‘বাঙালি বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি’-প্রবাদের মতো উচ্চারিত কথাটি প্রায়ই শোনা যায়। শুনতে শুনতে মনে হয়, বাঙালির জন্য বিস্মৃতি কোনো দোষ নয়, বরং মহিমান্বিত করার মতো বিশেষ ব্যাপার। আদতে বাঙালি বুঝতেই পারে না তার ইতিহাস, আদর্শ ও ভবিষ্যতকে। কিন্তু ফাঁপা গর্বের বিরাট বোঝা কাঁধে নিয়ে বাঙালি বরাবরই আনন্দে উচ্ছ্বসিত থাকে। কে তাকে ধরিয়ে দেবে, বিশ্ব-ইতিহাসের বিশাল সভায় তার আসনটি অত্যন্ত দুর্বল।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীকে স্মরণ করতে গিয়ে এই কথাগুলো মনে এলো। কারণ অসম্ভব প্রতিভাধর বহুপ্রান্তস্পর্শী এই ব্যক্তিত্বকে আমরা হৃদয় ও মস্তিষ্ক দিয়ে মনে রাখিনি। একজন সৃষ্টিশীল লেখক, চিত্রকর, সম্পাদক কিংবা পুস্তক বিশেষজ্ঞ হিসেবে তার যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। প্রয়োজনীয় আলো ফেলে দেখা হয়নি বাঙালির সাংস্কৃতিক ভিত্তি নির্মাণে তার ভূমিকাকে।

অথচ বাংলা সাহিত্যের একটি পর্বের সক্রিয় প্রতিনিধি তিনি। বাঙালি শিশু ও কিশোরদের নিয়ে খুব কম মানুষই তার মতো ভেবেছেন।
১৯১৩ সালে শিশুকিশোরদের জন্য তিনি প্রকাশ করেছিলেন ‘সন্দেশ’ নামের একটি পত্রিকা—যা বাঙালির ইতিহাসে বড় ঘটনা। শিশুকিশোর পত্রিকার জন্য ‘সন্দেশ’ তৈরি করেছিল অনতিক্রম্য আদর্শ। কিন্তু বাঙালি যেহেতু কারণে অকারণে নাসিকা কুঞ্চিত করে, সেহেতু শিশুকিশোর সাহিত্য প্রসঙ্গেও তার নিরর্থক অবজ্ঞার ভাব আছে। এ ধারার সাহিত্য সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন বাংলা ভাষায় একেবারে হাতে গোনা। অনেকটা যেন এই রকম, ‘ও, শিশুসাহিত্য! ও তো ডায়াপার পরা বাচ্চাদের ব্যাপার।’ বাঙালিকে কে বোঝাবে, বাচ্চাদের বইয়ের লেখকরা বাচ্চা নন; বাচ্চামির ভেতর দিয়েই পরিবেশন করা হয় প্রাপ্তবয়স্কের বোধ। শিশুর মনস্তত্ত্বে ইডিওলজি তৈরির কারখানা হলো শিশুসাহিত্য। অতএব যদি মূল্যায়ন করতেই হয়, তাহলে শিশুসাহিত্যের আলোচনা অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা সবার আগে। কিন্তু বাঙালির ক্ষেত্রে তা ঘটেছে কম।

নবীন পাঠকদের উপেন্দ্রকিশোর নিয়ে গিয়েছেন বিজ্ঞানের জগতে। বিচিত্র প্রাণী নিয়ে লিখেছেন বই ‘সেকালের কথা’। এ বইয়ের বিজ্ঞান বস্তুনিষ্ঠ কোনো সূত্রবদ্ধ বিজ্ঞান নয়।

উনিশ শতকে শিশুকিশোরদের জন্য যত পুস্তক রচিত হয়েছে তার উপরিতলের লক্ষ্য ছিল শিক্ষাদান, কিন্তু গভীরতলে নিহিত লক্ষ্য ছিল ভাবাদর্শিকভাবে শিশুকে ভবিষ্যতের জন্য গড়ে তোলা। সে কালের পাঠ্যবইগুলো ছিল অত্যন্ত ভারি। অনেক অনেক পাঠ, অনেক অনেক বিষয়। পাঠ অসাধ্য বিষয়বস্তু দিয়ে ভরে তোলা হয়েছিল বই। কিছু বই ছিল বয়সের একেবারে অনুপযোগী। ছাপা ও চিত্র দৃষ্টি সুখকর ছিল না বললেই চলে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী পুস্তক মুদ্রণের এই দুর্বলতাগুলো লক্ষ করেছেন। হয়তো তখনই তার মনে অঙ্কুরিত হয়েছিল শিশুপাঠ্য বই রচনার ইচ্ছে। বইয়ের ভেতর ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সবুজ কোমল স্বপ্নকে।

উপেন্দ্রকিশোর একে একে লিখলেন, ‘ছেলেদের রামায়ণ’, ‘ছেলেদের মহাভারত’, ‘সেকালের কথা’। ‘টুনটুনির বই’য়ে কয়েকটি বাক্যের ছোট্ট একটি ভূমিকায় জানালেন, ‘সন্ধ্যার সময় শিশুরা যখন আহার না করিয়াই ঘুমাইয়া পড়িতে চায়, তখন পূর্ববঙ্গের কোনো কোনো অঞ্চলের স্নেহরূপনী মহিলাগণ এই গল্পগুলি বলিয়া তাহাদের জাগাইয়া রাখেন। সেই গল্পের স্বাদ শিশুরা বড় হইয়াও ভুলিতে পারে না।’ ভুলে না গেলেও বড় হয়ে ওঠা অতীতের শিশুরা ভবিষ্যতে গিয়ে সেসব গল্প সংগ্রহ কিংবা পুনর্লিখনের কথা অতোটা ভাবলেন না।

‘ঠাকুমার ঝুলি’র রচয়িতা দক্ষিণারঞ্জন মিত্র এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী উদাহরণ। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় দেশ আবিষ্কারের অংশ হিসেবে বইটির ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এগিয়ে গেলেন এ পথেই। পূর্ববাংলায় প্রচলিত লোকগল্প ও রূপকথার সমন্বয়ে তৈরি হয়ে গেল ‘টুনটুনির বই’য়ের গল্পগুলো। এ বইয়ের ভাষা নিয়েও বিশেষ আলোচনা হতে পারে। ১৯১৪ সালে ‘সবুজ পত্র’ পত্রিকায় প্রমথ চৌধুরীরা যখন চলতি বাংলার পক্ষে দোহারকি করছেন, তার আগেই ১৯১০ সালে প্রকাশিত হয়ে গেছে চলতি গদ্যে লেখা ‘টুনটুনির বই’।

বিচিত্র বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন উপেন্দ্রকিশোর—জীবজন্তু, ফটোগ্রাফি, ছবি, মুদ্রণযন্ত্র, সংগীত, সুর—সবই শিশুকিশোর উপযোগী। জ্ঞানের বহুমাত্রিক বিশ্বে পরিভ্রমণের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে তিনি সাজিয়ে ছিলেন ‘সন্দেশ’র পাতা।

বই হয়ে এলো ‘মহাভারতে কথা’, ‘পুরাণের গল্প’; ছন্দবদ্ধ কবিতায় লিখলেন ‘ছোট্ট রামায়ণ’। লক্ষ করার মতো বিষয় এই যে, ‘গল্পমালা’র গল্পের পাশাপাশি উপেন্দ্রকিশোর পৌরাণিক সাহিত্যকে তুলেছেন শিশুকিশোর উপযোগী। এ থেকে দুটো সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে—
এক. সেকালে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ প্রাচীন ভারত আবিষ্কারের প্রয়াস জারি রেখেছিল, তার প্রভাব পড়েছে শিশুসাহিত্য নির্মাণে।

দুই. সম্প্রদায়গত পরিচয়ে বিকশিত বাঙালি মধ্যবিত্তের বড় অংশ ছিল হিন্দু ও ব্রাহ্ম; কিশোর পাঠকরা এসেছিল প্রধানত সেই শ্রেণি ও সম্প্রদায় থেকে। এরাই ছিল উপেন্দ্রকিশোরের উদ্দিষ্ট প্রধান পাঠক। আর তাই রামায়ণ, মহাভারত কিংবা পুরাণ প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু তাই বলে এই প্রশ্ন তোলা যায় না যে, তিনি বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিস্টানদের জন্য কী লিখলেন? উপেন্দ্রকিশোর চৌধুরী তার লেখায় গেঁথে দেননি সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কোনো বিশিষ্ট চিহ্ন। এ কারণে তার বইয়ের পাঠকরা কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের পাঠক হিসেবে থাকেননি। পৌরাণিক সাহিত্যের কিশোর উপযোগী সংস্করণ সকল সম্প্রদায়ের পাঠকের জন্য স্থায়ী সম্পদ হিসেবে ইতিহাসে জমা হয়ে গেছে।

নবীন পাঠকদের উপেন্দ্রকিশোর নিয়ে গিয়েছেন বিজ্ঞানের জগতে। বিচিত্র প্রাণী নিয়ে লিখেছেন বই ‘সেকালের কথা’। এ বইয়ের বিজ্ঞান বস্তুনিষ্ঠ কোনো সূত্রবদ্ধ বিজ্ঞান নয়। বইটির ভূমিকায় সতর্কভাবে উল্লেখ করেছেন ‘বিজ্ঞানের তুলাদণ্ডে’ মেপে তিনি তা লেখেননি এবং বইটি কোনো বৈজ্ঞানিক পাঠ্যপুস্তকও নয়।

ছেলেমেয়েদের প্রাচীন কালের গল্প শোনাবার জন্য তিনি লিখেছেন। জীবজন্তুর কল্পগল্প শুনে শিশুরা যেমন আনন্দ পায়, তেমন আনন্দ দানের উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছে ‘সেকালের কথা’। আনন্দ জুগিয়েছিল বলেই প্রকাশমাত্র শেষ হয়ে গিয়েছিল বইটির সবগুলো কপি। বলাবাহুল্য আনন্দ ও শিক্ষার এই সম্পর্ক বিষয়ে আমরা এখনো ওয়াকিবহাল কি না সন্দেহ আছে।

শিশুকিশোর বইগুলো যেন সুখপাঠ্য হয়, সে লক্ষ্যে কী করেননি উপেন্দ্রকিশোর? বইয়ের ছবি, অলংকরণ, মুদ্রণ নিয়ে প্রচুর ভেবেছেন, ছবি এঁকেছেন। কাঠের ব্লক দিয়ে সেই ছবিকে পরিস্ফুট করেছেন। মনের মতো করে হয়নি বলে কখনো কখনো আক্ষেপ করেছেন। আমাদের মনে রাখা দরকার, সে যুগের মুদ্রণ প্রযুক্তি অনুযায়ী অগ্রসর ভাবনার স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন। এসব কাজে তার চিন্তার সহযোগী ছিলেন আরেক শিশুকিশোর সাহিত্যিক যোগীন্দ্রনাথ সরকার।

বাংলা শিশুকিশোর সাহিত্যে এই একগুচ্ছ প্রতিভা প্রায় কাছাকাছি; অথচ প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র সৃষ্টির বিচিত্র সম্ভার নিয়ে হাজির। অনেকেই জানেন সুকুমার, সুখলতা, পুণ্যলতা ও সত্যজিৎ রায়ের মধ্যস্থতায় উপেন্দ্রকিশোরের অনেক অনেক চিন্তা পরিণত ও প্রসারিত হয়েছে।

উপেন্দ্রকিশোরের কাজ, বই সম্পর্কেও ধারণা একটা দেয়। সেটি এই, বই একটি সামগ্রিক আইডিয়ার প্রকাশ। লেখকের চিন্তা, বইয়ের আকার, প্রচ্ছদ, অলংকরণ, অক্ষর বিন্যাস, মুদ্রণ, বাঁধাই—মুদ্রণের আগে ও পরের স্তরগুলো নিয়ে বই একটি আইডিয়া বা চিন্তার সমগ্রকে প্রকাশ করে থাকে। বাঙালির ইতিহাসে সম্ভবত তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি মুদ্রণ সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিকে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। মুদ্রণ প্রযুক্তি বিষয়ে তার লেখাও আছে। ব্রিটিশ মুদ্রাকর ও প্রকাশকদের তিনি এ বিষয়ে প্রভাবিত করেছিলেন। 

১৮৯৫ সালে ইউ.রে অ্যান্ড সন্স নামে ছোট একটি প্রকাশনী দিয়েছিলেন তিনি। ‘সেকালের কথা’ বেরিয়েছিল এখান থেকেই। বইটির ভূমিকায় বলেছেন, ‘এই সকল ছবি এই পুস্তকের জন্যই বিশেষভাবে অঙ্কিত হইয়াছিল। ইহাদের একটিও ইংরাজি পুস্তকের ছবির নকল নহে।’ তার বক্তব্যের শেষ বাক্যটির প্রতি মনোযোগ দিতে ইচ্ছে করে।

উপেন্দ্রকিশোর শুধু ছবি নয়, চিন্তারও কোনো নকল করেননি। অথচ অনায়াসে তিনি ব্যবহার করতে পারতেন বিদেশি ছবির অনুলিপি। হয়তো দেশজ ও মৌলিক হওয়ার তাগিদ তাকে আলোড়িত করেছিল। কিন্তু দেশজতা নির্মাণ করেনি কূপমণ্ডূকতার অন্ধ সুড়ঙ্গ। এর প্রমাণ মেলে তার লেখা প্রবন্ধগুলোতে।

বিচিত্র বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন উপেন্দ্রকিশোর—জীবজন্তু, ফটোগ্রাফি, ছবি, মুদ্রণযন্ত্র, সংগীত, সুর—সবই শিশুকিশোর উপযোগী। জ্ঞানের বহুমাত্রিক বিশ্বে পরিভ্রমণের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে তিনি সাজিয়ে ছিলেন ‘সন্দেশ’র পাতা। আর তা মনোযোগ কেড়েছিল ছোট বড় সবার। নামটিও কী অদ্ভুত অর্থদ্যোতনাময়। সন্দেশ একই সঙ্গে নতুন সংবাদের উৎস, আবার যেনবা মিষ্টি খাবার, যা লোভনীয় ও মনোগ্রাহী।

শিশু মনস্তত্ত্ব নির্মাণের এই স্থপতিকে বাঙালি খুব বেশি দরদ দিয়ে ভাবেনি। বিস্মৃতির অতলে হয়তো তিনি ডোবেননি, আবার মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণের আলোও তার ওপর পড়েনি। কিন্তু বিশেষভাবে আলো পড়তেই পারে উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার ও সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টিকর্মের ওপর। একইভাবে ইতিহাসের আলোয় উজ্জ্বল হতে পারেন উপেন্দ্রকিশোরের কন্যা সুখলতা রাও, পুণ্যলতা চক্রবর্তী।

বাংলা শিশুকিশোর সাহিত্যে এই একগুচ্ছ প্রতিভা প্রায় কাছাকাছি; অথচ প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র সৃষ্টির বিচিত্র সম্ভার নিয়ে হাজির। অনেকেই জানেন সুকুমার, সুখলতা, পুণ্যলতা ও সত্যজিৎ রায়ের মধ্যস্থতায় উপেন্দ্রকিশোরের অনেক অনেক চিন্তা পরিণত ও প্রসারিত হয়েছে।

উপেন্দ্রকিশোরের এক ‘সন্দেশ’ বহু বছর জুড়ে বহন করেছেন সুকুমার-সত্যজিৎ। পুত্র সুকুমারকে মুদ্রণ প্রযুক্তি সম্পর্কে পড়তে পাঠিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। সুখলতা এঁকেছেন ছবি, কবিতা লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন রূপকথা। পুণ্যলতা লিখতেন উপন্যাস, অনুবাদ গল্প। লেখালেখি, সংগীত ও ক্যামেরা তিনটিকে দুই হাতে সামলেছেন সত্যজিৎ। পিতা, পিসি ও পিতামহের ধারাকে তিনি নিয়ে গেছেন প্রতিভা সমুজ্জ্বল পথে। উৎসে আছেন সেই উপেন্দ্রকিশোর—শিশুকিশোরের মনস্তত্ত্বে যিনি বুনেছিলেন বহুবর্ণ সৃষ্টি বীজ। আর তাই আবারও স্মৃতির তোরঙ্গ খুলে দেখা দরকার বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কতখানি গভীরে ব্যাপ্ত ছিলেন একজন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী।

সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়