প্রবাসী কনের ফাঁদ
বিয়ের পর কানাডা কিংবা আমেরিকা নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আগ্রহীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে মোট ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রতারকচক্র। তবে পুলিশের পাতা ফাঁদে পড়ে ফাঁস হয়েছে তাদের দীর্ঘ ১০ বছরের কারসাজি।
অভিনব পন্থায় প্রতারণায় জড়িত চক্রটির মূলহোতা ৩৮ বছর বয়সী এক নারী, নাম- সাদিয়া জান্নাত। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সাদিয়া গ্রেফতার হলেও চলছিল চক্রটির প্রতারণা কার্যক্রম। সর্বশেষ গত রাতে কানাডা যেতে আগ্রহী পাত্র সেজে চক্রটির তামান্না নামে আরেক সদস্যকে রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
বিজ্ঞাপন
সিআইডি জানিয়েছে, এ পর্যন্ত চক্রটির মোট চার সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন- চক্রের মূলহোতা সাদিয়া জান্নাত জান্নাতুল ফেরদৌস, মো. সিরাজুল ইসলাম সিরাজ (৪০), মো. ফিরোজ মিয়া এবং তামান্না।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের ঢাকা মেট্রো পশ্চিমের বিশেষ পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার বলেন, গত ৯ জুলাই দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় সাদিয়া বিজ্ঞাপন দেন যে, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী কানাডার সিটিজেন ডিভোর্সি সন্তানহীন নামাজি পাত্রীর জন্য ব্যবসার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী বয়স্ক পাত্র চাই। যোগাযোগের জন্য ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, ২৩/২/এ বারিধারা। একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন দেখে প্রলুব্ধ ৭০ বছর বয়সী নাজির হোসেন যোগাযোগ করেন। একপর্যায়ে প্রথম গত ১২ জুলাই গুলশান-২ এর একটি রেস্তোরাঁয় দেখা করে দেড় লাখ টাকা ও পাসপোর্ট প্রদান করেন। পরবর্তীতে সাদিয়া জান্নাত নাজিরকে বলেন, তার কানাডায় ২০০ কোটি টাকার ব্যবসা আছে। যেহেতু কানাডায় অনেক শীত, সেখানে থাকাটা খুব কঠিন। সেজন্য আমার টাকাগুলো তোমার নামে বাংলাদেশে নিয়ে আসি। ব্যবসার কথা বলে ওই টাকার প্রলোভন দেখানো হয়। এরপর ওই টাকা দেশে আনার ক্ষেত্রে নাজিরের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় ট্যাক্স, ভ্যাট, ডিএইচএল বাবদ খরচ দেখিয়ে এক কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে ফোন বন্ধ করে দেন। প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে নাজির সিআইডিতে অভিযোগ দেন।
শামসুন্নাহার বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করি। একপর্যায়ে আমরা দেখতে পাই, চক্রটি ৫ লাখ থেকে শুরু করে ২০ লাখ পর্যন্ত টাকা নিয়ে শতাধিক প্রলুব্ধ ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
তদন্তে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিতের পর সিআইডির ঢাকা মেট্রো পশ্চিম ইউনিটের একটি দল চক্রের মূলহোতা সাদিয়া জান্নাতকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করে। সেসময় তার কাছ থেকে তিন ভিকটিমের পাসপোর্ট, ১০টি মোবাইল ফোন, মেমোরি কার্ড, ৭টি সিল, অসংখ্য ব্যবহৃত সিম, হিসাবের খাতা ব্যাংক এশিয়ায় ৪৮ লাখ টাকা জমা দেয়ার স্লিপ উদ্ধার করা হয়।
শামসুন্নাহার বলেন, মূলহোতাকে গ্রেফতারের পর বিশদ জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ১০ বছর যাবৎ এই অভিনব পন্থায় অসংখ্য ভিকটিমের সাথে প্রতারণা করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।
চক্রটি ৫ লাখ থেকে শুরু করে ২০ লাখ পর্যন্ত টাকা নিয়ে শতাধিক প্রলুব্ধ ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে
বিশেষ পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার
দেবিদ্বারের মেয়ে সাদিয়া জান্নাত এসএসসি পাস না করলেও পোশাক এবং কথাবার্তায় স্মার্টনেসের কারণে কানাডা প্রবাসী বলে প্রলুব্ধদের মাঝে বিশ্বাস জন্মাতে সমর্থ হন। তার প্রথম স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে দ্বিতীয় স্বামীকে নিয়ে এই প্রতারণা শুরু করেন।
সর্বশেষ গ্রেফতার তামান্না সম্পর্কে বিশেষ পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার বলেন, যাদের নামাজি ও বোরকা পরিহিত পর্দানশীল পাত্রী দরকার তাদের জন্য দেখানো হতো তামান্নাকে। বিজ্ঞাপনে দেয়া মোবাইলফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তামান্নার সাথে যোগাযোগ করেয়ে দিতো চক্রটি। এরপর আগ্রহীদের নানাভাবে প্রলুব্ধ করতো তামান্না।
পাত্র সেজে তামান্নাকে গ্রেফতার
পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর এক মধ্যবয়সী ব্যবসায়ী সাদিয়ার সাথে যোগাযোগ করেন। কিন্তু সাদিয়াকে দেখে পছন্দ না হওয়ায় যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হয় তামান্নার সাথে। এরপর কয়েক মাসে তাদের ১৮ লাখ টাকা লেনদেনও হয়। এরমাঝে ওই ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী প্রতারণার বিষয়টি টের পেয়ে সিআইডিকে জানান। এরপর প্রতারক তামান্নাকে ধরতে উল্টো পাত্র সেজে ফাঁদ পাতে সিআইডি।
রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁয় দেখা করতে বলা হলে সেখানে পাত্রপক্ষ সেজে হাজির হয়ে একটি সরকারি কলেজে অনার্সে অধ্যয়নরত প্রতারকচক্রের সদস্য তামান্নাকে হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়।
চক্রের প্রতারণায় অর্জিত সম্পদ সম্পর্কে শামসুন্নাহার বলেন, চক্রটির সদস্যদের ঢাকাসহ ঢাকার আশেপাশে প্রায় বিশ কোটি টাকার জমিসহ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। সাদিয়ার নিজ হাতে লেখা ২০১৫/১৬ সালের হিসাবের খাতায় কোন কোন ভিকটিমের কাছ হতে কতবারে কী পরিমাণ টাকা নিয়েছে, তার বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে। আর তামান্নার সাথে আর কারা কারা জড়িত সে ব্যাপারে তদন্ত করা হচ্ছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর গুলশান থানায় দায়ের করা মামলায় (মামলা নং-২৮) তামান্নাকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে।
জেইউ/এনএফ