানে চার আনা জেলের কার্ড আছে। ১২ আনা জেলেরই কার্ড নেই। মাছ ধরার কার্ডের নিয়ন্ত্রণ কে পাবে কে পাবে না সেটা সাহেবদের হাতে। যে কারণে অধিকাংশ জেলেকে দাদন কায়দায় ফেলে সাহেবদের অনুমতিতে মাছ ধরতে দেওয়া হয়। তাই হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না জেলেদের।

এ ব্যাপারে বন বিভাগ ও মাছ ব্যবসায়ী কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বন বিভাগ থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে মাছ ধরার কার্ড সংগ্রহ করতে হয়। যার নবায়ন ফি বাৎসরিক ৭৫০ টাকা। এ বছর বন বিভাগ থেকে ১৫ ব্যবসায়ী মাছ ধরার অনুমতি পেয়েছেন। তাদের অধীনে ৯৮৫ জন জেলে-মহাজন দুবলার চরে অস্থায়ী বসতি গড়ে মাছ ধরছেন।

তবে জেলেরা বলছেন, বনবিভাগ ওই ১৫ ব্যবসায়ী সাহেবের বাইরে কিছু করতে পারে না। কাগজে কলমে হাজার খানেক বৈধ কার্ডধারী থাকলেও অধিকাংশই সাহেবদের চক্রে বন্দি।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দুবলার চরসহ সুন্দরবনে এবছর মাছ ধরার অনুমতিপ্রাপ্তরা হলেন- কামাল উদ্দিন আহমেদ, আফিয়া বেগম, খান শাফিউল্লাহ, শেখ মইনুদ্দিন আহমেদ, আরিফ হোসেন, রেজাউল শেখ, এ বি এম মুস্তাকিন, ইদ্রিস আলী, হাকিম বিশ্বাস, জালাল উদ্দিন আহমেদ, সুলতান মাহমুদ, বেলায়েত সরদার, কামরুর নাহার, শাহানুর রহমান ও আসাদুর রহমান সরদার।

এ ব্যাপারে দুবলার চর বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রহ্লাদ চন্দ্র রায় বলেন, ‘অধিকাংশ জেলের মাছ ধরার কার্ড নেই। আর এখানে স্বল্প সময়ের জন্য সবাইকে কার্ড দিলেও তার সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনাও নেই।’

তবে দুবলার চরের জেলে বেলায়েত সরদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, দখলদারিত্ব চলছে এখানে। জায়গা বন বিভাগের আর দখল খায় সাহেবেরা। এখানকার জেলেদের পা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত বিক্রি হয়েই আসতে হয়। শুঁটকি একজনের কাছে দাদন, রাবিশটা (পচে যাওয়া মাছ) আরেকজনের কাছে দাদন, চিংড়িটা বাইরের কেউ নিতে পারবে না। শুধুমাত্র কার্ডধারী সাহেবেরাই কিনতে পারবে। সমুদ্রগামী জেলেদের দেখভালে সরকার বা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেই। খেটে খাওয়া মানুষগুলো যাদের ৫ মাসের আয়ে পুরো বছর চলে তারা জিম্মি ১৫ সাহেবে।

বেলায়েত সরদার আক্ষেপ করে বলেন, এখান থেকে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে। অথচ জেলেদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। কেউ এখানে হার্ট অ্যাটাক করলে তাকে মোংলা পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেই। এখানে সাপের চাপ বেশি। সাপের কামড়ে জেলে মারাও গেছে। এখানে সরকার হাসপাতাল করেছিল। তা সাইক্লোনে ভেসে গেছে। আর এখানকার তিন সাইক্লোন সেন্টার বন বিভাগ আর কামাল উদ্দিনের দখলে। মূল কথা এখানে জেলেদের জীবন কিংবা শ্রমের কোনোটারই মূল্য নেই। মাছ ধরে জেলে আর এর লাভ চুষে খাচ্ছে সাহেবেরা।

তিনি বলেন, শ্যালা থেকে আলোরকল পর্যন্ত দুবলার চরের সবকিছুই সাহেবদের নিয়ন্ত্রণে। অমুক সাহেবের জেলে ২০০। তমুক সাহেবের ৩০০ জেলে। আর ৫ মাসের মৌসুমে সাধারণ জেলেরা অভিজ্ঞতা ও কাজের ধরনের উপর একজন ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বেতন পায়। 

দুবলার চরসহ সুন্দরবনে এবছর মাছ ধরার অনুমতিপ্রাপ্তরা হলেন- কামাল উদ্দিন আহমেদ, আফিয়া বেগম, খান শাফিউল্লাহ, শেখ মইনুদ্দিন আহমেদ, আরিফ হোসেন, রেজাউল শেখ, এ বি এম মুস্তাকিন, ইদ্রিস আলী, হাকিম বিশ্বাস, জালাল উদ্দিন আহমেদ, সুলতান মাহমুদ, বেলায়েত সরদার, কামরুর নাহার, শাহানুর রহমান ও আসাদুর রহমান সরদার।

দুবলার চর নিউ মার্কেটের সামনে আক্ষেপ করে জেলে আজাদ শ্যামল কান্তি বলছিলেন, প্রতিবছরই প্রায় ৩০ হাজার পুরুষ মোংলা, রামপাল ও খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে মাছ ধরতে নামেন। স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের ফেলে ৫ মাস সমুদ্রে জীবন সংগ্রামেও বছর শেষে শূন্য হাতে ফিরতে হয় অনেক জেলেকে। কাউকে আবার দাদন আর ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পরের বছরের অপেক্ষায় চুক্তিবদ্ধ হতে হয়।

শেখ হায়দার আলী রামপাল থেকে ৫ মাসের জন্য সুন্দরবনের দুবলার চরে এসেছেন ব্যবসা করতে। তিনি বলেন, কমপক্ষে ১০ বার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়েছি। প্রতিবারই মুক্তিপণ দিতে হয়েছে। প্রথমে কম দিয়ে পার পেয়েছি। পরে এমনও হয়েছে জীবন বাঁচাতে ৫ লাখ টাকাও দিতে হয়েছে। এখন জলদস্যু নেই। এটা নিয়ে আমরা স্বস্তিতে আছি। কিন্তু এখানে সাহেবদের হাত থেকে মুক্তি মিলছে না। মাছ ধরা শেষে বাড়ি ফেরার আগে সাহেবদের সঙ্গে হিসাবে বসতে হয়। হিসাবে দেখা যায়, সাহেবরাই উল্টো ২/১ লাখ টাকা পাবেন। গত বছর জালে মাছ অনেক কম ধরা পড়েছে। যদিও এবার জেলেদের মুখে হাসি। এবার মাছ বেশি ধরা পড়ছে। কিন্তু ঋণ আর দাদনে জিম্মি জেলেরা। মাছের ন্যায্যমূল মেলে না। প্রতিবাদ করলে সে জেলের আর জায়গা হয় না দুবলার চরে।

এ বছর দুবলার চরে অস্থায়ী ৯৬টি দোকান বরাদ্দ করেছে বন বিভাগ। জেলেদের থাকার জন্য হাজার খানেক অস্থায়ী বসতি ঘর তোলা হয়েছে। যার নিয়ন্ত্রণও সাহেবদের হাতে। সেখান থেকে বন বিভাগের কর্মকর্তারা পান মাসোয়ারা।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দুবলার চরে মাছ বিক্রি থেকে ৩ কোটি ২২ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করেছে সরকার। প্রতি ১০০ কেজি মাছ বিক্রিতে ৫০০ টাকা রাজস্ব পায় বন বিভাগ।

শরফুদ্দিন নামে এক দোকান মালিক বলেন, দোকানপ্রতি (আয়তন অনুসারে) ৩ থেকে ৬ হাজার টাকা দিতে হয়। আবার জেলেদের জন্য নিয়ম না থাকলেও অস্থায়ী বসতির জন্য টাকা নেয় সাহেবেরা। আর এখানে সরকার রাজস্ব পেলেও অবহেলিত এখানকার মৎস্যজীবীরা। তাদের খাবারের জন্য নেই সুপেয় পানি। বৃষ্টির পানি আটকে সংরক্ষণ করে খেতে হয়। নেই চিকিৎসার ব্যবস্থা। নৌ অ্যাম্বুলেন্স। এজন্য অন্তত মৌসুমের পাঁচ মাসের জন্য অস্থায়ী চিকিৎসা ক্যাম্প চালুর অনুরোধ জানান তিনি।

সুন্দরবনের ১৫ সাহেবের একজন দুবলার চর ফিশিং ম্যান গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জেলে-মহাজনদের কাছ থেকে কোনো ধরনের চাঁদাবাজি করা হয় না। কার্ড নিয়ে জালিয়াতি ও জেলেদের জিম্মি করে মাছ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি।’

জেইউ/জেডএস