ভেজাল মদে কয়েকজনের মৃত্যুর পর অভিযানে নামে পুলিশ। ভাটারার একটি নকল মদ তৈরির কারাখানার ছবি।

এ সপ্তাহে দেশব্যাপী আলোচনায় ছিল মদের বিষক্রিয়ার মৃত্যুর বিষয়টি। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই শিক্ষার্থী ও একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার তিন কর্মীর রহস্যজনক মৃত্যুর পর ব্যাপারটি আলোচনায় আসে। এ ছাড়া কয়েকদিনের মধ্যে বগুড়াতেও ১৯ জনের মৃত্যুর কথা জানা গেছে।   

বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময় অ্যালকোহলজনিত মৃত্যুর খবর আসে। এ দফায় বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে মূলত  ইউল্যাবের ছাত্রীর মৃত্যুর পর। ওই ছাত্রী উত্তরায় একটি রেস্টুরেন্টে বসে বন্ধুদের সঙ্গে মদ পান করেছিলেন ও তারপরই অসুস্থ হয়ে যান বলে এখনও জানা যাচ্ছে। এছাড়া গাজীপুরে একটি রিসোর্টে বেড়াতে গিয়ে মদপান করে অসুস্থ হয়ে পড়েন বিজ্ঞাপনী সংস্থা ফোরথটের কয়েকজন। পরে তাদের মধ্যে ৩ জনের মৃত্যু হয়।  

এ দুই ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যুর পরেই দেশে ভেজাল মদ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। প্রশ্ন ওঠে। কারা কিভাবে তৈরি করছে ভেজাল মদ। পাশাপাশি জানা যায় ঢাকায় বিদেশি মদের সঙ্কটের বিষয়টি।

এ পাঁচজন ছাড়াও দেশব্যাপী ভেজাল মদে কমপক্ষে ৩০ জনের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটনের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ভেজাল মদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে। 

যে কারণে মদের সঙ্কট
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর রমনার একটি বারের মালিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিন-চারশগুন ট্যাক্স দিয়ে মদ আনলে বিক্রি করা কষ্টকর হয়ে পরে। তাই অনেকে মদ আমদানির লাইসেন্স নিয়ে হাতেগোনা কয়েকশ বোতল মদ বৈধভাবে আমদানি করে। আর অধিকাংশই বিমানবন্দরের যাত্রীদের লাগেজে অবৈধভাবে আসে। করোনাকালীন সময় প্রায় ৩ মাসের মতো বিমানবন্দর বন্ধ ছিল। এছাড়াও বিমানবন্দরে বর্তমানে আগের চেয়ে অনেক বেশি তল্লাশি করা হয়, স্ক্রিনিং করা হয়। তাই আগের মতো এখন আর কেউ মদ বহন করে না।

তিনি বলেন, মদের আমদানি কমলেও চাহিদা আগের মতোই আছে। বরং আরও বেড়েছে। এ কারণে অনেকেই লাইসেন্স করা বারে না এসে ব্যক্তিগতভাবে মোবাইলে বা ফেসবুকে ফোন দিয়ে অপরিচিতদের কাছ থেকে মদ কিনছেন। সে কারনেই তারা প্রতারিত হচ্ছেন। অনেকক্ষেত্রে বিষক্রিয়া হয়ে মারাও যাচ্ছেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনাকালীন সময় হয়তো মদের আমদানি ব্যাহত হয়েছে। সেই জন্য মদের একটা ক্রাইসিস দেখা দিয়েছে। এছাড়া হতে পারে যারা এতো দিন বিদেশ থেকে অবৈধ মদ আনতেন, তারা এখন সরকারিভাবে কড়াকাড়ি হওয়ায় মদ আনতে পারছেন না। আর এই সুযোগটা নিচ্ছেন ভেজাল মদের ব্যবসায়ীরা।

তবে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী এ ভেজাল মদ বাজারজাত করছিল, পুলিশ এরইমধ্যে তাদের চিহ্নিত করেছে। সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান মদ উৎপাদন করছে, তারা নিয়মিত উৎপাদন করছে, এছাড়া নিয়ম মেনে মদ আমদানিতে কোনো সমস্যা নেই বলেও জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

ভেজাল হচ্ছে কীভাবে? কারা করছে?
সম্প্রতি রাজধানীর ভাটারায় অভিযান চালিয়ে ডিবি দেখতে পায়, স্পিরিটের সঙ্গে পানি, রং, চিনির সিরা আর কিছু কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি করা হয় ভেজাল মদ। পরে এসব ভেজাল মদ নামীদামী ব্র্যান্ডের বোতলে ভরে চড়া দামে বিক্রি করা হয়। এই মদ প্রতিলিটার তৈরি করতে খরচ হতো ৫০-৬০ টাকা যা বাজারে বিক্রি হতো ৪-৫ হাজার টাকায়।  এসব ভেজাল মদে যথাযথভাবে রাসায়নি উপাদান না থাকায় তা পান করে বিষক্রিয়ায় মানুষ মারা যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো.শহিদুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউল্যাবের শিক্ষার্থীরা উত্তরার ব্যাম্বু শুট রেস্টুরেন্টে বসে মদ্য পানের পর দুই জন মারা যান। এরপর বিষয়টা নিয়ে খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি। রেস্টুরেন্টে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে জানার চেষ্টা করেছি মদ কিভাবে এলো। কারা সরবারহ করেছে সেটিও জানার চেষ্টা করেছি। পরে আমরা জানতে পারি বাইরে থেকে মদ এসেছিল রেস্টুরেন্টটিতে। পরে মাদক সেবনের জায়গা দেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, উত্তরায় যেসব রেস্টুরেন্ট লাইসেন্স ছাড়া মদ্য পানের অনুমতি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। এছাড়া যারা বাইরে থেকে ভেজাল মদ এনে দুর্ঘটনা ঘটাবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবো।  

ভেজাল মদের কারবারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? জানতে চাইলে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, ভেজাল মদের লাইসেন্স দেওয়া হয় না, আমরা দেই বৈধ মদের লাইসেন্স। যারা ভেজাল মদ বিক্রি করছেন সেই বিষয়গুলো আমরা নজরদারি করছি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ তথ্য দিচ্ছি। যেসব জায়গায় ভেজাল মদ বিক্রি হচ্ছে তার তথ্য আমরা পুলিশকে দিচ্ছি এবং পুলিশ অভিযান পরিচালনা করছে। তবে যাদের লাইসেন্স নেই তারা তো মদ বিক্রি বা পান করার জায়গা দিতেই পারবে না। এমন অভিযোগ যেসব জায়গায় পাওয়া যাবে তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।

গত কয়েকদিনে রাজধানীর উত্তরার বিভিন্ন হোটেল-বারে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। ধারাবাহিকভাবেই মঙ্গলবার, বুধবার ও বৃহস্পতিবার বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট ও বারে  অভিযান চালায় ডিএমপির উত্তরা বিভাগ পুলিশ। এ সময় অভিযানে মদের বোতলসহ আট জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এমএসি/এআর/এনএফ