জাহানারা জামান (২৬ ডিসেম্বর ১৯৩৬-৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭), শহীদ জাতীয় নেতা এএইচএম কামারুজ্জামানের (২৬ জুন ১৯২৩-৩ নভেম্বর ১৯৭৫) সহধর্মিণী। তার ডাক নাম লাইলী। ১৯৫১ সালে তাদের দাম্পত্য জীবন শুরু। 

জাহানারা জামান বগুড়ার দুপচাপিয়া থানার চামরুল গ্রামের তালুকদার পরিবারে মেয়ে। আর বৈবাহিক সূত্রে তিনি রাজশাহী শহরের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম প্রধান নেতা এএইচএম কামারুজ্জামানের স্ত্রী। 

বিয়ের পর থেকেই স্বামীর রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের একজন সহযোগী। প্রকাশ্য রাজনীতির ময়দানে তিনি অনুপস্থিত। কিন্তু কামারুজ্জামানের রাজনৈতিক জীবনের নীতি ও আদর্শের একজন নির্ভেজাল সহযোদ্ধা। যদিও রাজশাহী শহর মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী হিসেবে তার নাম উল্লেখিত হয়। তথাপি তার সবচেয়ে বড় লড়াই ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামী কামারুজ্জামানের লড়াই সংগ্রামে সহযোদ্ধার কাজটি নিষ্ঠা ও আদর্শের সঙ্গে চালিয়ে যাওয়া। স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামীদের ইতিহাসে এরকম সহধর্মিণী বিরল নয় সত্য, তাই স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামীদের সহযোদ্ধা সহধর্মিণীদের বিভিন্নরূপে সংগ্রামে অংশগ্রহণ অনুল্লেখে ইতিহাস অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য। 

জামান দম্পতির জীবন আর দশটি সাধারণ দাম্পত্য জীবনের মতো ছিল না। কেননা এএইচএম কামারুজ্জামান রাজনীতিবিদ। রাজনৈতিক কার্যক্রমে তিনি সদা ব্যস্ত। যে সময়টিতে তাদের সংসার জীবনের শুরু সেই সময়টিও বাংলাদেশের ইতিহাসে উত্তাল সময়। তাই কামারুজ্জামানকে সারাক্ষণ রাজনৈতিক সংগ্রামে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। আর ছেলে-মেয়ে সংসারের যাবতীয় লড়াইটি জাহানারা জামানের ওপর বর্তে ছিল। স্বামীর সঙ্গে এভাবেই তার রাজনৈতিক সহযোদ্ধা হয়ে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা। 

রাজনৈতিক কারণে কামারুজ্জামান গ্রামে-গঞ্জে সংগঠনের কাজে ব্যস্ত, আবার একই কারণে রাজশাহীর বাইরে ঢাকা কিংবা করাচিতে থাকতে হয়েছে। অন্যদিকে উত্তাল দিনগুলোতে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব জাহানারা জামানকে সামলাতে হয়েছে। রাজনীতিবিদ স্বামীর স্থানীয় কর্মীদের সুখ-দুঃখেও তাকে পাশে দাঁড়াতে হয়েছে। এএইচএম কামারুজ্জামান যখন রাজশাহীতে অবস্থান করতেন তখনও সকাল থেকেই দল সংগঠন আর সভা-সমিতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। গভীর রাত পর্যন্ত জাহানারা জামান জেগে থাকতেন। আর ঘরে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা এবং আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত করে দেওয়ার কাজে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে করতেন। শহীদ কামারুজ্জামানও চমৎকার মানুষ ছিলেন। গভীর রাতে দরজার কড়া নেড়েই বলতেন, ‘লাইলী ঘুম থেকে ওঠো, মজনু তোমার বাহিরে দাঁড়িয়ে।’ এভাবেই হয়ত শহীদ কামারুজ্জামান তার সংগ্রামী সহযোদ্ধাকে ভালবাসায় সিক্ত করার চেষ্টা করতেন।  

বাংলাদেশের রাজনীতির উত্তাল কালপর্বে জাহানারা জামান তার স্বামীকে উল্কার মতো ছুটে বেড়াতে দেখেছেন। স্বামীর সঙ্গে একান্তে সময় কাটানোর সময় কোথায়! তিনি যে স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামে লিপ্ত। তাই তার আদর্শ ও চেতনার সহযোদ্ধা হিসেবে সংগ্রামে সহযোগিতা করাইতো এক ধরনের সংগ্রামে অংশগ্রহণ। তিনি তো শুধুমাত্র সহধর্মিণী নন বরং আদর্শবোধের শক্তভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে সহযোদ্ধা ও সহমর্মিণীও। তাই স্বামীর সংগ্রামী কর্মকাণ্ডের যাতে বিপত্তি না ঘটে সেদিকেই তার সচেতন প্রয়াস। তিনি প্রতিদিনই শিউলি ফুল কুড়াতেন আর তা টেবিলে সাজিয়ে রাখতেন। শিউলি ফুল তিনি ভালবাসতেন। এটি হয়ত তার সংগ্রাম মুখর জীবনে শিউলি ফুলকে ভালবেসে অব্যাহত লড়াইয়ের ময়দানে ক্ষণিক শান্তি লাভের প্রয়াস।

বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের একজন প্রত্যক্ষদর্শী জাহানারা জামান। তিনি দেখেছেন পাকিস্তানি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের জাতীয়তাবাদী মুক্তিসংগ্রাম কীভাবে স্বাধীনতার পথে ধাবিত হয়েছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তি-সংগ্রাম সংগঠনের প্রক্রিয়ায় তিনি একজন চাক্ষুস সাক্ষী। অত্যন্ত কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং দেশ কীভাবে শত্রুমুক্ত হচ্ছিল তাও তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশ পুর্নগঠনের প্রক্রিয়ায়ও তার স্বামী অগ্রগণ্য নেতা ছিলেন। আবার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থান এবং ৭৫’র নির্মম হত্যাকাণ্ডের (সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জেলা অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডসহ) তিনি সাক্ষী ও ভূক্তভোগী (ভিকটিম)। ৭৫’র হত্যাকাণ্ডের পর তার জীবনের অন্যরকম যে সংগ্রাম তৎকালীন প্রতিক্রিয়াশীলদের আধিপত্যের সমাজ বাস্তবতায় শুরু হয়েছিল তা নতুন প্রজন্ম আঁচ করতে পারবে না। 

শহীদ কামারুজ্জামানের সদ্য বিধবা স্ত্রী তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে আরেক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দুই ছেলেই তখন ভারতে পড়াশোনারত। তারা তাদের বাবার জানাজায়ও অংশগ্রহণ করতে পারেনি। অপরদিকে স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার মেয়েদেরকেও ভর্তি নিতে অপারগতা প্রকাশ করে। সেই দুঃসময়ে জাহানারা জামান নিজ সন্তানদের দু’হাতে আগলে রেখে ও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করে প্রমাণ করে গেছেন যে তিনি ছিলেন শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানের সহযোদ্ধা ও সহমর্মিণী। এইসব করতে গিয়ে তার সংগ্রামী দৃঢ়তা জাহানারা জামানের আদর্শবাদের শক্তিকেই প্রমাণ করে। অর্থাৎ তার এই দৃঢ়চেতা জীবন ও ইস্পাত কঠিন সংগ্রামের উৎস ভূমি ছিল আদর্শবাদ। 

শেষ জীবনে তিনি শিশুর মতো হাসতেন আর ছোট ছোট বাক্যে কথা বলতেন। ধীর পায়ে হাঁটাচলা করতেন। নিচুস্বরে অনেক সময় গল্প করতেন। তার এসব গল্পে অনেক বিষয় থাকত যা বাংলাদেশের ইতিহাসের অমূল্য উপাদান। আগস্ট মাস শুরু হলেই তিনি কেমন হয়ে যেতেন। এক ধরনের নিরবতা ও অস্থিরতা তার মধ্যে লক্ষ্য করা যেত। এই অবস্থা ডিসেম্বর পর্যন্ত চলতো। তিনি ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছেন সবসময়। হত্যাকারীদের কয়েকজনের ফাঁসিও দেখে গিয়েছেন। কিন্তু সবসময়ই বিশ্বাস করতেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ যদি বাংলাদেশের সামগ্রিক চর্চায় প্রোথিত না করা যায় তাহলে জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতাসহ মুক্তি সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করা শহীদের রক্ত বৃথা যাবে। যদিও তিনি বাংলাদেশের ক্রম-বর্ধমান আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে খুশি ছিলেন। জাহানারা জামান প্রকাশ্যে রাজনীতি করেননি ঠিকই, কিন্তু রাজনীতিকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন আদর্শবাদকে মাথায় রেখে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেই আদর্শবাদকে নিষ্ঠার সঙ্গে লালন ও ধারণ করেছেন। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন পরপারে। মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করছি।

সাদিকুর রহমান
পিএইচডি ও এক্সপার্ট অন কোয়ালিটিটিভ রিসার্চ, নরওয়ে