ছবি : সংগৃহীত

৭ মার্চ ১৯৭১ সম্ভবত ইতিহাসের একটি মাত্র দিন, যা সংজ্ঞায়িত হয়েছে একটি মাত্র ভাষণের দ্বারা এবং বাংলার মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণই হয়ে আছে ইতিহাসের প্রবেশদ্বার। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস তৎকালীন উপমহাদেশে বিরাজমান দুটো শক্তিশালী রাজনৈতিক দর্শনের বাইরে এসে এক নবতর রূপ লাভ করেছিল এবং কী আশ্চর্য, তা সমান্তরালে হেঁটে এসে উন্নীত হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজনীতির ধারাবাহিকতায় সিভিল সমাজের যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, মধ্যপন্থী রাজনীতির মধ্য দিয়ে তা রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই হিসেবে বিকশিত হয়। অন্যদিকে বামপন্থী রাজনীতি তৈরি করেছিল মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। রাজনৈতিক দর্শনের এই দুই ধারার সঙ্গে যোগ হয়েছিল আটচল্লিশ সাল থেকে শুরু হওয়া বাংলার মানুষের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই, জন্ম দিয়েছিল একটি নতুন রাজনৈতিক দর্শনের, যার লক্ষ্য– বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা।

এই রাজনৈতিক দর্শনকে প্রেক্ষণে রেখে বাঙালি যে স্বাধীনতার লড়াই শুরু করেছিল, সে ক্ষেত্রেও তাদের সামনে দুটো স্বতন্ত্র ধারার উদাহরণ ছিল– এক. গান্ধীর অহিংস-অসহযোগ ও নিরস্ত্র প্রতিরোধ এবং দুই. নেতাজী সুভাষ বসুর সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম।

বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস পাঠ করলে বোঝা যায়, সময়ের প্রয়োজনে বাঙালি এ দুই ধারার মণিকাঞ্চন যোগে রচনা করেছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, যেখানে সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিপন্ন আঙুলের ছাপ জমা রাখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর কাছে এবং সেই তর্জনী একটি জাতির ইতিহাসের সরণচিহ্ন নির্দেশ করেছিল একাত্তরের ৭ মার্চে– তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের অবিনশ্বর ভাষণে।

আনুমানিক দশ লাখ মানুষের সামনে প্রায় এক হাজার একশত সাত শব্দের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু ১১টি নির্দেশ প্রদান করেছিলেন এবং এই নির্দেশগুলোই বাংলার মানুষকে একটি দেশের দিকে এগিয়ে নিয়েছে। পৃথিবীর আর কোনো ভাষণের নির্দেশ অনুসরণ করে কি কোনো জাতি স্বাধীন দেশ পেয়েছিল? 

আনুমানিক দশ লাখ মানুষের সামনে প্রায় এক হাজার একশত সাত শব্দের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু ১১টি নির্দেশ প্রদান করেছিলেন এবং এই নির্দেশগুলোই বাংলার মানুষকে একটি দেশের দিকে এগিয়ে নিয়েছে।

পাকিস্তানের বর্বর সরকারব্যবস্থা বঙ্গবন্ধুকে নিজেদের প্রধান শত্রু বিবেচনা করত। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ছিল একমাত্র বাংলার আপামর সাধারণ মানুষ। জনতার সমর্থনের পাটাতনে দাঁড়িয়েই তৎকালীন সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে তিনি এই ওজস্বী ভাষণ দিয়েছিলেন, দিয়েছিলেন তার নিজের, তার দল আওয়ামী লীগের এবং বাঙালি জাতির অস্তিত্ব থাকা না-থাকার প্রশ্নটি মাথায় রেখে। সেদিনের যেকোনো অসতর্ক উচ্চারণ ইতিহাস থেকে একটি জাতির অভ্যুদয়ের সংগ্রাম ছিটকে ফেলতে পারত– এ কথা আজ স্ফটিকস্বচ্ছ।

একাত্তরের সাতই মার্চ লাখ লাখ জনতা রেসকোর্সে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে নির্দেশ নিতে, তার সিদ্ধান্ত জানতে। বঙ্গবন্ধুকে ভাষণটি দিতে হয়েছিল পক্ষশক্তি, প্রতিপক্ষ, মিত্রশক্তি ছাড়াও বিশ্বের নিরপেক্ষ জনমতের কথা মাথায় রেখে। একদিকে লাঠি হাতে প্রতিরোধের প্রত্যয়ে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে আসা জনতা, অন্যদিকে বর্বর, চতুর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, যারা যেকোনো ছুতায় বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলন’ বলে প্রচার করতে মুখিয়ে আছে– এই দুই রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মূলবিন্দুতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণটি দিয়েছিলেন, যাতে শেষ পর্যন্ত জনগণের আকাঙ্ক্ষার সার্থক প্রতিফলন ঘটেছিল।

দূরদর্শী বঙ্গবন্ধুর সামনে উদাহরণ হিসেবে ছিল বায়াফ্রার রাজনীতি (১৯৬৭) এবং তার কৃষ্ণাঙ্গ নেতা ওজুকো এমেকা। স্বাধীনতার জন্য অসংখ্য বায়াফ্রান তরুণ অকাতরে প্রাণ দিলেও তারা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেননি, আজও বায়াফ্রা নাইজেরিয়ার একটি প্রদেশ হিসেবেই টিকে আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতায় ভর করে সাতই মার্চের পর বাঙালি হেঁটে গেছে স্বাধীনতার সূর্যদীঘল পথে।

৭ মার্চের ভাষণে পাঁচটি ভিন্ন বাঁকে বাঙালির সংগ্রামের উৎস ও সমাপ্তি-বিন্দু রচনা করেছেন বঙ্গবন্ধু। শুরু করেছেন সারা দেশের মানুষের আত্মত্যাগ স্মরণ করে এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি তার ও বাঙালির সহজাত পক্ষপাতের কথা দিয়ে। এরপরই উন্মোচিত করেছেন বাঙালির প্রতি পাকিস্তানি বর্বর শাসকদের বঞ্চনা আর প্রতারণার চিত্র। একই সূত্রে তিনি উল্লেখ করলেন ভুট্টোর কূটকৌশল এবং বাংলার মানুষকে অভিযুক্ত করার যে হীন চক্রান্ত পাকিস্তানিরা করেছে, সে বিষয়েও তিনি উপস্থিত জনতার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।

এরপরের বাঁকটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালির শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্রমূলক ভূমিকার কথা জানালেন। জবাব দিলেন সব অভিযোগের এবং প্রতিবাদ করলেন বাংলার মানুষের ওপর পাকিস্তানিদের হত্যা আর নির্যাতনের।

এরপর তিনি দেশবাসীর মুখোমুখি দাঁড়ালেন, তার দৃঢ়কণ্ঠ তখন সাত কোটি বিপন্ন কোকিলের কণ্ঠ; তিনি দৃপ্তস্বরে উচ্চারণ করলেন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জন্য শর্ত এবং বাংলার মানুষের প্রতি নির্দেশনামা। শাসকগোষ্ঠীর প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন, একই সঙ্গে সতর্ক করলেন বাংলার জনতাকেও।

জনসাধারণকে প্রস্তুতি নিতে বললেন চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য এবং সাধারণভাবেই বঙ্গবন্ধু কাঁধে তুলে নিলেন বিকল্প সরকারের ভূমিকা। করণীয় জানালেন, জানালেন অকরণীয়সমূহও। সবশেষে, জনতার উদ্বেল আকাশে তিনি জ্যা-মুক্ত করলেন ধনুকের তীর:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

মোট ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তিনি রেখেছেন এই ভাষণে, যার মধ্যে পাঁচটি বাঙালির রাষ্ট্রগঠনের সঙ্গে জড়িত এবং একটি গঠিত রাষ্ট্রে জনসাধারণই যে সব ক্ষমতার উৎস– তার ইঙ্গিত বহন করে।

এই বাক্যই আমাদের ইতিহাসের ‘বুকমার্ক’, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মসনদ এবং আমাদের জাতীয় জীবনের রাজনৈতিক অভিধানের চূড়ান্ত সংস্করণ। কেননা বঙ্গবন্ধু কেবল স্বাধীনতার কথাটি বলেননি, তিনি উচ্চারণ করেছিলেন মুক্তির কথা। স্বাধীন বাংলাদেশে কতটা ‘মুক্তি’ এসেছে– এ প্রশ্ন এখনো হয়তো প্রাসঙ্গিক, কিন্তু এই আলোচনা আমরা জনগণ কার সঙ্গে করব? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রূপকার্থে হলেও সাতই মার্চ আমাদের রেফারেন্স।

মোট ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তিনি রেখেছেন এই ভাষণে, যার মধ্যে পাঁচটি বাঙালির রাষ্ট্রগঠনের সঙ্গে জড়িত এবং একটি গঠিত রাষ্ট্রে জনসাধারণই যে সব ক্ষমতার উৎস– তার ইঙ্গিত বহন করে। একটি প্রশ্ন ছিল, ‘আমার উপর বিশ্বাস আছে?’

উপস্থিত জনতা লাঠিসমেত হাত শূন্যে তুলে ইতিবাচক সাড়া দেয়, তারপর বঙ্গবন্ধু বাকি বক্তব্য রাখেন। ভাষণের এই বাক্যটি সন্দর্ভের অতিরিক্ত এবং স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পয়ার মিছিলের অন্তর্গত।

জনসাধারণের সঙ্গে নেতার যে পারস্পরিক বিশ্বাসের সম্পর্ক এবং উভয়পক্ষেই তা অর্জন সাপেক্ষ– এই সত্য আত্মস্থ করতে পারিনি বলেই বর্তমান রাজনীতি আর গণমানুষের মাঝখানে এখন উচ্ছিষ্ট আর মধ্যস্বত্বভোগীদের তাণ্ডব নৃত্য। সুতরাং আজকের দিনে জনসাধারণের সামনে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ এমন একটি প্রশ্ন করার অধিকার বা সাহস কোনো রাজনীতিবিদের নেই; করলেও গণমানুষ এক সুরে ইতিবাচক সাড়া দেবে না।

বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ শেষ করেন মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী শব্দ-যুগল উচ্চারণ করে: ‘জয় বাংলা’। অর্থাৎ বেথোফেনের পঞ্চম সিম্ফনিতে তিনি আরোপ করেন এক ছেদচিহ্ন। কার্যত সাতই মার্চের ভাষণে তিনি বাঙালির কানে ঢেলে দেন অনাগত হাজার বছরের গদ্যলিপি।

এই গদ্যের উত্তরাধিকার হয়ে আজ যখন দেখি আমাদের রাজনীতি ঘরছাড়া, তখন জাতির জনককে কেবলই একজন স্থিতপ্রজ্ঞ দার্শনিক মনে হয় না। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর আজ সাতই মার্চের সেই অনন্য শব্দ-ম্যুরালের সামনে দাঁড়ালে মনে হয়, এ যেন আমাদের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’।

সমাকীর্ণ অন্ধকার দেশে আমাদের জাতির পিতা, তবু স্থিত দামিনী এবং শেষ বিচারে তারই উচ্চারিত ‘মুক্তির সংগ্রামের’ একমাত্র অধিনায়ক।

মারুফ রসূল ।। ঔপন্যাসিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্লগার