ছবি : সংগৃহীত

কিছুদিন আগের দক্ষিণ ভারতের হিজাব কাণ্ডে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক উত্তাপ এখনো ঠাণ্ডা হয়নি অথচ এরই মধ্যে নতুন আরেক  উত্তাপের বারুদ নিয়ে হাজির 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' নামের একটি চলচ্চিত্র। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এর উত্তেজনার মাত্রা উত্তর ভারতেই বেশি কম্পন তৈরি করবে।

হিজাব কাণ্ডের 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান এখন দ্য কাশ্মীর ফাইলসকে কেন্দ্র করে 'রাম রাম চিল্লায়েঙ্গে'তে পরিণত হয়েছে। চলচ্চিত্রটি ঘিরে উত্তেজনার ঊর্ধ্বগতি ভারতের মুসলমানদের বেশ ভাবিয়ে তুলছে। তারা মনে করছেন বিজেপির অন্যান্য অনেককিছুর মধ্যে ভারতের মুসলিমদের চাপে রাখার জন্য এটি একটি মিডিয়া হুমকি।

উত্তর প্রদেশসহ সম্প্রতি ভারতের পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের চারটিতেই বিজেপি ক্ষমতা দখলের ঠিক পরেই বিশ্ব ব্যাপী গত ১১ মার্চ মুক্তি পাওয়া বিবেক অগ্নিহোত্রীর 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' মাত্র ৬ দিনের মধ্যেই বক্স অফিসে প্রায় ৮০ কোটি টাকা সংগ্রহের পাশাপাশি সর্বত্রই বেশ আলোচনা, সমালোচনা বা প্রশংসার প্রচুর ভিডিও ও কন্টেন্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। পাশাপাশি ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করা দর্শন কুমার, মিঠুন চক্রবর্তী, অনুপম খের, পল্লবী জোশী এবং ভাষা সুম্বলিদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়েও নানান কথা মিডিয়াতে চলছে। এই ছবি নিয়ে ভারতীয় সামাজিক মাধ্যমগুলোর  দুটি ভাগ তৈরি হয়েছে।

এই ছবিতে দেখানো কাশ্মীর পণ্ডিতদের বেদনা দেখে একদল ব্যথিত হয়েছে অপর একটি দল আছে যারা এই ছবিকে প্রোপাগান্ডা বলে আখ্যায়িত করে মুসলিম বিরোধী হিসেবে দেখছে। তত্ত্ব বলছে, প্রোপাগান্ডা কোনো একটি বিতর্কিত বা জনপ্রিয় অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষার ধারাবাহিক আন্দোলনকে শক্তি ও দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু এই আন্দোলনগুলো তৈরি করতে খুব বেশি ভূমিকা রাখে না।  প্রোপাগান্ডার প্রচারক এমন একজন ব্যক্তি থাকেন যিনি ইতিমধ্যে বিদ্যমান একটি শক্তিকে সমর্থন করেন। অনেকটা মরুভূমিতে জল খোঁজার মতো। তাই হয়তো পূর্বের ঐতিহাসিক প্রোপাগান্ডা চলচ্চিত্রগুলোর মতো সাময়িক কিছু ফায়দা থাকলেও দ্য কাশ্মীর ফাইলস যে উদ্দেশ্যে তৈরা করা হয়েছে সেটা পুরোপুরি সুদূরপ্রসারী নাও হতে পারে।

হিন্দি সিনেমা 'বুদ্ধ ইন এ ট্র্যাফিক জ্যাম' (২০১৬)  থেকে বিবেক অগ্নিহোত্রী পরিচালক হিসেবে যে বিভিন্ন তথ্য দর্শকদের সামনে তুলে  ধরছেন তা ক্রমেই ভারী হচ্ছে। প্রথম দিকে 'চকলেট' (২০০৫) এবং 'হেট স্টোরির' (২০১২) মতো দুটি থ্রিল বা রোমান্সের মতো ভিন্ন স্বাদের ছবি বানালেও 'দ্য তাসখন্দ ফাইলস' (২০১৯) দিয়ে সারা বিশ্বের দর্শকদের অনেকটাই নজর কেড়েছিলেন বিবেক অগ্নিহোত্রী। বলা চলে, প্রায় তিন বছর আগে ছবিটি একটি স্লিপার হিট চলচ্চিত্র ছিল কারণ ভারতীয় বক্স অফিসের হিসাব অনুযায়ী ছবিটি ২০১৯ সালে  ২০ কোটি রুপির উপরে আয় করেছিল। বিবেক এবার তার পুরনো ছবিটির একটি ধারাবাহিক ধারণা নিয়ে নতুন ছবি 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' উপস্থাপন করে সারা পৃথিবীতেই হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন।

গতবার তিনি ইতিহাসের কালো চাদরে ঢাকা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর হত্যার বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। এবার তিনি কাশ্মীরের একটি বিতর্কিত ও গুরুতর সমস্যার কিছু দিক তুলে ধরেছেন যা দর্শকের মনের ভেতরে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ   তৈরি করে।

এজন্য কিছু কিছু নির্যাতন বা হত্যার দৃশ্য দেখে মানুষের হৃদয়কে আবেগের স্রোত গ্রাস করতে পারে বা মানুষের হৃদয়-মন কুঁকড়ে যেতে পারে। যা মাধ্যম হিসেবে সিনেমার একটি শক্তির জায়গা। বলা যেতে পারে, ছবিটি প্রযুক্তিগতভাবে তেমন উল্লেখযোগ্য ভিন্নতা না থাকলেও কাশ্মীর থেকে বেরিয়ে আসা ছবিটির বিষয়বস্তু বা সত্যতা এ পর্যন্ত কোনো পরিচালক উপস্থাপন করার সাহস দেখাতে পারেননি।

কাশ্মীর নিয়ে ভারত পাকিস্তানের সমস্যা বহু পুরনো এবং ১৯৪৭ সাল থেকে এপর্যন্ত দুইটি যুদ্ধসহ কয়েক দশক ধরে সহিংসতা চলেই আসছে। এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ও নৈতিকতার দিক থেকে বাংলাদেশের অধিকতর সাধারণ মানুষ কাশ্মীরিদের পক্ষেই কথা বলে থাকে। ভারতের উত্তরতম অংশে প্রায় ৮৬,০০০-বর্গমাইল পার্বত্য এই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলটি একসময় একটি রাজকীয় রাজ্য ছিল।

এখন ভারত এবং পাকিস্তান উভয়ই এটির দাবিদার। যদিও এই সংঘাতের শিকড় অতীতের ভারতীয় উপমহাদেশের ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা দেশ ভাগাভাগির মধ্যেই নিহিত। অবশ্য 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' সিনেমাটি এককভাবে ইতিহাসের এই ফাইল বা গল্পগুলো উল্টে দেখার চেষ্টা করে না।

তিনি যে সত্যটির উপর ভিত্তি করে তার চলচ্চিত্রটি তৈরি করেছেন তা ১৯৯০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে কাশ্মীরি কথিত জঙ্গি বা বিদ্রোহীরা সংখ্যালঘু কাশ্মীরি পণ্ডিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল এবং অসংবেদনশীল সহিংসতার মাধ্যমে তাদের উপরে অত্যাচার চালিয়ে হত্যা করেছিল যার জন্য সমস্ত মুসলমানরাই দায়ী এবং অবশ্যই এর জন্য তাদের সম্মিলিতভাবে শাস্তি পেতে হবে।

ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও বার্তায় প্রবীণ বলিউড তারকা শত্রুঘ্ন সিনহা বলেছেন, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সাথে ওখানে যা ঘটেছিল তা অত্যন্ত দুঃখজনক এজন্য আমিও মর্মাহত কিন্তু এরমধ্যে তো প্রায় ত্রিশটি বছর পেরিয়ে গেছে। মানুষ সেসব কিছু ভুলে গিয়েছিল এবং এরমধ্যে বিজিপিসহ ছ’টি সরকার ক্ষমতায় থেকেছে। তারা তো কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জন্য কোনো ভালো উদ্যোগই নেয়নি তাহলে এখন কেন আবার বিষয়টি হঠাৎ করে উঠছে।

নিশ্চয় এরমধ্যে রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য আছে। আসলে বিবেক অগ্নিহোত্রী তার ছবিতে, কাশ্মীরিদের দেশত্যাগের বিষয়টি সরকারের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি করার চেষ্টা করেছেন ঠিকই কিন্তু এখানে একটু ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যাবে সাধারণ পাকিস্তানি বা হিংস্র সন্ত্রাসীদের ছাড়িয়ে তার টার্গেট আসলে মিডিয়া, কিছু বামপন্থী নেতা ও বুদ্ধিজীবী এবং ভারত বিরোধিতাকারী যে কেউ। আর হ্যাঁ অবশ্যই তার আসল লক্ষ্য হলো মুসলিম যাদের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে ভারতের মাটির সাথে।

আমরা চলচ্চিত্রটির প্রথম দৃশ্যেই দেখতে পাই, বরফের উপরে রাখা রেডিওতে সেই সময়ের ভারতীয় ক্রিকেট খেলার ধারাবর্ণনা চলছে।  শচীন টেন্ডুলকারের ছক্কা মারার উচ্ছ্বাসের সাথে ক্যামেরা আমাদের নিয়ে যায় একদল ছোট কিশোরের দল কাশ্মীরের বরফ ঢাকা কিছুটা গোলাকৃতির ফাঁকা জায়গায় ক্রিকেট খেলছে।

এরমধ্যে ব্যাট হাতে পণ্ডিত কিশোরটি শচীন, শচীন বলে খুশিতে চেঁচাতে থাকলে একদল কাশ্মীরি মুসলিম লোক এসে ওকে ভারতীয় বলে মারতে শুরু করে যা দেখলে যেকোনো ভারতীয়র মনেই ক্ষোভ তৈরি হবে। কাশ্মীর ফাইলের এরকম অনেক দৃশ্যই আছে যেখানে মুসলমানদের দ্ব্যর্থহীনভাবে বর্বর বা বর্বরতার দাস হিসেবে দেখানো হয়েছে।

চলচ্চিত্রটির প্রধান প্রতিপক্ষ বিট্টাকে বিবেক মহাশয় ঠিক একজন পূর্ণাঙ্গ খল চরিত্রের নৃশংস রূপরেখা দিয়ে উপস্থাপন করেছেন এবং পর্যায়ক্রমে পণ্ডিতদের বিপরীতে তার নৃশংসতাকে এক ভিন্ন মাত্রার উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। একটি বর্ণনামূলক কাঠামোর (ন্যারেটিভ ফর্ম) চলচ্চিত্রে সাধারণত একজন সন্ত্রাসী বা খল চরিত্রকে দর্শকের মনে ভালোভাবে দাগকাটার জন্য তার মন্দ দিকগুলোর প্রতি জোর দেওয়া হয় কিন্তু এখানে এই কাঠামো অনুসরণ করার ফলে প্রায় প্রতিটি মুসলিম চরিত্র জুড়ে তার অনৈতিকতার পরিসর তৈরি করে।

একটি দৃশ্যে তিনি তার পুরানো শিক্ষক পুষ্করের পরিবারকে অত্যাচারের একপর্যায়ে চালের ড্রামে লুকিয়ে থাকা তার ছেলেকে পুত্রবধূর সামনে গুলি করে ঝাঁজরা করে দিলে ড্রামের ভেতর থেকে ফুটো দিয়ে গড়িয়ে যে রক্ত বাইরে আসে তা চালের সাথে মিশিয়ে পুত্রবধূকে  খাইয়ে দেওয়ার দৃশ্যটি অবশ্যই বর্বরতাকে ইঙ্গিত করে।

পুরো ছবি জুড়েই এরকম ঝুলন্ত লাশ, নৃশংসতা, গুলি, রক্ত, কাশ্মীরি পণ্ডিত মহিলার কাপড় খুলে ফেলে লাঞ্ছনা করা এবং নির্দয় মৃত্যু  দেখানো হয় যা বর্বরতার সংজ্ঞাকে দৃঢ় করে। 

পরিচালক ইচ্ছাকৃতভাবে ভিন্নমতের সাথে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসকে মিশ্রিত করেছেন। এখানে মৌলবাদ ও সহিংসতার সাথে মিশিয়ে একটি দ্বিমুখী অবিশ্বাস এবং বর্বরতার প্ররোচনার জন্ম দিয়েছেন। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের প্রতি সম্প্রীতি রক্ষা করার জন্য তিনি কাশ্মীরের অনেক ঐতিহাসিক নথিভুক্ত দৃষ্টান্ত, দলিল বা ঘটনা সমূহকে সম্পূর্ণরূপে টপকে গেছেন।

তিনি কোটি কোটি কাশ্মীরি মুসলমানদেরও ভুলে গেছেন যারা নিজেরাই জঙ্গিবাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল। অন্যদিকে ভারত সরকার দ্বারাও নির্যাতিত হয়ে আসছে। এটি করার মাধ্যমে হয়তো তিনি আগত দিনগুলোতে কাশ্মীর বা হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের একটি জটিল ও কঠিন দ্বন্দ্ব তৈরির প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো ছড়িয়ে দিলেন।

নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক