ছবি : সংগৃহীত

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবরই বলে থাকেন যে, নারীরা আমাদের সমাজের স্তম্ভ এবং আমাদের গর্ব। তার সরকার মহিলাদের ক্ষমতায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় এক দশকের বেশি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ করে চলেছেন এবং কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তার উন্নতি এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণে গ্রামীণ মহিলাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে সফলও হয়েছেন।

তিনি বাংলায় অধিষ্ঠিত প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রীরও। এছাড়াও সাতবার লোকসভায় নির্বাচিত তিনি ভারত সরকারের মন্ত্রিসভায় প্রথম মহিলা রেলমন্ত্রী, কয়লা মন্ত্রী, মানবসম্পদ উন্নয়ন, যুব বিষয়ক, ক্রীড়া, মহিলা ও শিশু উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। প্রত্যেক মহিলা যাতে সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পান তা নিশ্চিত করতে পার্টি সদস্যদের মোট ৩৪১টি ব্লকে ছোট ছোট 'সহেলী সভার' আয়োজন করতে বলা হয়েছে। যাতে বিভিন্ন ধরনের স্কিমের সুবিধাগুলো মহিলারা সহজে পেতে ব্যাপক সামাজিক মিডিয়া প্রচারাভিযান সচল থাকে।

ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক পুনর্বাসন এবং শিক্ষা সম্পর্কিত প্রায় ২৫০টি মহিলা কেন্দ্রিক প্রকল্পের সাথে সজ্জিত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেসের 'মহিলা মোর্চা' (মহিলা শাখা)-কে তাদের প্রচার-প্রচারণা জোরদার করতে সর্বদা উৎসাহিত করে থাকেন। আনুমানিক ৩.৩৯  কোটি মহিলা ভোটারসহ, ভোটারদের ৪৮.৫ শতাংশ মমতার 'কন্যাশ্রী পরিকল্পনা', 'রূপশ্রী পরিকল্পনা', স্বাস্থ্য সাথী স্বাস্থ্য বীমা কার্ড এবং 'সবুজ সাথী'-এর মতো স্কিমের নতুন রূপ বছরের বছর বিধানসভা নির্বাচনে জেতার পক্ষে কাজ করে আসছে।

তিনি রাজ্য কংগ্রেস সভাপতির পদের জন্য নির্বাচনের দাবি করার সিদ্ধান্তের জন্য অপমানিত বোধ করার কথা স্বীকার করার পরেও রাজনীতিতে একমাত্র মহিলা হিসেবে ১৯৯৮ সালে নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেছেন, ব্যতিক্রমী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় তার সম্পর্কে লিখেছেন যে, তার সাফল্য ‘তার নিজের সংগ্রামের ফলাফল’।

২০১১ থেকে যখন তিনি রাজ্যে ৩৪ নিরবচ্ছিন্ন বছর ক্ষমতায় থাকা কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া মার্কসবাদী নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারকে ধ্বংস করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দুই মেয়াদের পর তুমুল প্রতাপশালী বিজেপিকে পরাস্ত করে তিনি এখনো  তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতা ধরে রেখেছেন।

১৯৮৪ সাল থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন জাতীয় স্তরের নেতা ছিলেন, যখন তিনি সিপিআই-এম নেতা সোমনাথ চ্যাটার্জিকে পরাজিত করার পর প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন যিনি পরে লোকসভার স্পিকার ছিলেন। তিনি সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের সভাপতিও ছিলেন। তিনি তার সাহস এবং নির্ভীকতা এতবার প্রদর্শন করেছেন যে, তাকে এখনো ‘স্ট্রিট ফাইটার’ বলা হয়।

জয়প্রকাশ নারায়ণ যখন ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন সংগঠিত করছিলেন, তখন তিনি তার ক্যাডারদের   সামনে নিজেকে ছুঁড়ে ফেলে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের কলকাতা সফরের সময়, তিনি সংসদ নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর ইন্দিরা গান্ধীকে রক্ষা করার জন্য কালো পতাকা ধারণ করে প্রতিবাদ করেছিলেন।

১৯৯৩ সালে তিনি একজন বধির ও মূক মেয়ে ধর্ষণের শিকারের বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ করতে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করেন। তিনি ন্যায়বিচারের দাবিতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর চেম্বারের সামনে ধর্নায় বসেছিলেন, যার শেষ পরিণতিতে রাজ্যবাসী দেখেছিল পুলিশ তাকে চুল ধরে টেনে নিয়ে অবশেষে তালাবন্দি করেছিল। তিনি সর্বদা মহিলাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, সেই কারণেই, ২০১১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম প্রধান ফোকাস ছিল মহিলাদের উন্নতি এবং ক্ষমতায়ন। তাই বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে মমতা রাজ্য সরকারের মাধ্যমে গ্যারান্টি দিয়েছে যে, রাজ্যের মহিলারা মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করবে।

কন্যাশ্রী এমন একটি প্রকল্প যা ইউনিসেফ এবং ইউকে ডিপার্টমেন্ট অফ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট দ্বারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারা নেওয়া একটি উদ্যোগ যা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও যারা উচ্চশিক্ষার খরচ বহন করতে পারে না এমন মেয়েদের উন্নত জীবন ও সামাজিক মর্যাদা তৈরি করতে সাহায্য করছে। এখনো অবধি প্রায় ৭০ লাখ মেয়ে এই প্রকল্প থেকে উপকৃত হয়েছে। স্কিমের দুটি উপাদান রয়েছে, বার্ষিক বৃত্তি এবং এককালীন অনুদান।

এই স্কিমের উদ্দেশ্য খুবই সহজ করা হয়েছে যাতে এই প্রকল্প অতিমাত্রার সুযোগ নিয়ে মহিলারা উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণ করেন এবং বাল্যবিবাহের শিকার না হন তা নিশ্চিত করা। বিয়ের কথা বলতে গেলে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবারের মেয়ে বা মহিলাদের বিয়ে করার জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য রূপশ্রী পরিকল্পনা প্রকল্পও চালু করেছে।

এই স্কিমের অধীনে, সরকার মেয়েটির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরাসরি ২৫,০০০ টাকা এককালীন আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। যেখানে কন্যাশ্রী মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার প্রচার করে, রূপশ্রী তাদের বিবাহ সংক্রান্ত সহায়তার প্রদান করে। ২০১৮ সাল নাগাদ প্রায় ১.২৬  লাখেরও বেশি পরিবার তাদের মেয়েদের বিয়ের জন্য এই স্কিমের আওতায় আর্থিক সাহায্য পেয়েছে।

শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি মেয়ে যাতে উচ্চশিক্ষায় সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করতে রাজ্য সরকার বিশেষ করে মহিলাদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ও তৈরি করছেন। সবুজ সাথী প্রকল্পের অধীনে, এক কোটিরও বেশি শিক্ষার্থীকে সাইকেল দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৩৭ লাখ মেয়েকে স্কুলে আসার যাওয়ার জন্য দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহিলাদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবহনের ব্যবস্থা করতে শহরে ‘পিঙ্ক ক্যাবস’ চালু করেছেন। মহিলাদের দ্বারা এবং তাদের জন্য চালিত এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য মহিলাদের ড্রাইভিং পেশায় থেকে নিজেদের স্বনির্ভর থাকতে উত্সাহিত করা। তিনি নারীর কণ্ঠস্বর সংসদে পৌঁছার বিষয়ও নিশ্চিত করেছেন। অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস (আইটিসি) থেকে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রার্থীদের মধ্যে ৪১ শতাংশ মহিলা নির্বাচন করেছিলেন। তাইতো ৩৫ শতাংশ মহিলা এমপি থাকার জন্য তিনি সবসময় তার দল নিয়ে গর্ব করেন।

অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস (আইটিসি) মহিলা প্রার্থীদের জন্য স্থানীয় সংস্থাগুলিতে ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষিত করেছে। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য তার কাজ করার চেতনা, বিশেষ করে যারা সুবিধাবঞ্চিত এবং দরিদ্র পটভূমি থেকে এসেছেন তাদের সবকিছুই আধুনিক নারীবাদের জন্য তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে গ্রামীণ মহিলাদের ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করছে, সামাজিক সংহতির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে 'আনন্দধারা' প্রকল্পের সাফল্যের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। ২০১২ সালে শুরু হওয়া এই স্কিমটি মহিলাদের স্ব-সহায়ক গোষ্ঠীতে (SHG) সংগঠিত করে বাস্তবায়িত হয়। 'আনন্দধারা' প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তার উন্নতি এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণে গ্রামীণ মহিলাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদানকে উৎসাহিত ও সাহায্য দেওয়া হয়।

নারীদের প্রাধান্য দিয়ে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্বাস্থ্য সাথী নামে পরিবার প্রতি বার্ষিক ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মাধ্যমিক এবং তৃতীয় পরিচর্যার জন্য একটি মৌলিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এই স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্য সরকারকে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের জন্য বছরে ২,০০০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের স্বতন্ত্র ফোকাস মহিলাদের এবং কন্যা শিশুকে লক্ষ্য করে উন্নয়ন কৌশলগুলো চালু করার উপর পশ্চিমবঙ্গে তার উত্তরাধিকার ধাবিত হয়ে আসছে এবং থাকবে। কৌশল হলো ভাবনার সাথে নারী উন্নয়ন নীতি যা ঘরে, সমাজে এবং সময়ের সাথে সাথে নারী এবং কন্যা শিশুর অবস্থার গতিশীলতা পরিবর্তন করে। এই নীতিগুলো— কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবুজ সাথী এবং স্বাস্থ্য সাথী — মহিলাদের এমন পছন্দ করার অধিকার দেয় যা তাদের নিজের জীবনে, তাদের পরিবারে এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে।

নারীদের সমস্যা বুঝে তাদের পাশে দাঁড়ানো মতো একজন নারী সেনা হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতিতে পুরুষদের চেয়ে বেশি সফল একথা তার কাজই যেন প্রমাণ করে দেয়।

নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক