বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন এবং এই নির্বাচনকে ঘিরে আস্ফালন, ফলাফল ঘোষণার নাটকীয়তা এবং সর্বোপরি সামাজিক ও গণমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা দেখে মনে হলো প্রচলিত সেই বাগধারাটির কথা, ‘ঘটি ডোবে না নামে তালপুকুর’। এই নির্বাচনটির অবস্থা হয়েছে একেবারে তাই।

নাই এফডিসির কোনো জৌলুস, নাই চলচ্চিত্রের কোনো মান, নাই সিনেমা হলে দর্শক, নাই শিল্পী তারকার সেই অবস্থান, অথচ ছোট এই নির্বাচনকে ঘিরে এফডিসি ছিল জমজমাট। টাকা দেওয়া নেওয়া, কান্নাকাটি, আবেগ-বিবেক, টিকা-টিপ্পনী, বিভিন্ন প্যানেলের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ, কুৎসা রচনা ইত্যাদি বিষয়ে নানান ঘটনা আমাদের চোখে পড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, এই নির্বাচনই বুঝি বাংলা সিনেমার কোনো অংশ।

এইসব কারবার দেখে বাংলাদেশের সিনেমার একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে আমার জানতে ইচ্ছা করছে, কেন শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে এত হুলুস্থুল অবস্থা? যে এফডিসির এখন মৃতবৎ অবস্থা, যে এফডিসিতে গেলে মনে হবে যে, সিনেমা বানানোর জায়গা নয়, কোনো দারিদ্র্যপীড়িত জর্জরিত ভবন, যেখানে নির্মিত সিনেমা দেখার জন্য দর্শক আর হলে যায় না, যে অঙ্গনে নতুন নতুন শক্তিমান অভিনেতা-অভিনেত্রী তৈরি হচ্ছে না, যে শিল্প অভিমুখে পড়াশোনা জানা ছেলেমেয়েরা যাচ্ছেই না বলা চলে, সেই জায়গার একটি নির্বাচনকে ঘিরে এত উত্তেজনা কেন?

প্রায়ই প্রশ্ন উঠে, এখন বাংলা সিনেমার যে আকাল যাচ্ছে এর জন্যে দায়ী কে? অনেকেই বলেন, ভিনদেশি সিনেমা বা আকাশ সংস্কৃতি এসে আমাদের চলচ্চিত্রের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। অনেকেই অভিযোগ করেন, সরকার ভালো সিনেমার জন্য কোনো প্রণোদনা দেয় না বলে এই গরিবি অবস্থা। কেউ বলেন, দর্শক দেশি সিনেমা দেখতে চান না, তাই হলে যান না।

নাই এফডিসির কোনো জৌলুস, নাই চলচ্চিত্রের কোনো মান, নাই সিনেমা হলে দর্শক, নাই শিল্পী তারকার সেই অবস্থান, অথচ ছোট এই নির্বাচনকে ঘিরে এফডিসি ছিল জমজমাট।

কিন্তু আমরা যদি প্রশ্ন করি, দেশে কয়টি ভালো সিনেমা তৈরি হচ্ছে? কয়জন ভালো পরিচালক, প্রযোজক তৈরি হচ্ছেন? কতজন ভালো অভিনয় শিল্পী আছেন সিনেমা জগতে? অনেকে নামে আছেন, কিন্তু কাজে নেই। অনেককে নিয়ে শুধু ট্রল ছাড়া আর কিছু হয় না।

এই যে শিল্পী সমিতি বা এফডিসি, তাদের কাজের কোনো জবাবদিহিতা কি আছে? চলচ্চিত্রের উন্নতির কথা কে ভাবছেন, কীভাবে ভাবছেন একথা বলতে পারেন কেউ? শুধু নিজেদের পদ ধরে রাখার জন্য এবং খোঁচাখুঁচি করার জন্য যে নির্বাচন, তাকে নিয়ে এত শোরগোল কেন?

ভালো সিনেমা বানালে দর্শক যাবেই, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। ‘আয়নাবাজি’, ‘গেরিলা’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘ডুমুরের ফুল’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘মাটির ময়না’, ‘জয়যাত্রা’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘দহন’, ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘রূপালী সৈকতে’, ‘সূর্যস্নান’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ ইত্যাদি সব সিনেমা আমরা প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখেছি। এরকম আরও বহু সিনেমার নাম আমরা বলতে পারব, যা দেখতে দর্শক সিনেমা হলে গিয়েছেন এবং যাবেন।

এছাড়া ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘রংবাজ’, ‘দ্য রেইন’, ‘নয়নমণি’, ‘সুজন সখী’সহ ববিতা, রাজ্জাক, কবরী, সোহেল রানা, শাবানা, ফারুখ, মান্না, সালমান শাহ, মৌসুমী, শাবনুর, পূর্ণিমা অভিনীত অনেক সিনেমা বাংলাদেশের হলে প্রচুর চলেছে।

হয়তো দেখা গেছে এই সিনেমাগুলো সবদিক থেকে উঁচুমানের ছিল না। অভিনয়ও সবসময় একরকম ভালো ছিল না, তাও এদেশের দর্শক কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নেয়নি দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে। কারণ এদেশের মানুষ জানে চলচ্চিত্র একটি দেশের শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশের অন্যতম প্রধান মাধ্যম।

সুস্থ ধারার শিল্পগুণ সমৃদ্ধ ও মানসম্মত চলচ্চিত্র একদিকে যেমন অভিনয় শিল্পীদের নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। তেমনি দেশের অর্থনীতির বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারবে। দেশে রুচিসম্মত চলচ্চিত্র তৈরি হলে ক্রমশ ভালো সিনেমা দেখার দর্শকও তৈরি হবে। কিন্তু আমাদের দেশে বিষয়টা উল্টো দিকে যাচ্ছে।

একটা ভালো চিত্রনাট্য, ভালো পরিচালক, শক্তিশালী প্রযোজক এবং ভালো অভিনয় মিলে তৈরি হবে একটি ভালো চলচ্চিত্র। আমরা যদি উদাহরণ হিসেবে ভারতীয় চলচ্চিত্রের দিকে চোখ রাখি, দেখব কীভাবে সম্মিলিত একটি উদ্যোগ অসাধারণ সব সিনেমা তৈরি করছে যুগের পর যুগ ধরে।

যেখানে নির্মিত সিনেমা দেখার জন্য দর্শক আর হলে যায় না, যে অঙ্গনে নতুন নতুন শক্তিমান অভিনেতা-অভিনেত্রী তৈরি হচ্ছে না, যে শিল্প অভিমুখে পড়াশোনা জানা ছেলেমেয়েরা যাচ্ছেই না বলা চলে, সেই জায়গার একটি নির্বাচনকে ঘিরে এত উত্তেজনা কেন?

একদিকে নাচে-গানে ভরপুর অ্যাকশন সিনেমা, অন্যদিকে সৃজনশীল, জীবন ধর্মী ও ইতিহাস নির্ভর সিনেমা। বাংলাসহ সব ভাষাতেই। এই এক ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে দিয়েই তৈরি করছে ধামাকা চলচ্চিত্র, আবার তাকে নিয়েই তৈরি হলো ‘রাজকাহিনী’। প্রসেনজিতের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

হিন্দি সিনেমার কাহিনি যাই হোক, নায়ক-নায়িকা, স্টুডিও, মেকআপ, কোরিওগ্রাফি মিলে অনবদ্য সৃষ্টি, যা দেশের ও বিদেশের বাজার মাত করে দিচ্ছে।

সিনেমা এমন একটা শিল্প, যা এককভাবে সম্পূর্ণ হবে না। এখানে যেমন বিনিয়োগ লাগবে, তেমনি আইডিয়া, কলাকুশলীসহ লেখার ও অভিনয় ক্ষমতাওয়ালা মানুষ থাকতে হবে। আমি উদাহরণ হিসেবে শুধু ভারতীয় সিনেমার কথাই বললাম। একই কথা প্রযোজ্য ইরান, ফ্র্যান্স, রাশিয়া, বুলগেরিয়াসহ অনেক দেশের ক্ষেত্রে। আর হলিউডের কথা এখানে উল্লেখ করার কোনো মানেই হয় না।

আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন যে মুক্তিযুদ্ধ, সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা কয়টা ভালো সিনেমা নির্মাণ করতে পেরেছি? সাহিত্য ভিত্তিক বা বিজ্ঞান ভিত্তিক বা শিশুদের নিয়ে কয়টা ভালো সিনেমা আমরা বানিয়েছি? বড়জোর দু-একটা।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পালন করলাম কিন্তু চলচ্চিত্রে এর কোনো প্রভাব নেই। উপরন্তু এর বেহাল অবস্থা আরও প্রকটভাবে ফুটে উঠল শিল্পী সমিতির এই অদ্ভুত ও হাস্যকর নির্বাচন দিয়ে।

ভালো চলচ্চিত্র তখনই তৈরি হবে যখন পড়াশোনা জানা মানুষ এটি তৈরির দায়িত্ব হাতে নেবেন। যখন শিল্পী কলাকুশলীরা অভিনয়কে তাদের পেশা হিসেবে নিয়ে এগিয়ে আসবেন। সেই সাথে পড়াশোনা করে নিজেকে বিকশিত করার উদ্যোগ নেবেন।

ভালো সিনেমা না বানালে দর্শক হলে ফিরবেন না, এটাই বাস্তবতা। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার এই যুগে বিশ্বের সব ভালো ভালো সাম্প্রতিক মুভি মানুষের হাতের মুঠোয়। অন্যদিকে মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগ চলছে, বাজারে ভালো প্রোডাক্ট দিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। এখানে দর্শকের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন না তোলাই উত্তম।

শাহানা হুদা রঞ্জনা ।। সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন