ছবি : সংগৃহীত

অবাক হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। বিস্মিত হইনি আমি মোটেও। যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে আসছে। সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে দগ্ধ, আহতদের রক্ত দিতে ছুটে আসছিল তারা।

আবেগে আপ্লুত হইনি যখন দেখেছি, বিস্ফোরণ এলাকার মৃত্যুকূপের সামনে, হাসপাতালে ভিড় করা তরুণদের হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা—‘কোনো প্রকার ওষুধের প্রয়োজন হলে বলুন, কারও রক্ত লাগলে জানান।’

উচ্ছ্বসিত হইনি যখন শুনতে পেলাম, চট্টগ্রামের রিকশা, অটো, সিএনজি হাসপাতাল ও সীতাকুণ্ড মুখী স্বজন ও স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে ভাড়া নিচ্ছেন না। দগ্ধদের জন্য ওষুধ নিয়ে ছুটেছেন চট্টলার মানুষেরা। ওষুধের দোকানিরাও বিনামূল্যে ওষুধ দিয়েছেন।

অর্থ সাহায্য নিয়েও পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন বহু মানুষ। এই দৃশ্য আমার কাছে নতুন লাগেনি একদমই। বরং স্বাভাবিক মনে হয়েছে। আমজনতার এই আবেগকেও লেগেছে অতি সাধারণ। 

সেই ২০০২ সালের ৩ মে থেকে ৫ দিন দেখেছিলাম, সাধারণ মানুষের শক্তি। ডুবে যাওয়া লঞ্চের যাত্রীদের উদ্ধারে এগিয়ে থাকতে দেখেছি মেঘনার দুই কূলের মানুষদের।

কারণ যখন ষাটনলে মেঘনায় ডুবে গেল এমভি সালাউদ্দিন-২, তখন সেই ২০০২ সালের ৩ মে থেকে ৫ দিন দেখেছিলাম, সাধারণ মানুষের শক্তি। ডুবে যাওয়া লঞ্চের যাত্রীদের উদ্ধারে এগিয়ে থাকতে দেখেছি মেঘনার দুই কূলের মানুষদের।

শুধু নিখোঁজ বা ডুবে যাওয়া যাত্রীদের উদ্ধারেই নয়, অপেক্ষমাণ স্বজন ও উদ্ধার দলের জন্যও চিড়া, মুড়ি, গুড়, ভাত নিয়ে নদীর পাড়ে এসে হাজির হয়েছিলেন শত শত মানুষ।

একই দৃশ্য দেখেছি দিন পনের বাদে বলেশ্বরের লঞ্চ দুর্ঘটনায়। মঠবাড়িয়া-পিরোজপুরের মানুষ যেন তাদের সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিলেন।
ভুলতে পারিনি, ভোলা যায় না। আশুলিয়ার স্পেকট্রাম ভবন ধসের সময় আশপাশের কারখানার শ্রমিক, সাধারণ মানুষই শুধু নয়, দূর দূরান্ত থেকে আসা মানুষ, চিকিৎসক, বিভিন্ন বিদ্যায়তনের শিক্ষার্থীরা এসে কংক্রিটের নিচে চাপা পড়া মানুষদের উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছেন। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন খাবার ও ওষুধ নিয়ে।

তাজরিন গার্মেন্টসের আগুন, বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের সময় আমরা আমজনতার সম্মিলন দেখেছি। দমকল বাহিনীর পাশাপাশি পথশিশুকেও দেখা গেছে পানির পাইপ নিয়ে ছুটতে।

রানাপ্লাজা ধসতো পুরো বাংলাদেশকে একাট্টা করে তুলেছিল। কেউ কাউকে খবর দেয়নি। নির্দেশনা দেয়নি। নিজের ব্যক্তিগত চাকরি, ব্যবসা ছেড়ে এসে দিনের পর দিন যুক্ত ছিলেন উদ্ধার অভিযানে।

আর করোনাকালতো মানুষের পাশে মানুষ, প্রকৃতির পাশে মানুষ, প্রাণীর পাশে মানুষের ইতিহাস হয়ে রইল। আমরা টিভি ক্যামেরা, পত্রিকার পাতা এবং সামাজিক মাধ্যমে যাদের উদ্যোগ ও পাশে থাকার ছবি ও খবর দেখেছি, তা অতি সামান্যই মাত্র।

আড়ালে কত মানুষ যে বিপর্যস্ত, নিঃস্ব মানুষের পাশে ছিলেন এবং এখনো আছেন, সেই পরিসংখ্যান অজ্ঞাত। এই অজ্ঞাতদের প্রায় সবাই বাংলাদেশের ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ নন।

আড়ালে কত মানুষ যে বিপর্যস্ত, নিঃস্ব মানুষের পাশে ছিলেন এবং এখনো আছেন, সেই পরিসংখ্যান অজ্ঞাত। এই অজ্ঞাতদের প্রায় সবাই বাংলাদেশের ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ নন।

তাদের মুরোদ নেই টাকা ভিনদেশে উড়িয়ে নেওয়ার। কিংবা ব্যাংকে আমানত থাকা অন্যের বা রাষ্ট্রের টাকা নিজের করে নেওয়ার। পুকুর চুরি, নদী চুরি বা জমিন চুরির জঘন্য অপরাধ তাদের কাছ থেকে ভয়ে নিরাপদ দূরেই থাকে।

ঐ মানুষগুলোর সামান্য ইচ্ছেও হয় না নিজেকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার। কারণ নিবেদিত এই মানুষদের একমাত্র চাওয়া ভালো থাকুক, সুন্দর থাকুক বাংলাদেশ।

তাই যে চরিত্র বাংলাদেশের জন্মগত, এই দ্বীপের মানুষের শিরায় শিরায় প্রবাহমান, মানুষকে ভালোবাসার। মানুষের জন্য, দেশের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করার।

সেই বাংলাদেশের মানুষ তো সীতাকুণ্ডের অগ্নিকুণ্ডে নিজে দগ্ধ হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই, ঝাঁপ দেবে মানুষের জীবন রক্ষায়। দমকল বাহিনীর সদস্য ও সাধারণ স্বেচ্ছাসেবীরা তো সেই কাজটিই করেছেন। অতএব বিস্মিত হতে পারছি না আমি।

কতিপয় চরিত্র হারানো, দেশ বিমুখ বাংলাদেশের পরিচয় হতে পারে না। বাংলাদেশের পরিচয় ঐ তরুণ সিএনজি চালক, যার গলায় ঝুলানো প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল—‘হাসপাতালে যেতে বা রোগীর সেবায় পরিবহন সংকটে পড়লে ফোন করুন নিচের নম্বরে..’। এই আম জনতারই বাংলাদেশ।

তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী