বিশ্বব্যাপী বঙ্গবন্ধুর পরিচিতি হচ্ছে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে। দেশ বরেণ্য, বিশ্ব বরেণ্য রাজনীতিবিদ। মানব প্রেমী, অনন্য সাধারণ একজন রাজনীতিবিদ যিনি তাঁর জীবদ্দশায় নির্যাতিত-নিপীড়িত, নিষ্পেষিত বাঙালি নামক একটি জনগোষ্ঠীকে চির দিনের জন্য মুক্ত-স্বাধীন করে গেছেন। মুজিব মানে বাংলাদেশ। মুজিবের জীবন সংগ্রাম-ই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম, বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম। সার্থক ভাবেই ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ প্রথমে বলেছিলেন মুক্তির কথা তারপর স্বাধীনতা। মুক্তির প্রয়োজনেই স্বাধীনতা। স্বাধীন তিনি আমাদের করে গেছেন কিন্তু সকল প্রকার শোষণ থেকে মুক্ত করার সুযোগ তিনি পাননি। ওই কর্মসূচি ঘোষণার সাথে সাথেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেননি। প্যালেস্টাইন, ভিয়েতনামসহ যেখানেই মুক্তির জন্য সংগ্রাম চলেছে সেখানেই বঙ্গবন্ধু অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। মানবতাবাদী এই মহান নেতার হৃদয় ছিল আকাশের মতো উদার। মানবতা বিপন্ন দেখলেই তার কণ্ঠস্বর সোচ্চার হতো।

ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালির অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বাঙালিদেরকে কখনো পাকিস্তানের পূর্ণ নাগরিকের মর্যাদা দেয়নি। স্বার্থান্ধতা তাদেরকে এতই নিষ্ঠুর ও নির্মম করেছিল যে বাংলাদেশের সমস্ত সম্পদের বিনিময়ে তারা পাকিস্তান গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করতে থাকে। আর ওই বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে বাঙালি কণ্ঠ সবচেয়ে সোচ্চার ছিল, যিনি হৃদয় দিয়ে বাঙ্গালীর এই গভীর সংকট মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন এবং বাঙালিত্ব যাতে পাকিস্তানের শক্তিতে বিলীন হয়ে না যায়, সেই লক্ষ্যে সচেতনভাবে জাতীয় চেতনার উপর ভিত্তি করে জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন এবং সর্বোপরি সেই জাতিসত্তাকে একটা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শেখ মুজিব। আপামর বাঙালির মুজিব ভাই, বঙ্গবন্ধু, জাতির জনক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক, বাংলাদেশের স্বাধীনতার রাখাল রাজা।

ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালির অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বাঙালিদেরকে কখনো পাকিস্তানের পূর্ণ নাগরিকের মর্যাদা দেয়নি।

তার রাজনীতির মূল প্রাণশক্তি ছিল ভালোবাসা। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও যে বাঙালি নির্ভীক চিত্তে বাঙালির জয়গান গেয়েছেন, স্বাধীনতার স্বপ্ন, মুক্তির সংগ্রাম আর বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন তিনি। তিনি জানতেন বাঙালিকে স্বাধীন করতে হলে কি ধরনের মূল্য দিতে হবে। জীবনপণ সংগ্রাম করতে হবে। কেউ তাকে দাবায়ে রাখতে পারেনি। খোকা, ‘মুজিব’ থেকে সংগ্রামের মাধ্যমেই ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার একমাত্র কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুরই।

স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর, বাঙালির জীবনে প্রকৃত স্বাধীনতার সুফল আনতে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের ঘোষণা করেন। নিজ দলের অনেকেই এ সময়ে প্রকাশ্যে তাঁর বিরোধিতা না করলেও অকুণ্ঠ সমর্থন জানাননি। তিনি জানতেন মহা বিপদের সম্মুখীন তাকে হয়তো হতে হবে। সবকিছু অগ্রাহ্য করে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তিনি জাতীয় সংসদে সমাজ বিপ্লবের কর্মসূচি পাস করেন। বিশ্বের ইতিহাসে আর কোনো রাজনীতিবিদ এমনটি করতে সক্ষম হয়েছেন কিনা সন্দেহ।

স্বাধীনতাকে সাধারণ মানুষের জীবনে অর্থপূর্ণ করার এই প্রবল আকাঙ্ক্ষা তার দলের অনেক নেতাই অনুধাবন করতে সক্ষম হননি। তাই বাকশাল প্রশ্নে তারা নীরব থেকেছেন। ইশারা-ইঙ্গিতে বলতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু কাজটা সঠিক করেননি। করলে তো তাকে ওইভাবে জীবন দিতে হতো না। যাদের সাম্রাজ্যবাদের হিংস্র থাবা সম্পর্কে ধারণা নেই, উলঙ্গ পুঁজিবাদের উপর যাদের আস্থা, তারাই এরূপ ভাবেন।

যে মহান ত্যাগের বিনিময়ে তার ডাকে সাড়া দিয়ে ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন, এদেশ স্বাধীন করেছেন, তিনি চেয়েছিলেন তাদের মুক্তি। এখানে কোনো আপোষ নয়, সমঝোতা নয়, আত্মসমর্পণ নয়। সাম্রাজ্যবাদের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে তিনি তার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সে কারণে তাকে স্ব-পরিবারে জীবন দিতে হয়েছে। কিন্তু তার প্রতি বাঙালির শ্রদ্ধা-ভালোবাসার কি বিলুপ্তি ঘটেছে? কখনো না। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলায় স্বাধীনতার স্বপক্ষে আজও যদি কেউ বক্তব্য রাখেন, তাকে উচ্চারণ করতে হবে একটি নাম “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান”। যিনি বাংলাদেশের জনগণের ত্রাতা, মুক্তিদাতা।

মুজিব একসময় ছিলেন, মুজিব ভাই-বাপের ভাই, ছেলের ভাই, নাতি-নাতনীর ভাই, আপামর বাঙালির ভাই। মুজিব নামের মানুষ হয়তো বাংলার মাটিতে আরও ছিল কিন্তু ‘শেখ মুজিব’ বলতে একজনকেই বোঝাত। পাকিস্তানিরা ‘শেখ সাহেব’ বলতে পূর্ব বাংলার শেখ মুজিবকেই বুঝাতেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হলেন। তারপর থেকে যা করেছেন বাংলা ও বাঙালির বন্ধু হিসেবে করেছেন, বঙ্গবন্ধু হিসেবে করেছেন। উল্কার মত ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। মোনায়েম খান বলেছিলেন তাকে (বঙ্গবন্ধুকে) সূর্যের আলো দেখতে দেওয়া হবে না। সূর্যের মুখ হয়তো কিছুদিনের জন্য তিনি দেখেননি। তবে দেশের জন্য এনে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার রক্তিম লাল সূর্যকে। বাংলা, বাঙালি, জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা এইতো ‘মুজিব’। এই মুজিবের কি কখনো মৃত্যু ঘটে?

...দুজনের লক্ষ্য একই। শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের মুক্তি। দেশ ও জনগণের উত্তম সেবা, তাদের জীবনমান উন্নয়ন।

বাংলার নিরন্ন রিক্ত মানুষ আজ তৃপ্ত। শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুখে আজ প্রাপ্তির হাসি। দুর্ভিক্ষ নামক ব্যাধি আজ বাংলার বুক থেকে বিতাড়িত। বাংলার মানুষকে যাতে কষ্ট করতে না হয় সে ব্যবস্থা তিনি করে গেছেন। তিনি চলে গেছেন মৃত্যুর ওপারে, রেখে গেছেন এক অমূল্য সম্পদ। তাঁর অতি আদরের কন্যারত্ন, দেশরত্ন শেখ হাসিনা। যে গুণে তিনি নিজে গুণান্বিত ছিলেন, তার সবকিছু দিয়ে গেছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যার মধ্যে। তাইতো অবিকল পিতার মতোই লালন-পালন করে যাচ্ছেন তার প্রিয় দেশবাসীকে। দুজনের লক্ষ্য একই। শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের মুক্তি। দেশ ও জনগণের উত্তম সেবা, তাদের জীবনমান উন্নয়ন।

একদা গ্রামের ছোট্ট কুটিরে, গভীর অমাবস্যার আঁধারে যে ঘরে টিপটিপ করে জ্বলত কুপি বাতি, সেখানে আজ বিদ্যুতের ঘনঘটা। আলোকিত আজ গ্রামবাংলা। উন্নয়ন, উৎপাদন, দরিদ্র বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য-শিক্ষার নিশ্চয়তা, উপভোগ্য সংস্কৃতি, বিশ্বসভায় বাংলাদেশের সগৌরব সুপ্রতিষ্ঠা এইতো ‘শেখ হাসিনা’। যারা বিরোধিতা করছে, বিরোধিতা তারা করবেই। কেননা বিরোধিতাই তাদের রাজনীতি।

বিশ্বাসঘাতক, মীরজাফর ও কুলাঙ্গারের বুলেট আর ষড়যন্ত্র থেকে আমরা জাতির পিতাকে রক্ষা করতে পারিনি কিন্তু দ্বিতীয়বার এ ভুল করা চলবে না। যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে আমরা জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যাকে আগলে রাখবো এই হোক আমাদের আজকের অঙ্গীকার। কেননা তার মাধ্যমেই জীবিত আছেন, ‘বঙ্গবন্ধু’; জীবিত থাকবে ‘বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ’।

ডা. এস এ মালেক ।। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, লেখক-কলামিস্ট ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব