বিস্মিত অজয় দাশগুপ্ত, কীভাবে পারলেন তিনি
অজয় দাশগুপ্ত
‘৪ ফেব্রুয়ারি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব আমাকে ফোন করলেন। জানালেন- সাংবাদিকতায় আমি একুশে পদক পাচ্ছি। ৫০ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছি। দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে কলম চালিয়ে যাচ্ছি। আমার এ কর্তব্য বিবেচনাকে সাধারণ মানুষ ভালোবেসেছেন, সমর্থন দিয়েছেন। একুশে পদকের সংবাদে বুঝলাম, সংবাদমাধ্যমে দেওয়া আমার শ্রম উচ্চপর্যায়েও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে পাওয়া এই সম্মান দেশবাসীর প্রতি আমার দায়বদ্ধতা আরও বাড়িয়ে দিলো।’
একুশ সালে একুশে পদকে মনোনীত জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা অজয় দাশগুপ্ত এভাবেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ঢাকা পোস্টের কাছে। করোনা পরিস্থিতিতে শুক্রবার (৫ ফেব্রুয়ারি) টেলিফোনে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘৫০ বছর খুব দীর্ঘ সময়। সাংবাদিকতার এই দীর্ঘ জীবনে আমি প্রলোভনে পড়িনি। ভাবলে বিস্ময় জাগে। কীভাবে পারলাম?’
বিজ্ঞাপন
আমি ভালোবাসার ‘প্রলোভনে’ আবদ্ধ। এটিই আমার চারপাশে পরিখা গড়ে দিয়েছে। একে টপকে আসার শক্তি জাগতিক লোভ-লালসার থাকে না।
অজয় দাশগুপ্ত
তিনি বলেন, ‘‘আসলে দেশের প্রতি ভালোবাসা, মানুষের প্রতি যে ভালোবাসা, এরচেয়ে বড় ‘প্রলোভন’ আর হতে পারে না। আমি এই ভালোবাসার ‘প্রলোভনে’ আবদ্ধ। এটিই আমার চারপাশে পরিখা গড়ে দিয়েছে। একে টপকে আসার শক্তি জাগতিক লোভ-লালসার থাকে না।’’
বিজ্ঞাপন
গত বছরের একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠানের ছবি
নিখাদ দেশপ্রেমের সবচেয়ে বড় প্রমাণ অজয় রেখেছেন ১৯৭১ সালে। হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। ছিনিয়ে এনেছেন স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তার আরও দুই ভাই। দেশপ্রেমিক এই ত্রিরত্নের মা তাই বরিশালে পরিচিত ‘মুক্তিযোদ্ধার মা’ হিসেবে।
যুদ্ধ শেষে অস্ত্র রেখে অজয় দাশগুপ্ত হাতে তুলে নেন কলম। এ যেন যুদ্ধ শেষে আরেক যুদ্ধের শুরু। সেই যুদ্ধ স্বাধীনতা রক্ষার। অন্যায়-অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। ১৯৭২ সাল থেকে এই কলমযোদ্ধা সম্পাদনা শুরু করেন ছাত্র ইউনিয়নের পত্রিকা ‘জয়ধ্বনি’। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। জয়ধ্বনিতে তখন আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করতেন পাভেল রহমান। পাভেলও এবার একুশে পদক পেয়েছেন।
যা প্রকাশ করতে আমাদের লিখতে হয় শব্দের পর শব্দ, ক্যামেরার কবি পাভেল তা প্রকাশ করেন এক ক্লিকেই।
অজয় দাশগুপ্ত
ক্যামেরাযোদ্ধা পাভেল রহমান রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ায় খুশি অজয় দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘ক্যামেরার কবি পাভেল রহমান। তিনি দারুণ এক ক্যামেরাযোদ্ধা। যা প্রকাশ করতে আমাদের লিখতে হয় শব্দের পর শব্দ, পাভেল তা প্রকাশ করেন এক ক্লিকেই। তার অনেক ছবি আমাদের ইতিহাসের অনন্য রত্ন। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গেঞ্জি পরা জাতির পিতার যে ছবিটি পাভেল তুলেছেন, সেটি আমার দারুণ প্রিয়। ছবিটি এদেশের অনাগত সন্তানদের কাছেও জাতির পিতাকে ঘরোয়া আমেজে পৌঁছে দেবে।’
অজয় দাশগুপ্ত ২০১৯ সালের ১৫ জুন পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন সংবাদপত্র জগতে। ২০০৫ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের ১৫ জুন পর্যন্ত তিনি দৈনিক সমকালে উপ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার আগে দৈনিক যুগান্তরে সহকারী সম্পাদক ছিলেন ২০০১ সালের জুলাই থেকে। তারও আগে দৈনিক মুক্তকণ্ঠে কাজ শুরু করেন ১৯৯৭ সালের মে মাসে। সেখানেও তিনি ছিলেন সহকারী সম্পাদক। তার আগে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ সালের মে পর্যন্ত দৈনিক সংবাদ-এ সহ-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯০ সালের মার্চ পর্যন্ত এপিএন-এ কাজ করেন তিনি। এর আগে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের জয়ধ্বনি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি।
আমি লিখে যেতে চাই
অজয় দাশগুপ্ত
অজয় দাশগুপ্ত এখন রাজধানীর গুলশানের নিকেতন আবাসিক এলাকায় বাস করছেন। ১৯৫০ সালের ৯ মার্চ বরিশালের আগৈলঝরার গৈলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। অজয় দাশগুপ্ত জানান, ‘পাঁচশ বছরের বেশি আগে কবি বিজয় গুপ্ত এ গ্রামেই রচনা করেন মনসামঙ্গল কাব্য। গৈলার কবীন্দ্র বাড়িটি সাহিত্যিক মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়ি।’
অজয় দাশগুপ্তর পড়াশোনা শুরু হয় গ্রামের ঐতিহ্যবাহী গৈলা ইংলিশ হাই স্কুলে। ওই স্কুলের বয়স এখন ১২৮ বছর। ১৮৯৩ সালের ২৩ জানুয়ারি স্কুলটির যাত্রা শুরু। তিনি জানান, ৫০ বছর পূর্ণ না হতেই স্কুলটি থেকে এক হাজার ৫ জন ছাত্রছাত্রী এন্ট্রান্স ও মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। গৈলা সে সময় ‘৩৬০ ঘর জমিদার-তালুকদারের’ জন্য পরিচিত ছিল। তাদেরই একটি অংশ অজয় দাশগুপ্তের পূর্বপুরুষেরা। তারা স্কুলটিকে কয়েক একর জমি হস্তান্তর করেন। বিদ্যালয়ের নিজস্ব ঘর হওয়ার আগে এই দাশের বাড়িতেই নেওয়া হতো ক্লাস। দাশের বাড়ির গর্বিত সদস্য অজয় দাশগুপ্ত গৈলা স্কুলের কৃতী ছাত্র। স্কুলটিতে একসময় শিক্ষকতাও করেছেন তিনি।
অজয় জানান, গৈলা ও তার আশপাশের এলাকা ছিল শিক্ষার আলোয় আলোকিত। এই আলোকিত জনপদ তার মানস গঠনে, দেশের প্রতি কর্তব্য নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে। সে সময় নারী শিক্ষার জন্য আলাদা প্রাথমিক বিদ্যালয়ও চালু হয় গৈলায়। গৈলা হাই স্কুলের অনেক ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে স্কুলটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ঘাঁটি।
যুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন যিনি, তিনি অজয় দাশগুপ্ত। অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যিনি হাতে তুলে নিয়েছেন কলম, অজয় দাশগুপ্ত তিনি। এখনও কলম হাতে দেশের নির্ভীক পাহারাদার তিনি। যিনি লিখে চলেছেন, বাতিঘর হয়ে জ্বলে আছেন যিনি, তার নামই অজয় দাশগুপ্ত। ‘গুজবের রাজনীতি’সহ উজ্জ্বল অনেক গ্রন্থের এই রচয়িতা করোনাকালেও গণমাধ্যমের ‘ফ্রন্টলাইনার’ হিসেবে কাটাচ্ছেন ব্যস্ত সময়। এখনও এই যোদ্ধা বলেন, ‘আমি লিখে যেতে চাই’।
পিএসডি/এইচকে