ছবি : সংগৃহীত

গাহি সাম্যের গান। চাই সমতা। সমান সুযোগ।

প্রসঙ্গ যখন নারী ও পুরুষ—তখন গলা ফোলানো শ্লোগানে এইসব শব্দমালা শোনা যায় বেশ। কিন্তু আদতে পুরো পরিস্থিতি ভিন্ন। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং কর্মজীবনের হাতেগোনা কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী চরম বৈষম্যের শিকার।

এমনকি আমাদের ক্রিকেটও এই বৈষম্যের বাইরে নয়।

একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই চিত্রটা পরিষ্কার হবে। মাত্র বছর তিনেক আগেও ঘরোয়া ক্রিকেটে মেয়েদের ম্যাচ ফি ছিল মাত্র ৫০০ টাকা। গণমাধ্যমে এই নিয়ে লেখালেখির পর টাকার সেই অঙ্ক কিছুটা বাড়ল; হলো ৬০০ টাকা!

বুঝুন, সারাদিন ক্রিকেট মাঠে কাটিয়ে দিন পার করা একটা মেয়ের আয় মাত্র ৬০০ টাকা! এই হিসাব ঘরোয়া ক্রিকেটের। এবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একটু খোঁজখবর দেই। ২০০৭ সাল থেকে নারীদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের পদচারণা। অথচ আন্তর্জাতিক একটি ম্যাচ খেলে এক মেয়ের ম্যাচ প্রতি আয় মাত্র ১০০ ডলার।

অযত্ন-অবহেলা-উপেক্ষার সেই সময়গুলো দাঁতে দাঁত চেপে খেলার প্রতি টান ও ভালবাসার তাগিদে নারী ক্রিকেটাররা তবুও ক্রিকেট নিয়েই পড়ে ছিলেন। চরমভাবে আর্থিক উপেক্ষার শিকার এই মেয়েদের হাত ধরেই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো পেল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ট্রফি। সময়টা ২০১৮ সাল।

সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং কর্মজীবনের হাতেগোনা কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী চরম বৈষম্যের শিকার।

সেই বছর নারীদের টি-টুয়েন্টি এশিয়া কাপ ক্রিকেটের শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। ফাইনালে হারায় শক্তিশালী এবং হট ফেভারিট ভারতকে। সেই সময় বাংলাদেশের ১৯জন নারী ক্রিকেটার বিসিবির বেতনভুক্ত ক্রিকেটারের তালিকায়। এই তালিকায় থাকা নারী ক্রিকেটাররা তিন গ্রেডে বেতন পেতেন। সর্বোচ্চ গ্রেডে থোক বেতন ছিল ৩০ হাজার টাকা। দ্বিতীয় গ্রেডে ২০ হাজার এবং শেষ গ্রেডে ১০ হাজার টাকা মাত্র। এই হিসাব মাসের ভিত্তিতে।

এবার আরেকটা হিসাব দেই। যে ভারতীয় দলকে বাংলাদেশ সেই এশিয়া কাপে হারিয়ে শিরোপা জেতে তাদের বেতন কাঠামোর দিকে একটু তাকাই। ব্যবধান জানাচ্ছে, সর্বোচ্চ গ্রেডে বেতন পাওয়া বাংলাদেশি নারী ক্রিকেটারদের চেয়ে ভারতীয় নারী ক্রিকেটারদের বার্ষিক বেতনের পার্থক্যের পরিমাণ প্রায় ৫৬ লাখ টাকা! হয়তো এতক্ষণে আপনি বলতে পারেন ভারতের সঙ্গে কেন তুলনায় যাচ্ছি।

আচ্ছা যাক, সেই তুলনা বাদ দিলাম। ঠিক সেই সময় বাংলাদেশের পুরুষ দলের সর্বোচ্চ গ্রেডে থাকা ক্রিকেটাররা শুধু কত টাকা বেতন পেতেন, আপনি জানেন?

-মাসে ছয় লাখ টাকা!

নারীদের ৩০ হাজার থেকে পুরুষদের ৬ লাখ বিয়োগ দিন। কী পেলেন? এটাকে কী পার্থক্য বলবেন নাকি বৈষম্য; সেই সিদ্ধান্ত আপনার।

স্বস্তির বিষয় হলো, সেই বছর এশিয়া কাপের শিরোপা জেতায় পুরস্কার হিসেবে নারী ক্রিকেটারদের তিন স্তরের বেতন গ্রেডেই কিছুটা বদল আসে।

৩০ হাজার উন্নীত হয় ৫০ হাজারে। ২০ হাজার গ্রেডে থাকারা পান ২৫ হাজার। গেল বছর এই বেতন বৃদ্ধির পরিমাণ আরও ২০ শতাংশ বাড়ায় বিসিবি। সেই সঙ্গে বাড়ে ম্যাচ ফি’র পরিমাণও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ম্যাচ ফি ১০০ ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়াল ৩০০ ডলারে। যা এখনো বহাল আছে।

একটু জানিয়ে দেই, ঠিক এই সময় একটি আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচ খেলে বাংলাদেশের একজন পুরুষ ক্রিকেটার পান ৩,৫০০ ডলার বা ৩ লাখ টাকা। একটি টি-টুয়েন্টি খেললে তার ব্যাংকে জমা হয় ২,৩০০ ডলার বা ২ লাখ টাকা।

যে ভারতীয় দলকে বাংলাদেশ সেই এশিয়া কাপে হারিয়ে শিরোপা জেতে তাদের বেতন কাঠামোর দিকে একটু তাকাই। ব্যবধান জানাচ্ছে, সর্বোচ্চ গ্রেডে বেতন পাওয়া বাংলাদেশি নারী ক্রিকেটারদের চেয়ে ভারতীয় নারী ক্রিকেটারদের বার্ষিক বেতনের পার্থক্যের পরিমাণ প্রায় ৫৬ লাখ টাকা!

পার্থক্য আপনি এবার বের করে নিন। কোথায় সাড়ে তিন হাজার ডলার আর কোথায় তিনশ ডলার!

আচ্ছা এবার টাকা-কড়ির হিসাব বাদ দেই। একটু টাইম লাইনে ফিরি।

২০০৭ সাল : আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ নারী দলের অভিষেক।

২০১১ সাল : ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেল বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। এবং সেই বছরই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বাছাই পর্বে খেলল। নারীদের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সেই বাছাই পর্বে বাংলাদেশ পঞ্চম হলো। ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্নটা আটকে গেল সেখানেই।

২০১৪ সাল : প্রথমবারের মতো নারীদের টি- টুয়েন্টি বিশ্বকাপেও খেলে ফেলল বাংলাদেশ।

২০১৮ সাল : নারীদের এশিয়া কাপ ক্রিকেটের শিরোপা জিতল বাংলাদেশ। একটু জানিয়ে দেই, ফাইনালে বাংলাদেশ হারায় শক্তিশালী ভারতকে।

২০২১ সালের, ২ এপ্রিল : বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল টেস্ট স্ট্যাটাস পেল। এতদিন বিশ্বের ১০টি দেশ নারীদের টেস্ট ক্রিকেট খেলত। অভিজাত সেই তালিকায় যোগ হলো বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ে এবং আফগানিস্তানের নামও।

২০২১ সালের, ২৭ নভেম্বর : জিম্বাবুয়েতে বাছাই পর্বে খেলতে থাকা বাংলাদেশ এইদিন সুখবর শুনে ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা তারা অর্জন করেছে।

২০২২ সালের, ৫ মার্চ : ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অভিষেক এইদিন। প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা।

২০০৭ সাল থেকে ২০২২। এই সময়কালে মেয়েদের ক্রিকেটে বাংলাদেশের উত্থানপর্ব এবং সাফল্য অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু যে মর্যাদা, আস্থা, যত্ন ও সম্মান নিয়ে নারী দলের ক্রিকেটকে পরিচর্যা করা প্রয়োজন ছিল-তা কি আমরা করেছি, করতে পেরেছি, করতে চেয়েছি কি?

যদি করতেই চাইতাম তাহলে আজও কেন মেয়েদের জন্য পৃথক কোনো ক্রিকেট একাডেমি হলো না। এক বছর আগে বাংলাদেশ নারী দল টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের নারী দল যে দুদিনের ম্যাচই খেলেনি। বড় ধৈর্যে চারদিনের টেস্টের সঙ্গে কীভাবে নিজেদের তারা মানিয়ে নিতে পারবে- সেটা বড়ই আশঙ্কার প্রশ্ন।

পেছনের ১৫ বছরে মেয়েদের ক্রিকেটের জন্য যেরকম সুনির্দিষ্ট একটা কাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন ছিল, সেটা নেই। মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো মাঠ নেই। জিমনেশিয়াম নেই। একাডেমি নেই। বছর জুড়ে তেমন কোনো দ্বিপাক্ষিক সিরিজও নেই।

এতকিছু নেই-এর মধ্যে একটা কিন্তু বিসিবির অগাধ আছে; টাকা!

এম. এম. কায়সার ।। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রাইজিংবিডি ও ক্রিকেট বিশ্লেষক