ছবি : সংগৃহীত

খারাপ সিনেমা আসলে কী? সাধারণভাবে অধিকাংশের উত্তর প্রায় একই ধরনের হবে। কম বাজেটের প্রোডাকশন, খারাপ অভিনয়, হিরো বা হিরোইন বা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা দেখতে ভালো না বা দুর্বল স্ক্রিপ্ট বা প্লট, গান ভালো না, ক্যামেরার কাজ ভালো না, ভিজ্যুয়ালের কাজ ভালো না, আনন্দ দেয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ আমাদের আকাঙ্ক্ষার লেভেল হবে স্পাইডার ম্যান, বাহুবলী, ম্যাট্রিক্স প্রভৃতি সিনেমাগুলো। অবশ্য এটাও সত্য জনপ্রিয় সিনেমার ক্ষেত্রে এগুলোর একটি বা সমন্বিত বিষয় সিনেমাকে বক্স অফিসে ফ্লপ করতে  পারে।

আপনি যখন ভালো সিনেমার কথা বলেন তখন এটি ব্যক্তি বিশেষে আলাদা হয়ে থাকে। একটি ভালো সিনেমা নির্ভর করে, আপনি কীভাবে দেখেন এবং সিনেমা দেখার পরে আপনার ওপর কী প্রভাব পড়ছে তার উপর।

একটি ভালো সিনেমা একটি শিল্প ফর্ম নাও তৈরি করতে পারে অথবা এটি এমন একটি ফর্ম হতে পারে যা দর্শকের কাছে সহজ এবং দর্শকদের নতুন কিছু ধারণা উপহার দিতে পারে যা দর্শক আগে কখনো দেখেনি এতে তার চিন্তার পরিসর প্রসারিত করে। এটি করার জন্য কিন্তু শতশত কোটি টাকা বা সর্বাধুনিক ভিজ্যুয়ালের দরকার হয় না। দরকার হয় বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তার প্রয়োগ।

আরও পড়ুন : চলচ্চিত্র বিষয়ক এজেন্ডাটা কী? 

এখানে আমরা একটি ইজমের কথা উল্লেখ করতে পারি মিনিমালিস্ট ফিল্ম, মানে আমরা সাধারণত চলচ্চিত্রের যে আন্দোলনগুলোর সাথে পরিচিত তাদের মধ্যে এটিও একটি অন্যতম চলচ্চিত্র আন্দোলন তবে তার থেকে ভিন্ন কিছু।

মাস্টার মিনিমালিস্টদের মধ্যে ইয়াসুজিরো ওজু (Yasujirō Ozu) -এর মতো চলচ্চিত্র নির্মাতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন যাদের শৈলী তাদের ভিজ্যুয়ালগুলোর রচনার সাথে তাদের কঠোর নিয়মানুবর্তিতা দ্বারা চিহ্নিত।

একজন মধ্যবিত্ত ব্যক্তি যিনি খুব কমই সিনেমা হলে যান তিনি অবশ্যই একটি আর্ট হাউস ফিল্ম আশা করবেন না। তিনি একটি ধীর বার্ন বা ধীর গতির চলচ্চিত্র দেখতে মানসিকভাবেই চাইবেন না। যদি এই শ্রেণির দর্শককে চলচ্চিত্র বিশ্বাসঘাতকতা করে অর্থাৎ আনন্দ না দেয় তবে তিনি আর কখনোই প্রেক্ষাগৃহে যাবেন না।

তার জন্য, একটি সিনেমা যা তাকে তার অর্থ অপচয় না করার তৃপ্তি দেয় সেটি কিন্তু সে তার ভালো সিনেমার মতো মনে করবে। তা সে আমাদের বুদ্ধিদীপ্ত দর্শককে যতটাই মুমূর্ষু করুক না কেন তাতে কিছু যায় বা আসে না।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ দর্শকই এমন। সব দর্শক সিনেমার জন্য প্রেক্ষাগৃহে যায় না। আমাদের মতো সব দর্শক সিনেমা উপভোগও  করবে না। একটি ভানো সিনেমা সাধারণত দর্শকদের সন্তুষ্ট করার দায়বদ্ধতা না নিলেও তাদের ওপর প্রভাব ফেলে।

আরও পড়ুন : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র (১৯৪৭-১৯৭৫) শিল্পের স্বকীয়তা 

সিনেমার অনেকগুলো সামাজিক শক্তি আছে যা এর সৃষ্টিলগ্ন থেকে মানুষ এবং সমাজকে প্রভাবিত করে আসছে। সিনেমা হলো এমন কিছু যা আপনার ভেতরে এমন আবেগকে জাগিয়ে তোলে যা আপনি আগে কখনো জানতেন না। এটি মানুষের চিন্তাকল্পে এমন ছাপ ফেলে যা চিরকালও স্থায়ী হতে পারে।

যোগাযোগের তত্ত্বে সিনেমা মানুষের মধ্যে স্নেহের বিষয় হয়ে ওঠে এবং তাদের কাছাকাছি নিয়ে আসে। একটি ভালো সিনেমা এমনকি বিভিন্ন ধরনের বা জাত-পাতের সমস্যা সম্পর্কিত মানুষের মধ্যে পার্থক্য অতিক্রম করতে পারে, যা পার্থক্য সত্ত্বেও উভয়েই সিনেমার প্রশংসা করতে বাধ্য হয়।

প্রাপ্তবয়স্ক থেকে শিশু সবার জন্য আনন্দ নিয়ে আসে; এটি একটি সামাজিক মাধ্যম যা প্রায় সব বয়সের দ্বারা প্রশংসিত হতে পারে। একটি ভালো সিনেমার প্রভাবে মানুষের সম্পর্কগুলোকে ভালোভাবে ধরে রাখে এবং এমন আবেগ জাগিয়ে তোলে যা আপনার নিজের ভালোর অন্বেষণের জন্য খুব গভীরে লুকিয়ে থাকে।

আসলে একজন মানুষ যখন হলের অন্ধকারে বসে একটি সিনেমা দেখতে থাকে তখন কিছু ছবি, কিছু মায়া, কিছু শব্দ এবং রঙের একটি সমষ্টিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে জীবনের কিছুটা সময়কে সে অতিক্রম করে যা তার মনকে আন্দোলিত করে।

বাংলা সিনেমার ইতিহাসও কিন্তু অল্প দিনের নয়। সেই ১৯০৩ সালে নির্মিত হীরালাল সেনের আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের হাত ধরেই। তখন বঙ্গভঙ্গ হয়নি। একসাথেই সব বাঙালিরা বসবাস করতেন তা বলাই যায়। কিন্তু সমস্যা হলো ধর্মে।

তখন ইতিহাস মতে এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই ছিল হিন্দু। মুসলমানেরাও যে খুব একটা ধর্মকর্ম বুঝতেন তারও প্রমাণ মেলে না।  ভারতীয় সংস্কৃতির প্রায় সব কিছুই হিন্দু বা সনাতন ধর্ম গ্রহণ করে কিন্তু মুসলমানদের তো তা হচ্ছিল না। সংস্কৃতির সাথে অনেক কিছুর গরমিল হচ্ছিল। চলচ্চিত্রের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম নেই।

আরও পড়ুন : এখন তাহলে কোন জীবন থেকে নেবেন?

ইসলামের পরিভাষায় চলচ্চিত্র বানানোতো দূরের কথা, দেখাও হারাম। চলচ্চিত্র আর দশটা বিষয়ের মতোই যে একটি কলা, শিল্প, কৌশল, বিদ্যা, জ্ঞান, বিজ্ঞান, চর্চা, অধ্যবসায়, যুক্তি, দর্শন, নৃত্য, চিত্রকলা এক কোথায় সব তার থেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মুসলমানেরা দূরে সরে যাচ্ছিল।

কিছু মুসলমান হিন্দু নাম দিয়ে সিনেমায় নাম লেখিয়েছিল বটে কিছু তা খুবই সামান্য। জানা যায়, এদের মধ্যে রয়েছেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ, হিমাদ্রী চৌধুরী (ওবায়েদ উল হক), কিরণকুমার বা ফতেহ লোহানী, স্বপনকুমার বা কাজী খালেক, উদয়ন চৌধুরী বা ইসমাইল মোহাম্মদ, বনানী চৌধুরী বা বেগম আনোয়ারা, আবদুল আহাদ, নাজীর আহমদ, ইনাম আহমদ, বেবী ইসলাম, কিউ.এম জামান প্রমুখ।

হিমাদ্রী চৌধুরী দুঃখে যাদের জীবন গড়া (১৯৪৬) প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন। উদয়ন চৌধুরী মানুষের ভগবান (১৯৪৭) সিনেমা নির্মাণ করে অভিযুক্ত হন ও জেলে যান। এরপর বাংলা সিনেমা এগিয়ে চলছে তার আপন গতিতে।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বাংলা সিনেমা বিভক্ত হয়ে গেছে দুটি ভৌগোলিক অংশে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ। নাম দুই বাংলার সিনেমা হলেও এই বাংলার প্রধান ধারার সিনেমা ছিল উর্দুই। প্রাদেশিকতার তকমায় এখানে কিছু বাংলা সিনেমা তৈরি হতো।

আরও পড়ুন : তারেক মাসুদ : স্বপ্নদ্রষ্টা, আলোকবর্তিকা 

ইন্ডাস্ট্রি বা দক্ষ কলাকুশলী একেবারেই ছিল না। হয় করাচি, না হয় কলকাতার উপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হতো। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরের বছর বছর সরকারি প্রচারচিত্র নির্মাণের জন্য জনসংযোগ বিভাগের অধীনে চলচ্চিত্র ইউনিট (১৯৫৩) গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে এখান থেকে নাজীর আহমদের পরিচালনায় নির্মিত হয় প্রামাণ্যচিত্র সালামত।

একই বছর ১৯৫৪ সালে গঠিত হয় ইকবাল ফিল্মস এবং কো-অপারেটিভ ফিল্ম মেকার্স লিমিটেড। এরপর ১৯৫৫ সালে নাজীর আহমদের উদ্যোগে ঢাকায় প্রথম ফিল্ম ল্যাবরেটরি এবং স্টুডিও চালু হলে বিদেশি নির্ভরতা কিছুটা কমে। তিনি পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার প্রথম নির্বাহী পরিচালক হন। তার কাহিনি থেকে ফতেহ লোহানী নির্মাণ করেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র আসিয়া (১৯৬০)।

১৯৫৫ সালে জুন মাসে তেজগাঁওয়ে সরকারি ফিল্ম স্টুডিও চালু হয় এবং ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট আবদুল জব্বার খান পরিচালিত বাংলাদেশের প্রথম সবাক বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ মুক্তি পায়। এখানে মনে রাখতে হবে এর ঠিক এক বছর আগেই অর্থাৎ ১৯৫৫ সালে কিন্তু সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালি সিনেমায় কিন্তু বাস্তববাদী তত্ত্বকে প্রয়োগ করে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এখানে বলতে অসুবিধা নেই যে তখন সত্যজিৎ রায় কিন্তু বাংলাদেশি নয় একজন বাঙালি পরিচালক। সেই হিসেবে আমরা গর্ববোধ করতেই পারি।

আরও পড়ুন : সালমান শাহ : চলচ্চিত্রের স্টাইলিশ আইকন

১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান (বঙ্গবন্ধু, পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি) উত্থাপিত বিলের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (ইপিএফডিসি) প্রতিষ্ঠিত হলে এর সহযোগিতায় ১৯৫৯ সালে থেকে প্রতিবছর চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে থাকে।

১৯৫৭ এবং ১৯৫৮ সালে এদেশে কোনো চলচ্চিত্র মুক্তি পায়নি। এফডিসি ছাড়াও পপুলার স্টুডিও, বারী স্টুডিও এবং বেঙ্গল স্টুডিও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পরিস্ফুটনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। এরই ধারাবাহিকতায় বিদেশি নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব কলাকুশলী দ্বারা ষাট এবং সত্তরের দশক মিলিয়ে হাতেগোনা কয়েকটি বাংলা ও উর্দু সিনেমা তৈরি হয়।

অন্যদিকে আমরা যদি পশ্চিমবাংলার চলচ্চিত্রের ইতিহাস দেখি তাহলে দেখব ওটিকে মোটা দাগে তিনটি ভাগে ভাগ করা আছে। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত নির্বাক যুগ। ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪৭ টকির উত্থান যুগ এবং স্বর্ণযুগ ছিল ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত। অর্থাৎ বাংলা সিনেমার এই স্বর্ণযুগে আমাদের বাংলাদেশের সিনেমা হাঁটি হাঁটি পা পা করছে।

আরও পড়ুন : ভাষা আন্দোলনকে নিছক জাতীয়তাবাদী মোচড়ে আমি দেখি না 

তাহলে আমাদের অনুমান করতে কোনো কষ্ট হবে না যে আমরা ওই বাংলার চলচ্চিত্র থেকে কতটা পিছিয়ে পড়েছিলাম। তার করণগুলো নিয়ে অনেক কৌশলগত ও ঐতিহাসিক গবেষণা করা যায় কিন্তু আমরা যদি সহজভাবে চিন্তা করি তাহলে দেখব পশ্চিমবাংলার হিন্দুরা সিনেমাকে যতটা কঠোর, আন্তরিক, গভীর এবং চিন্তাশীলভাবে নিয়েছেন আমরা তা পারিনি। এই জন্যই আমাদের সিনেমার বর্তমান এত খারাপ অবস্থা বলে আমি মনে করি।

আজকে আমি চলচ্চিত্র শিক্ষার কথা যদি বলি তাহলে আশির সত্তর বা দশক থেকেই ভারতের চলচ্চিত্র স্কুলগুলো বিশ্বমানের। সেখান থেকে প্রতিবছর ছাত্রছাত্রীরা পাস করে বেরিয়ে এসে ধারাবাহিকভাবে চলচ্চিত্র উন্নয়নের বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে।

আমি নিজে উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রবিদ্যা অধ্যয়নের পীঠস্থান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলচ্চিত্রবিদ্যায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছি। সম্মানিত পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র উন্নয়নের কোনো কাজেই অসতে পারছি না।

বর্তমানে শুধু আমি একা নই দেশে গড়ে উঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও আরও অনেক শিক্ষিত চলচ্চিত্র কর্মীরা বেকার বা অন্য কাজ করে জীবন ধারণ করতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ সিস্টেম, সিন্ডিকেট, দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতির কারণে অযোগ্য, মূর্খ বা সুযোগ সন্ধানী পুঁজিপতিরা এই মহান সেক্টরকে দখল করে বাংলাদেশের সিনেমাকে ক্রমাগত নিঃশেষ করে দিচ্ছে।

এর থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সমাজের দর্পণ চলচ্চিত্র মধ্য দিয়ে আমাদের জাতিসত্তাকে আর পরিষ্কার দেখাই যাবে না। বিশ্ব দরবারে আমরা বেঁচে থাকব একটি পঙ্গু জাতি হিসেবে।

নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক