ছবি : সংগৃহীত

ঐতিহাসিকভাবে হাজার হাজার বছর ধরে তার প্রকৃতি এবং সৌন্দর্য নিয়ে শ্রীলঙ্কা বিশ্বের অন্যতম সেরা দ্বীপ হিসেবে পর্যটকদের কাছে প্রশংসনীয় হয়ে আসছে। শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ যার উত্তর-পশ্চিমে ভারত এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে মালদ্বীপের সীমানা রয়েছে। সমুদ্রবেষ্টিত প্রাকৃতিক দ্বীপ হিসেবে ছোট দেশ হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে শ্রীলঙ্কা।

এদেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোনো অভাব নেই, চারদিকে সবুজের সমারোহ দেশটিকে আরও সুন্দর করে তোলে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় ৩০০০ বছরের পুরানো এই ভূখণ্ডে প্রাক-ঐতিহাসিক সময়ে ১,২৫,০০০ বছর আগেও মানব বসতির কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে প্রতিষ্ঠিত গভীর বন্দরগুলোও এই স্থানটির জন্য আলাদাভাবে কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে।

ব্রিটিশ উপনিবেশের শুরু থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা সিলন নামে পরিচিত ছিল। এখানকার জনসংখ্যার বেশিরভাগ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মকে অনুসরণ করায় এটিই দেশের প্রধান ধর্ম। এছাড়াও হিন্দু ধর্মের লোকের সংখ্যাও নেহাত কম নয় যারমধ্যে বেশিরভাগ দক্ষিণ ভারতীয় বংশোদ্ভূত তামিল ভাষাভাষীর মানুষ। অন্যান্য ধর্মের মধ্যে ইসলাম এবং খ্রিস্টান ধর্মও দেশের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশের মতো। 

ইতিহাসের দিক দিয়ে শ্রীলঙ্কা ও ভারতের অনেক মিল রয়েছে। তৎকালীন সিলন এবং ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের পাশাপাশি  ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক সম্পর্কের পটভূমিও ছিল। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ রামায়ণ যুগের রাবণের রাজ্য এবং ভগবান শ্রী রাম কর্তৃক রাবণের পরাজয় আমাদের মনে করায় যে প্রাচীন কাল থেকেই শ্রীলঙ্কায় মানব সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল এবং এর ব্যাপক প্রসারও হয়েছিল।

শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার, যার ভিত্তি এই শতাব্দীর প্রায় ২৫০ বছর আগে সম্রাট অশোক স্থাপন করেছিলেন। ভারতের ঐতিহাসিক সূত্র থেকে আমরা প্রমাণ পাই, সম্রাট অশোক তার পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রাকে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের জন্য শ্রীলঙ্কায় পাঠিয়েছিলেন।

ইতিহাসবিদরা মনে করেন, বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারই শ্রীলঙ্কার সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবেশের এক আশ্চর্যজনক পরিবর্তন এনেছিল যার  কারণেই বৌদ্ধ ধর্ম এদেশের সবচেয়ে জনবহুল ধর্ম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। এটি স্পষ্টভাবে স্থির করে বলা যায় যে, শ্রীলঙ্কার ঐতিহাসিক পটভূমিতে গৌতম বুদ্ধ, ভগবান শ্রী রাম এবং সম্রাট অশোক গভীরভাবে সম্পর্কিত। এছাড়া শ্রীলঙ্কা ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত যথাক্রমে পর্তুগিজ, ডাচ এবং পরে ব্রিটিশদের দ্বারা শাসিত ছিল।

শ্রীলঙ্কার সর্বশেষ ইতিহাসে ১৩ বছরের একটি গৃহযুদ্ধর সংকট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা ২০০৯ সালে লিবারেশন টাইগার অব তামিল ইলাম (এলটিটিই)-কে শ্রীলঙ্কার সৈন্যরা পরাজিত করার মধ্য দিয়ে তা দৃঢ়ভাবে শেষ হয়েছিল। এটি বৈচিত্র্য এবং বহু-সংস্কৃতির দেশ, সেইসাথে শ্রীলঙ্কা অনেক ধর্ম, জাতিগোষ্ঠী এবং ভাষার আবাসস্থল।

সংখ্যাগরিষ্ঠ লঙ্কানদের সাথে অনেক ভারতীয় তামিল, মুর, বার্গার, মালয়, কাফির এবং উপজাতীয় বেদেরা বসবাস করে। বুদ্ধের লেখার জন্যও বিখ্যাত শ্রীলঙ্কা একটি সমৃদ্ধ বৌদ্ধ ঐতিহ্য নিয়ে আবর্তিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিসরেও শ্রীলঙ্কার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।   দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক), জাতিসংঘ কমনওয়েলথ অব নেশনস এবং জোট নিরপেক্ষ প্রচারণার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল। মালদ্বীপের সাথে মানব উন্নয়ন সূচকে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধির হারসহ দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশের মধ্যে শ্রীলঙ্কা অন্যতম।

এমন একটি ঐতিহাসিক ভূমিতে যদি পেট্রোল পাম্পে সেনা মোতায়েন করতে হয় এবং কাগজের স্বল্পতার কারণে পরীক্ষা বাতিল হয়ে  যায় তাহলে সেখানকার পরিস্থিতি কতটা অস্বস্তিকর তা সহজেই বোঝা যায়। আজকাল শ্রীলঙ্কায়ও একই অবস্থা বিরাজ করছে। গভীর অর্থনৈতিক সংকট শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে। এতে জনমনে ক্ষোভ বিরাজ করছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার মন্ত্রীদের ইস্তফা দিয়েও তাদের ক্ষোভ থামানো যাচ্ছে না। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারও জনগণের অনুভূতি সম্পর্কে যে সচেতন তা আমরা মিডিয়াতে দেখতে পাচ্ছি।

সম্প্রতি আমরা বিভিন্ন সংবাদ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্রমাগত দেখছি যে, শ্রীলঙ্কা সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। দেশে মার্কিন ডলারের তীব্র ঘাটতি দেখা দেয়ায় সরকার দুধসহ মৌলিক খাদ্য সামগ্রীর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, যা নিয়মিত খাবার এবং খাদ্য ব্যবসার জন্য অপরিহার্য। এই রূপময় দ্বীপ দেশটির ক্রমবর্ধমান মূল্য এবং উচ্চ বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়ায় প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে তীব্র অর্থনৈতিক ও জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন। শ্রীলঙ্কার জ্বালানির ঘাটতিতে হাজার হাজার মানুষকে পেট্রোল পাম্পের বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে। সাধারণ মানুষও প্রতিদিন দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা বা লোড শেডিংয়ের সম্মুখীন হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, করোনা মহামারিতে পর্যটন তহবিল কমে যাওয়ার আগেও শ্রীলঙ্কার ঋণের ছোবল একটি ধৈর্য সীমার মধ্যেই ছিল। দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান সঙ্কট সৃষ্টিকারী বেশ কয়েকটি সামাজিক-রাজনৈতিক ভিত্তির একই ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাওয়া দেশগুলোর সাথে শ্রীলঙ্কার নামও এবার যুক্ত হয়েছে।  

শ্রীলঙ্কার বর্তমান অবস্থা দেখে যে কেউ অবাক হতে পারেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই দ্বীপ দেশটিতে তুলনামূলকভাবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছিল। দীর্ঘ সময় ধরে গৃহযুদ্ধের কবলে থাকা সত্ত্বেও এর অর্থনীতির কর্মকাণ্ডে অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো পারফরম্যান্স অব্যাহত রেখেছে। এমনকি জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকেও শ্রীলঙ্কা ভালো করেছে। তাহলে হঠাৎ এমন কী ঘটল যে তারা একেবারে দারিদ্র্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেল? বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এসব হঠাৎ করে ঘটেনি।

বৈদেশিক বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, ২০১৭ সাল থেকেই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি স্তব্ধ হতে শুরু করে দিয়েছিল। করোনা এতে কিছু ভূমিকা রেখেছিল, যার পর শ্রীলঙ্কা বা অন্য কোনো দেশের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তাছাড়া শ্রীলঙ্কা নিজেই কিছু কিছু অযৌক্তিক নীতি গ্রহণ করে নিজেদেরকে এতটা খারাপ দিকে নিয়ে গেছে যেগুলো এই করুণ অবস্থার জন্য অনেকাংশে দায়ী।

আসলে এসব নীতির কারণে অনেক আগে থেকেই অর্থনৈতিক সংকটের স্বভাবনার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। সেসব এখন মিলেমিশে তার আসল রূপ প্রদর্শন করেছে। অন্যদিকে পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা চীনকে শ্রীলঙ্কার ধ্বংসের সবচেয়ে বড় অবদানকারী হিসেবে বিবেচনা করছেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শর্ত ও শর্তের ভিত্তিতে চীন হাম্বানতোতা বন্দর দখল করার পর থেকেই শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থা ওঠানামা করতে থাকে। এর সাথে করোনা মহামারি যোগ হয়ে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ভেঙে পড়ে এবং সেখানে সরকার তা ঠিক করতে ব্যর্থ হয় যার দরুণ শ্রীলঙ্কার পক্ষে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ খুবই কঠিন হয়ে পরে।

উপরন্তু অর্থনীতির মূলভিত্তি পর্যটনের ধস। তথ্যমতে, শ্রীলঙ্কার জিডিপিতে পর্যটনের প্রায় ১২.৫ শতাংশ আয়ের এই খাতটি প্রাক- করোনা যুগে শ্রীলঙ্কায় দ্রুততম প্রবৃদ্ধি এনে দিয়েছিল। কিন্তু করোনা সম্পর্কিত বিধিনিষেধ এবং মহামারির ভয় পর্যটন কার্যক্রমের উপর প্রবল চাপ পড়ে।

এমতাবস্থায় শ্রীলঙ্কা সরকারের নীতিনির্ধারকরা পপুলিস্ট রাজনীতির লোভে করের হার ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়। এতে শুধু রাজস্ব ক্ষতিই হয়নি বরং সরকারি কোষাগারের অবনতিশীল অংকের পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো শ্রীলঙ্কার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে।

এটি কলম্বোর পক্ষে আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে আর্থিক সংস্থান সংগ্রহ করা কঠিন করে তুলেছিল। এ জন্য তারা চীনের মতো দেশের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পরে, যে দেশ থেকে কড়া শর্তে আগে থেকেই আরও অনেক ঋণ নেওয়া ছিল। অসুবিধা শুধু সেখানেই শেষ হয়নি।

কৃষিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে এক তুঘলকি ডিক্রি জারি করা হয়। যেখানে রাতারাতি চাষিদের জৈব চাষের দিকে এগোনো সম্ভব হয়নি। ফলে ঐতিহ্যবাহী কৃষি উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও রাসায়নিক সার ব্যবহারের সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে প্রত্যাহার করা হয়েছিল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে এবং ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা দিতে শুরু করেছে।

এই সবকিছুর ফলশ্রুতিতে আজ শ্রীলঙ্কা আর্থিক ও খাদ্য সংকটে এতটাই জর্জরিত হয়ে পড়েছে যে তার প্রভাবে শ্রীলঙ্কার সমস্ত ঐতিহ্য আর সৌন্দর্যকে সম্পূর্ণভাবে তছনছ করে দিয়ে জাতিকে এক চরম সংকটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক