মিয়ানমার সীমান্তে বিজিবির জোর টহল
টেকনাফের দমদিয়া নাফ নদী পয়েন্টে বিজিবির টহল - ছবি : ঢাকা পোস্ট
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর সীমান্তে টহল জোরদার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। টেকনাফ সীমান্তে চৌধুরীপাড়া, দমদমিয়া, উখিয়ার পালংখালী, থ্যাংখালী, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তে বিজিবির জোরদার টহল দেখা গেছে। মিয়ানমারে জরুরি অবস্থা জারির পর সেখান থেকে নতুন করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় টহল জোরদার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া মিয়ানমারের সামরিক সরকার নতুন কোনো পদক্ষেপ নেয় কি না সে বিষয়েও সজাগ দৃষ্টি রাখছে বিজিবি। মঙ্গলবার (২ ফেব্রুয়ারি) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সীমান্ত এলাকায় খোঁজ নিয়ে এ তথ্য জানা যায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, নতুন করে মিয়ানমার থেকে যেকোনো ধরনের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে। তাছাড়া দেশটির সামরিক সরকার কোনো নতুন পদক্ষেপ নিচ্ছে কি না সেদিকেও নজর রাখা হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
• অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় সীমান্তে বিজিবির টহল
• মিয়ানমারের সামরিক সরকারের পদক্ষেপের প্রতি বিজিবির সজাগ দৃষ্টি
• মিয়ানমার থেকে টেকনাফে কোনো পণ্যবাহী ট্রলার আসছে না
• তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারে জরুরি অবস্থা জারির পর সীমান্তে নজরদারি বাড়ায় বিজিবি। মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের পর দেশটি থেকে টেকনাফে কোনো পণ্যবাহী ট্রলার আসেনি।
বিজ্ঞাপন
সোমবার রাতে (তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে) ব্যাপক গুলির শব্দে আতংকিত হয়ে পড়ি।
রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ
এদিকে সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) রাতে তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন সীমান্তে থাকা রোহিঙ্গারা। মঙ্গলবার (২ ফেব্রুয়ারি) সকালে রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সেনা অভ্যুত্থানের খবরে খুব চিন্তা আছি। এর মধ্যে আবার গোলাগুলির খবর শোনা যাচ্ছে। সোমবার রাতে গুলির শব্দে আতংকিত হয়ে পড়ি আমরা।’ দেশে ফেরা নিয়ে শঙ্কার কথাও জানান এই রোহিঙ্গা নেতা।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম বলেন, ‘২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। প্রায় ৪ বছর শরণার্থী জীবন কাটাচ্ছি। এর মধ্যে প্রত্যাবাসনের আলোচনায় বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারে আবারও গণতান্ত্রিক অবস্থা অন্ধকারে হারিয়ে গেল। এ অভ্যুত্থান আমাদের মিয়ানমারে ফেরার প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত না করে দেয়।’
মিয়ানমারের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইউ মিন্ট সুয়ে’কে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। এতে শঙ্কা প্রকাশ করে আব্দুর রহিমের ভাষ্য, সেনা অভ্যুত্থানের পর যাকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে তিনি সবচেয়ে বড় রোহিঙ্গা বিরোধী। ফলে আমাদের দেশে ফেরার জন্য এটা একটা খারাপের মধ্যে খারাপ খবর।
সেনা অভ্যুত্থানের পর হয়তো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ আরও জটিল হয়ে গেল।
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির নেতা হামিদুল হক চৌধুরী
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির নেতা ও উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হামিদুল হক চৌধুরী জানান, রোহিঙ্গাদের নিজের মাটিতে ফেরাতে বাংলাদেশের আন্তরিক প্রচেষ্টা আছে। মিয়ানমার আলোচনায় কিছু রোহিঙ্গাকে মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল। কিন্তু সেনা অভ্যুত্থানের পর হয়তো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ আরও জটিল হয়ে গেল।
গত কয়েক দিন ধরেই মিয়ানমারে বেসামরিক সরকার ও ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর মধ্যে টান টান উত্তেজনা চলছিল। গত ৮ নভেম্বর জাতীয় নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি বড় জয় পায়। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যেখানে ৩২২টি আসনই যথেষ্ট, সেখানে এনএলডি পেয়েছে ৩৪৬টি আসন। কিন্তু সেনাবাহিনী সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) ভোটে প্রতারণার অভিযোগ তুলে ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের দাবি তোলে।
• গত ৮ নভেম্বর নির্বাচনে সু চির দল বড় জয় পায়
• ফলাফল মেনে নিতে রাজি নয় ইউএসডিপি
• ১ ফেব্রুয়ারি ভোরে সেনাবাহিনী সু চিকে আটক করে
সেনাবাহিনী আগে থেকেই অভিযোগ করছিল, গত নির্বাচনে জালিয়াতি করে ক্ষমতায় এসেছে অং সান সুচির দল এনএলডি। অবশেষে গতকাল (১ ফেব্রুয়ারি) অং সান সু চিসহ দলটির অন্যান্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তার করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। মিয়ানমারে রক্তপাতহীন এ সেনা অভ্যুত্থানের পর এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা এসেছে।
প্রতিবেশী দেশটির এই পরিস্থিতিতে নজর রাখছে বাংলাদেশ। তবে দেশটির রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, অং সান সু চি ক্ষমতায় থাকলেও মূলত ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের ভার দেশটির সেনাবাহিনীর হাতেই ছিল। সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে খুব বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হবে না।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বড় কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে সেটা আরও পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া আপাতত কিছু বলা ঠিক হচ্ছে না। তবে একটা বিষয় হচ্ছে, সু চি ক্ষমতায় থাকলেও মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণ তো সেনাবাহিনীর কাছে। সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বড় কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।’
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। আগে থেকেই দেশে আরও চার লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছিলেন। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি। গত বছর দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইনের বিরূপ পরিবেশ নিয়ে শঙ্কায় ফিরতে রাজি হয়নি রোহিঙ্গারা। গত ১৯ জানুয়ারি রোহিঙ্গাদের ফেরানোর বিষয়ে চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসে। সেখানে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের অঞ্চলভিত্তিক প্রত্যাবাসন চাইলেও মিয়ানমার ২০১৭ সালের করা চুক্তির পক্ষেই থাকে।
এনআই/এমএম/এইচকে