ছবি : সংগৃহীত

গত মাসের মাঝামাঝি হঠাৎ বন্যায় ভেসে যায় সিলেট-সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা। ভারতের আসাম-মেঘালয়ে রেকর্ড বৃষ্টি সিলেট অঞ্চলে সৃষ্টি করেছিল স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির। তখন ধারণা করা হয়েছিল পানি যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি দ্রুত নেমেও যাবে। কিন্তু পানি নেমে যাওয়ার উপায়গুলো আমরা আস্তে আস্তে বন্ধ করে ফেলেছি বলে, পানি নামছিলও আস্তে আস্তেই। 

হাওরের বিভিন্ন এলাকায় অপরিকল্পিত রাস্তা নির্মাণ করে পানি সরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে ফেলা, সুরমা-কুশিয়ারার তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় সিলেট এলাকার বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হয়। সঙ্গে প্লাবিত হয় দেশের আরো অনেক এলাকা। 

প্রাকৃতিক কারণেই বাংলাদেশ বন্যাপ্রবণ এলাকা। উজানের পানি বাংলাদেশ হয়েই বঙ্গোপসাগরে যাবে। তাই সাধারণ বন্যা বাংলাদেশের ফিবছরের চিত্র। স্বাভাবিক বন্যা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদও বটে। প্রতিবছর বন্যা হয় বলেই বাংলাদেশের মাটি এত উর্বরা।

এতটুকু দেশে যে এত মানুষের খাবার ফলে সে কিন্তু এই উর্বরা শক্তির গুণেই। কিন্তু এই আশীর্বাদের বন্যা মাঝে মাঝে অভিশাপ ডেকে আনে। এবার যেমনটি হয়েছে, বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে।

অস্বাভাবিক বন্যা বহুমুখী সমস্যা ডেকে আনে। প্রথমত বাড়ি-ঘর ডুবে গেলে মানুষ সাময়িকভাবে হলেও বাস্তুচ্যুত হয়। মানুষ তখন আশ্রয় নেয় কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে। বন্যা স্বল্পস্থায়ী হোক আর দীর্ঘস্থায়ী, বন্যার ভোগান্তি কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে থাকে। পানি কমতে শুরু করলে বাড়তে থাকে ভোগান্তি। পানি কমলে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরতে গিয়ে মানুষ প্রথম ধাক্কাটা খায়। অনেক বাড়িঘর বন্যায় ভেসে যায়। 

পত্রিকার খবর অনুযায়ী, এবার শুধু সিলেটেই অন্তত ৫০ হাজার ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৃহত্তর সিলেট এবং পুরো দেশের চিত্র বিবেচনায় নিলে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে। এখন এই ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের মানুষগুলো কোথায় ফিরবে?

নতুন করে ঘর বানানোর সামর্থ্যও সবার থাকে না। আর বন্যা মানুষের সামর্থ্যের অনেকটাই কেড়ে নেয়। বন্যা ঘর, সম্পদ তো ভাসিয়ে নেয়ই, ভাসিয়ে নেয় ক্ষেতের ফসল, গবাদি পশুও। ঘরে ফিরতে পারলেও কী খাবে, সে চিন্তাও পেয়ে বসে বন্যার্তদের। 

বন্যায় মানুষ নিজেরা তো বিপদে পড়েই, বিপদে পড়ে গবাদি পশু নিয়েও। নিজেদের খাবারই যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে গবাদি পশুর খাবার জোগাড় করা, তাদের টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। বড় খামারিদের সমস্যা তো অনেক বড়, গ্রামের সাধারণ মানুষের সমস্যারও অন্ত নেই।

গ্রামে অনেকে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে পশু পালন করে। তাদের আকাঙ্ক্ষা থাকে কোরবানির হাটে ভালো দাম পেলে সারাবছরের একটা আয় হবে। কিন্তু হঠাৎ বন্যায় অনেক মানুষই গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েন। অনেকে ঈদের আগেই সস্তায় গরু বিক্রি দিতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে যে লাভের আশায় গরু লালন-পালন করছিলেন, সে লাভের মুখ তো দেখেনইনি, উল্টো গচ্চা দিতে হয়েছে।

বন্যার সবচেয়ে বড় দুর্ভোগটা শুরু হয় পানি কমতে শুরু করার পর। চারদিকে পানি থাকলেও খাওয়ার মতো পানি থাকে না। যে পানি থাকে, তাতে ভেসে বেরায় নানা রোগের জীবাণু। ফলে পানিবাহিত নানা রোগ যেমন পেটের পীড়া, চর্মরোগ বন্যার্ত মানুষের দুর্ভোগ আরো বাড়িয়ে দেয়। সবমিলে বন্যার পানি কমতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে বহুমুখী সমস্যা চেপে বসে বন্যার্ত মানুষের কাঁধে।

এমনিতে দুর্যোগের সঙ্গেই বাংলাদেশের মানুষের বসবাস। প্রতিবছরই ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলা করেই টিকে থাকতে হয় আমাদের। তাই দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের একটা সহজাত ক্ষমতা আছে। বারবার দুর্যোগ আমাদের শূন্য করে দেয়। আমরা বারবার লড়াই করি, বারবার উঠে দাঁড়াই। কিন্তু সবার সে লড়াই করার সামর্থ্য থাকে না। লড়াই করার মানসিক জোর থাকলেও সামর্থ্য কেড়ে নেয় দুর্যোগ। 

আবার দুর্যোগ বাংলাদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। এক এলাকার দুর্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোটা দেশের মানুষ। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে যেটা ঘটে, দুর্যোগের প্রাথমিক অবস্থায় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সরকার, এনজিও সবাই তৎপর থাকে। আস্তে আস্তে সবার নজর সরে যায়। 

দুর্যোগ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে মানুষের যখন সত্যিকারের সাহায্য দরকার, তখন আমরা তাদের ভুলে যাই। বন্যা এখন আর গণমাধ্যমের শিরোনাম নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইস্যুও বদলে গেছে।

সরকার তার রুটিন ওয়ার্ক চালিয়ে গেলেও মৌসুমি ত্রাণদাতারা মনে করছেন তাদের দায়িত্ব শেষ। অথচ বন্যার্তদের সত্যিকারের সাহায্যটা এখনই দরকার। ঘর বানাতে সাহায্য দরকার, পানিবাহিত রোগ থেকে বাঁচতে সাহায্য দরকার, নতুন করে চাষাবাদ শুরু করতে সাহায্য দরকার, গবাদি পশু টিকিয়ে রাখতে সাহায্য দরকার।

দুই ঈদ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা নিয়ে আসে। কিন্তু এবার বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে সেই আনন্দের ঢেউ হয়তো পৌঁছাবে না। ঈদের সময়ও অনেক এলাকা বন্যাকবলিত থাকবে। যেসব এলাকায় পানি কমছে, সেখানেও থাকবে নানাবিধ সমস্যা। তাই আমরা যেন সেই বন্যার্ত মানুষদের ভুলে না যাই।

যেসব মানবিক উদ্যোগ নিয়ে আমরা বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছি, তাতে যেন ভাটা না পড়ে। কোরবানি থেকে কিছু অর্থ বাঁচিয়ে বা মাংস বাঁচিয়ে বা চামড়া বিক্রির টাকাটা যেন আমরা বন্যার্তদের জন্য আলাদা করে রাখি। 

আপনি যদি এক লাখ টাকা দিয়ে গরু কেনার পরিকল্পনা করে থাকেন, তাহলে এবার ৮০ হাজার টাকায় গরু কিনুন। বাকি টাকাটা বন্যার্তদের জন্য রাখুন। ঈদের আনন্দের চেতনাটাই হলো, সবার ঘরে ঘরে আনন্দ পৌঁছে দেওয়া। সবাই আনন্দ করতে না পারলে, ঈদের আনন্দ পূর্ণতা পাবে না।

আমরা সবাই মিলে যদি বন্যার্তদের পাশে শুরুতে যেমন ছিলাম, এখনও তেমন থাকি; তাহলে সবাই মিলে আনন্দটা ভাগাভাগি করে নিতে পারব। ঈদ হোক সবার, আনন্দ আসুক সবার ঘরে।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ