ছবি : সংগৃহীত

স্বকীয় চেতনার তাগিদে, অগ্রজের অথবা অনুজের হাত ধরে, গুরু স্থানীয় শিক্ষকের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক মহাযজ্ঞের আয়োজনে নিরলস কাজ করে চলেছে সকলে। শুধু একবার নয়, অশুভ শক্তির বিনাশে, প্রতিকূল সময়ে হাতে হাত রেখে যার সূচনা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে, সেই সমষ্টিগত শক্তির একত্রিত প্রয়াসে চলমান মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের ধারাবাহিকতা আজও চলমান। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে এই নবমাত্রা যোগের ধারাবাহিকতা চলছে এখনো পর্যন্ত।

বাংলা নববর্ষকে বরণ করার উপলক্ষে সামগ্রিক দেশের মানুষের সাথে সমন্বিত এই আয়োজনের পেছনে কাজ করেন যেই শিক্ষার্থীরা, তাদের নবীন শক্তিই এই আয়োজনের মূল শক্তি। শিক্ষাজীবনের ছক-বাঁধা পাঠ্যক্রমের বাইরে নিজ প্রতিষ্ঠানের আঙিনাতেই তাদের জন্য অপেক্ষা করে নতুন অভিজ্ঞতা আহরণের উপাদান।

শুধু অভিজ্ঞতাই নয়, সংযোগ ঘটে সকল অগ্রজ-অনুজ ও সহপাঠীর সঙ্গে, বিনিময় হয় আন্তরিকতার, তৈরি হয় নতুন সম্পর্ক- যেখানে সমান অংশগ্রহণ থাকে অনুষদের শিক্ষকের, শ্রেনিকক্ষের বাইরে তৈরি হয় নতুন সম্পর্কের ধারা।

বাংলাদেশের আবহে বাঙালি নিজের স্বকীয়তাকে খুঁজে পায় এই শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে, তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই অনুপ্রেরণার শক্তি হিসেবে কাজ করে এই আয়োজনে। প্রতিবারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাঙ্গণে চলেছে নববর্ষ বরণের প্রস্তুতিপর্ব।

বাংলা নববর্ষকে বরণ করার উপলক্ষে সামগ্রিক দেশের মানুষের সাথে সমন্বিত এই আয়োজনের পেছনে কাজ করেন যেই শিক্ষার্থীরা, তাদের নবীন শক্তিই এই আয়োজনের মূল শক্তি।

পৃথিবীর আরও অনেক দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এমন সামগ্রিক সমষ্টিগত জাতীয়তাবাদের চেতনার স্থানে বিবেচনা করলে মঙ্গল শোভাযাত্রা অনন্য এক উদ্যোগ। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বৃত্তের বাইরেও মঙ্গল শোভাযাত্রা সংযোগ ঘটায় বাংলার লোকজ ঐতিহ্যের সাথে, আমাদের শেকড়ের সাথে। বর্তমানে দাঁড়িয়ে এরই মধ্যে দিয়ে আমরা সমন্বিত হই আমাদের ঐতিহ্যের সাথে, আমাদের প্রান্তিক মানুষের সাথে।

দীর্ঘ সময়ের এই পথচলায় মঙ্গল শোভাযাত্রা অর্জন করেছে এদেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করার শক্তি, দেশকে জাগরিত করার দৃঢ়তা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পরবর্তী সময় বিবেচনা করলে বর্তমান বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষের এই মঙ্গল শোভাযাত্রা নবরূপে যাত্রা শুরু করেছে দেশব্যাপী সকল প্রতিষ্ঠানে, দেশজুড়ে মানুষের উদযাপনের অংশ হিসেবে।

শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ও চারুকলা অনুষদ ভিত্তিক আয়োজনকে ছাপিয়ে নতুন মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার এই সংস্কৃতির প্রবাহ। জাগিয়ে তুলছে মানুষের স্বকীয় জাতিসত্তাকে। এভাবেই নির্মল হচ্ছে বাংলার মানুষ, নিজ সংস্কৃতির সত্তায়।

এই সময়ের পৃথিবীতে অস্থিতিশীলতার গতিপ্রবাহ কিছু কম নয়, বরং প্রযুক্তির আশ্রয়ে যেকোনো অপশক্তি ঠাঁই করে নেয় নিমিষেই, দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের কাছে। সেই অপশক্তির কোনো দেশ নেই-কাল নেই, সকলেই আমরা আক্রান্ত এই সময়ের আবির্ভূত সংকটে।

এমন অস্থিতিশীলতার সময় নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে উদযাপন ও সময়ের সকল সংকট পেছনে রেখে বর্ষবরণের আয়োজনকে উপলক্ষ করে উৎসবে একত্রিত হতে পারার মতো ঘটনা এক দারুণ উদ্যোমের স্থান আমাদের জন্য। অপশক্তি নির্মূল হয় আমাদের সামগ্রিক শক্তিতে, সমন্বিত মেলবন্ধনে। সেখানেই জয় হয় মানুষের।

শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বৃত্তের বাইরেও মঙ্গল শোভাযাত্রা সংযোগ ঘটায় বাংলার লোকজ ঐতিহ্যের সাথে, আমাদের শেকড়ের সাথে। বর্তমানে দাঁড়িয়ে এরই মধ্যে দিয়ে আমরা সমন্বিত হই আমাদের ঐতিহ্যের সাথে, আমাদের প্রান্তিক মানুষের সাথে।

তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিজ গতিতে এগিয়ে চলবে, কখনো মানুষকে সমন্বিত করার শক্তি নিয়ে, কখনো প্রতিবাদের ভাষা হয়ে কিংবা স্বকীয়তাকে উদযাপনের অংশ হিসেবে। জয় হবে নির্মলতার, সম্পর্কের শক্তির, সমন্বিত ঐক্যের।

হয়তো প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটেছে, নিরাপত্তার ঘেরাটোপের সংযোজন ঘটেছে, রাষ্ট্রীয় পর্যবেক্ষণ বেড়েছে। সেই সকল পরিস্থিতিকে বরণ করে নিয়েই চলছে আমাদের আনন্দযজ্ঞ। আমরা আমাদের প্রাণশক্তির উচ্ছ্বাসে বরণ করে নিয়েছি সকল সময়ের সংকটকে, সেই বলয়ে থেমে যাবে না আমাদের যাত্রা।

পৃথিবী জুড়েই শিল্পীদের শৈল্পিক পদযাত্রা প্রভাব বিস্তার করে দেশ ও জাতির পথচলায়। তাদের অবদান তাদের চিন্তার বহিঃপ্রকাশে, তাদের সৃজনে। শিল্প ও শিল্পীর সমন্বিত উদ্যোগে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার যেই পথচলা, তার মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের দেশ, আমাদের ঐতিহ্য।

আমরা এই পথচলায় রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাতে পারি আরও অধিক পৃষ্ঠপোষকতার, আরও অধিক সমন্বয়ের, দেশের মানুষের সাথে শিল্প-শিল্পী ও সংস্কৃতির মেলবন্ধের এই পথচলায়।

বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এই সমন্বিত পথ চলায়, নতুন আগামীর পথে, জয় করবে সকল ভয়কে, নির্মল করবে এই বাংলার মানুষের মননকে, সমৃদ্ধ করবে ঐতিহ্যের গৌরবের মধ্য দিয়ে। মঙ্গল শোভাযাত্রা মঙ্গল বয়ে আনুক আরও সহস্র বছর।

বিশ্বজিৎ গোস্বামী ।। সহকারী অধ্যাপক, অংকন ও চিত্রায়ণ বিভাগ, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়