বহুবছর ধরে বাংলাদেশের গণমাধ্যম অসুস্থতায় ভুগছে। নানাবিধ রোগ অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে রয়েছে এর প্রতিটি শাখায়। শিল্প-সংস্কৃতি তথা সৃজনশীল শাখার মধ্যে টেলিভিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ এই শাখার বেহাল অবস্থার কথা অনেকেই জানেন। তাহলে এর ভবিষ্যৎ কি?

কোন মাধ্যমের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা নির্ভর করে সঠিক পরিকল্পনা আর বিনিয়োগের উপর। গত বিশ বছরের টেলিভিশন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কয়েকটি দেশ টেলিভিশন, ইন্ডাস্ট্রিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। সংবাদমাধ্যমে জার্মানির ‘ডয়চে ভেলে’, ভারতের ‘এনডিটিভি’, টিভি সিরিয়ালে তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া অন্যতম। এমনকি ভারতের কলকাতার দর্শক এক সময় বিটিভির অনুষ্ঠান দেখতো, এখন বাংলাদেশের শতকরা ৭০ জন দর্শক কলকাতার দুইটি টিভি চ্যানেলের নাটক দেখছে। (টিভি সিরিয়ালের দর্শক, বিশেষ করে ১৫ বছরের বেশি মহিলা দর্শক।) কিন্তু বার্ষিক প্রায় বারো'শ কোটি টাকার টিভির বাজার আর ৮৬% টিভির দর্শকের বিশাল বাজার ধরতে আমাদের টিভি কর্তৃপক্ষ বরাবর ব্যর্থই হচ্ছে। এর কারণ কি?

কয়েকটি কারণ হলো- ১. টেলিভিশনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাব; ২. বিষয়ভিত্তিক চ্যানেলের স্বল্পতা; ৩. মানহীন অনুষ্ঠান/নাটক নির্মাণ; ৪. দর্শকের চাহিদা অগ্রহ্য করা; ৫. বিজ্ঞাপন নির্ভরশীলতা এবং অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন প্রচার; ৬. টিআরপির দুর্বলতা/দেশব্যাপী ব্যাপকতার অভাব; ৭. টিভি চ্যানেল এবং প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের পেশাদারিত্বের অভাব; ৮. এজেন্সি নির্ভরতা; ৯. সরকারের উদাসীনতা।

এসব কারণে টিভি ইন্ডাস্ট্রি সাফল্য পাচ্ছে না। প্রথমেই জানা দরকার, কারা টিভি দেখে, কতক্ষণ দেখে এবং টিভিতে কি দেখতে চায়? কান্তার এমআরবি বাংলাদেশ, টিআরপির একমাত্র প্রতিষ্ঠান। ঢাকা-চট্টগ্রাম শহর এবং গ্রাম মিলিয়ে প্রায় ২ কোটি ৩৪ লাখ মানুষের উপর জরিপ পরিচালনা করেছে। যাদের টিভিতে ক্যাবল সংযোগ আছে এবং যাদের বয়স চার বছরের উপর তারা এই জরিপে অংশ নিয়েছেন। তাদের তথ্যানুযায়ী, ১. গড়ে প্রতিমাসে প্রায় ২ কোটি ১৮ লাখ থেকে ২ কোটি ২০ লাখ (শতকরা হিসেবে ৯৩% থেকে ৯৪ %) মানুষ টিভি দেখে এবং তারা গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট সময় ব্যয় করেন; ২. দেশীয় ৩৩ টি চ্যানেলে ১ কোটি ৮৭ লাখ থেকে ২ কোটি ৫ লাখ দর্শক ১৫% থেকে ১৯% সময় ব্যয় করেন; ৩. অবশিষ্ট প্রায় ২৮ লাখ (১২%) দর্শক দেশীয় টিভি চ্যানেল ১ মিনিটের জন্যও দেখেন না। (গড়ে প্রতি মাসে)

বিষয়টা ভয়াবহই না, তা আমাদের জন্য অশনি সংকেত। এমনিতেই দেশীয় টিভি চ্যানেল থেকে দর্শক কমছে তার উপর নিউ মিডিয়া বিশেষ করে ওটিটি প্লাটফর্ম আগমনে হুমকির মুখে পড়েছে টেলিভিশন চ্যানেল। সংবাদ বিনোদনসহ সব কিছুই ওটিটিতে পাওয়া যায়, তাহলে টিভি চ্যানেলের প্রয়োজনীয়তা কেন?

কর্মী দক্ষতা বাড়াতে টেলিভিশন কি কোনো উদ্যোগ নিয়েছে? হতাশার কথা হলো, দেশের প্রায় ত্রিশটি টিভি চ্যানেলের মধ্যে মাত্র দুই বা তিনটি চ্যানেল এই গবেষণা করছে, যার কারণে তারা ধারাবাহিকভাবে দর্শক রেটিং এ ভালো করছে। বাকিগুলো চলছে কর্তার ইচ্ছা অনচ্ছিায়।

নাটক, মিউজিক্যাল শো, রিয়েলিটি শো, সংবাদ, তথ্যচিত্রের বেশিরভাগই ইউটিউব বা কোনো না কোনো অ্যাপস এ পাওয়া যাচ্ছে। দর্শক তার প্রয়োজন মতো সুবিধাজনক সময়ে বড় বাজেটের আকর্ষণীয় শো দেখতে পাচ্ছে। এই সুবিধা কিন্তু টিভিতে নেই, তাহলে দর্শক কেন টিভি দেখবে?

ওটিটির সাথে বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় টেলিভিশন টিকে থাকতে পারবে কি পারবে না, এটা এখন প্রশ্ন হয়ে উঠছে। কারণ টেলিভিশনের ইনভেস্টমেন্ট ওটিটি প্লাটফর্মে চলে যাচ্ছে। যে নাটক ওটিটিতে বাজেট ৫ লাখ - ৬ লাখ টাকা, সেই নাটক টিভির জন্য নির্মাণ সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা? অন্যসকল অনুষ্ঠানের চিত্রও প্রায় একই। তাহলে কি দাঁড়ায়? টেলিভিশনের জন্য বিশেষ কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে গবেষণা প্রয়োজন, সময়ের চাহিদা মিটাতে, দর্শকের রুচি-পছন্দ আমলে নিয়ে মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে হবে। জানতে হবে, কখন, কোন শ্রেণির দর্শক, কি অনুষ্ঠান দেখতে চায়, কেন দেখতে চায়?

কর্মী দক্ষতা বাড়াতে টেলিভিশন কি কোনো উদ্যোগ নিয়েছে? হতাশার কথা হলো, দেশের প্রায় ত্রিশটি টিভি চ্যানেলের মধ্যে মাত্র দুই বা তিনটি চ্যানেল এই গবেষণা করছে, যার কারণে তারা ধারাবাহিকভাবে দর্শক রেটিং এ ভালো করছে। বাকিগুলো চলছে কর্তার ইচ্ছা অনচ্ছিায়। টিভি চ্যানেলের পরিচালনা পর্ষদের সহজাত প্রবণতা হলো, টেলিভিশন কর্মকর্তাদের মন-মর্জি মতো নাটক, অনুষ্ঠান তৈরি করা এবং তা প্রচার করা। দর্শকের পছন্দকে অনেক সময় আমলেই নেয় না, তাই দর্শকও সেইসব টিভি চ্যানেল দেখে না। এর সম্পূর্ণ দায় এবং দায়িত্ব টেলিভিশন কর্মকর্তাদের। কিছু টেলিভিশন চ্যানেল আবার বিদেশি সিরিয়াল বাংলায় ডাবিং করে প্রচার করছে। ফলে দেশের দর্শকরা সেইসব ডাবিং সিরিয়ালের দিকে বেশি ঝুঁকছে। দর্শক ধরার প্রতিযোগিতায় টেলিভিশন কর্মকর্তাদের এই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি দর্শক না বুঝলেও তারা বিনোদনের আশায় সেইসব সিরিয়াল দেখছে।

মানুষ ভাষা শিখে নেয় তার প্রয়োজনে। এদেশের মানুষ হিন্দি ভাষা জানতো না, এখন টেলিভিশনের সিরিয়াল আর সিনেমার প্রভাবে এ দেশের মানুষ অনেকেই সাবলীল ভাবে হিন্দি বলতে পারে, কেউ কেউ কোরিয়ান আর টার্কিশ ভাষাও বুঝতে পারে।

তুরস্ক ও দক্ষিণ কোরিয়া প্রায় ৭০/৮০ টি দেশে তাদের সিরিয়াল রপ্তানি করে। তুরস্কে জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালে তাদের প্রতি ঘণ্টার বিজ্ঞাপন মূল্য প্রায় এক লক্ষ ডলার। ২০১৫ সালের তথ্যমতে, তারা বিদেশে রপ্তানি করা সিরিয়াল থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। প্রায় ৭০টি নতুন প্রোডাকশন হয় প্রতি বছর। তাদের ধারণা, পরের বছর রপ্তানি থেকে আয় করবে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের টাকায় প্রায় ২ হাজার চারশো কোটি টাকা।

মানুষ ভাষা শিখে নেয় তার প্রয়োজনে। এদেশের মানুষ হিন্দি ভাষা জানতো না, এখন টেলিভিশনের সিরিয়াল আর সিনেমার প্রভাবে এ দেশের মানুষ অনেকেই সাবলীল ভাবে হিন্দি বলতে পারে, কেউ কেউ কোরিয়ান আর টার্কিশ ভাষাও বুঝতে পারে।

বাংলাদেশের উন্নত সাহিত্য সংস্কৃতি আছে, দক্ষ নির্মাতা আর লেখকও আছে। এখন প্রয়োজন বড় বড় প্রোডাকশন তৈরি করা, টিভি ইন্ডাস্ট্রির কাঠামোর সংশোধন করা। দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবীরা কাজ করলে পাঁচ বছরের মধ্যে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি আরও পরিসর বাড়াবে এইটা নিশ্চিত।

টিভি ইন্ডাস্ট্রি শক্তিশালী হলে টিভি প্রোডাকশন রফতানি করা যাবে। তার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে, ব্যবসায়িক মন মানসিকতা থাকতে হবে। সৌখিন প্রযোজক হলে শুটিং টিমের সাথে থাইল্যান্ডের পাতায়া বা ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপ পর্যন্ত যাওয়াটাকেই বিশেষ অর্জন মনে করলে সিরিয়াল রফতানি করা যাবে না। শুরুতে বলেছিলাম, টেলিভিশনের আরেকটি প্রতিপক্ষ হবে ওটিটি প্লাটফর্ম। অনেকের কাছে শুনে থাকি, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে টেলিভিশন থাকবে না। কথাটা এতো সরল না, আবার অমূলকও না। কর্পোরেট কোম্পানিগুলো (যারা টিভিতে বিজ্ঞাপন প্রচার করে) প্রতি বছর ৩০ ভাগ অর্থ বরাদ্দ বাড়াচ্ছে পুরো ডিজিটাল প্লাটফর্মের জন্য। এই অর্থ কিন্তু কোম্পানির বাড়তি অর্থ না। টেলিভিশনের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেটই অন্য পুরো ডিজিটাল প্লাটফর্মে বরাদ্দ করছে। তার মানে প্রতি বছর টিভির আয় কমছে। আমরা খালি চোখেই দেখতে পাচ্ছি, অনেক টিভি চ্যানেল অর্থ সংকটে আছে, কোনো কোনো চ্যানেল ধুঁকে ধুঁকে চলছে। কেউ কেউ বেতন দিচ্ছে দেরিতে, আবার কিছু টিভি চ্যানেল কর্মী ছাঁটাই করছে। তাহলে কি টিভি চ্যানেল বন্ধ হয়ে যাবে?

এই ভাবে চলতে থাকলে বন্ধ হওয়া সময়ের দাবি। তবে ঘুরে দাঁড়াতে হলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে যথাযথ উদ্যোগ নিতেই হবে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত আছে, তা সমাধান করতে হবে। শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের আয়ের উপর নির্ভর না করলে টিভি কিন্তু ঠিকই ভালো ব্যবসা করবে। ইউরোপে অনলাইন প্লাটফর্ম দাপটে হলেও টিভি অনুষ্ঠানের বাজেট কমেনি বরং বেড়েছে।

প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে, এতো বড় বাজার থাকতে শুধু মাত্রও আধুনিক পরিকল্পনা আর যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য সেই সম্ভাবনাময় বাজার হারাতে বসেছে টিভি চ্যানেল। তুরস্কের সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে তাদের বাজার সম্প্রসারণ করছে। এই দেশের সরকারকেও এমন উদ্যোগ নিতে হবে। টিভি ইন্ডাস্ট্রির প্রতিটি অনুষ্ঠানকে একটি প্রোডাক্ট হিসেবে দেখতে হবে। এর সম্প্রসারণে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার নিজে দায়িত্ব নিয়ে টিভি চ্যানেল মালিকদের সাথে বসতে পারে, ভবিষ্যতের বৃহৎ বাণিজ্যের কথা বিবেচনা করে টিভি ইন্ডাস্ট্রিকে রক্ষা করতে হবে। আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পলিসি না হলে, টেলিভিশন কখনোই লাভের মুখ দেখবে না। তা না হলে এই টিভি যন্ত্র শুধু ক্ষমতাশীলদের হাতিয়ার হিসেবেই রয়ে যাবে, জমিদারি আমলের সেই লাঠিয়াল বাহিনীর মতো।

মোস্তফা মনন ।। নাট্যকার ও পরিচালক

mostofamonon@gmail.com