কানাডার ভ্যাঙ্কুভার ভিত্তিক বৈশ্বিক আর্থিক তথ্য বিশ্লেষণ ও প্রকাশনা সংস্থা ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট-এর সর্বশেষ ১২ জুলাই ২০২২ প্রকাশনায় বিশ্ব অর্থনীতির পরিধির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর একটি পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে।

আইএমএফ-এর এই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১ সালে বৈশ্বিক জিডিপির পরিধি ছিল প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। যেথায়, বিশ্বের ৫০টি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের তালিকায় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে শুধুমাত্র বাংলাদেশ এবং ভারত স্থান পেয়েছে।

ভারত ২০২১ সালের মতোই ষষ্ঠ বৃহৎ বৈশ্বিক অর্থনীতির স্থান দখল করে রেখেছে। তবে, বাংলাদেশ ২০২১ সালে এক ধাপ উপরে উঠে বিশ্বের ৪১তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।

আরও পড়ুন : অর্থনৈতিক কল্যাণ বাড়বে প্রবৃদ্ধি ও সক্ষমতায়

২০২১ সালের তালিকায় শীর্ষ দেশ যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি ২৫.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বৈশ্বিক মোট জিডিপির এক চতুর্থাংশের চেয়েও বেশি। আর, বাংলাদেশের জিডিপি ৩৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় ০.৪ শতাংশ এবং এটা তার পূর্বের ২০২০ সালের তুলনায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কম।

১৩ জুলাই ২০২২। ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট বিশ্বের উচ্চ ঋণ খেলাপি ঝুঁকিতে আছে এরকম ২৫টি দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে। এটা দেখে অনেকের মনে শঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে যে, আমরাও অচিরেই ঋণ খেলাপি ঝুঁকির আওতায় আসছি কি-না!

কেননা, উচ্চ ঋণ খেলাপি ঝুঁকিতে যুক্ত দেশগুলোর তালিকার শীর্ষে এল সালভাদর থাকলেও সাউথ আফ্রিকা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, তুরস্ক, মিশর, ইউক্রেন ও মেক্সিকোর মতো দেশগুলো ঋণ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে।

৫ মে ২০২২। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করার পর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নিচে নেমে যায় যা প্রায় গত দেড় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। 

বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কারণ না থাকলেও এটা সত্য যে, দিন দিন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে যাচ্ছে।

অন্য দিকে আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের অর্থে অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ)সহ বিভিন্ন ঋণ তহবিল গঠন করেছে যা নন লিকুইড সম্পদ বা ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড সিকিউরিটিজ।

আরও পড়ুন : টাকা পাচারকারীর তালিকাটা অন্তত মানুষ জানুক

ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম-৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী এসব দায় রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত হবে না।

আইএমএফ-এর মতে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৩২ বিলিয়নের বেশি নয়, যা মোটামুটি আমাদের ৪ মাসের আমদানি খরচ মেটাতে পারে। তবে, ৩ মাসের নিচে নেমে এলেই আমরা আর্থিক সমস্যায় পড়তে পারি বলে অনুমান করা হচ্ছে। 

তবে, সরকারের বিভিন্ন পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ রয়েছে তা দিয়ে ৬ মাসের আমদানি মূল্য পরিশোধে যথেষ্ট। তাছাড়া, জিডিপির ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত সরকারি ঋণ নিরাপদ। সেই জায়গায় আমাদের ঋণ জিডিপির মাত্র ৩৬ শতাংশ।

আর, বৈদেশিক ঋণ জিডিপির মাত্র ১৬ শতাংশ এবং বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে সুদের ব্যয় জিডিপি’র মাত্র ২ শতাংশ। সুতরাং, দেশের অর্থনীতির ভিত শক্ত এবং শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

আরও পড়ুন : সঞ্চয়পত্র : মুনাফা হ্রাস, সংকট ও বাস্তবতা 

আপাতত, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কারণ না থাকলেও এটা সত্য যে, দিন দিন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে যাচ্ছে।

বর্তমানে ডলারের মজুদ কমে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো উচ্চ মূল্যে এলএনজি, তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানি। দৈনিক বিপিসিকে লোকসান গুনতে হচ্ছে ১০০ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের উপর চাপ কমাতে গিয়ে এইসব জরুরি জিনিস আমদানি ব্যাপক হারে কমিয়ে দিলে আমাদের শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হবে।

ফলস্বরূপ, রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই, অতি সতর্কতার সাথে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তবে, অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল সামগ্রী আমদানি অবশ্যই কমাতে হবে। একই সাথে, রপ্তানিও বৃদ্ধি করতে হবে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো’র তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি আয় ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৫,০০০ কোটি ডলার আয়ের মাইলফলক পেরিয়েছে। তবে, রপ্তানি আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত।

আরও পড়ুন : সঞ্চয়পত্র : মুনাফা হ্রাস, সংকট ও বাস্তবতা 

গত অর্থবছরে এই খাতের রপ্তানি আয় ছিল ৪,২৬০ কোটি টাকা যা মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ। এই খাতে চলতি অর্থবছরে রপ্তানি আয় আরও বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হলেও একই সাথে অন্যান্য খাতগুলোতে রপ্তানি আয় বাড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে।

বৈদেশিক মুদ্রার মজুর কমে যাওয়ার আর একটা প্রধান কারণ হচ্ছে অর্থ পাচার। বাসেল (BASEL) এন্টি মানি লন্ডারিং সূচক ২০২১ অনুযায়ী অর্থ পাচার ঝুঁকিতে আছে এরকম ১১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩তম।

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রেটি (জিএফআই)-এর মার্চ ২০২১ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ভুয়া চালান ও অন্যান্য উপায়ে বাংলাদেশ থেকে প্রায় প্রতি বছরে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়, যা খুবই উদ্বেগের বিষয়। তাই, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে আমাদের গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিতে হবে।

তাছাড়া, প্রবাসী আয় প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণেও বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ আশাতীত হচ্ছে না। প্রধান শ্রমবাজারগুলোতে করোনার প্রভাব কাটিয়ে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার দেরিতে হওয়ায় চলতি অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। যদিও চলতি হিসাবের ঘাটতি পূরণে প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

মানি লন্ডারিং সূচক ২০২১ অনুযায়ী অর্থ পাচার ঝুঁকিতে আছে এরকম ১১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩তম।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দেয় ১ হাজার ৭২৩ কোটি ডলার। এটা অর্থনীতির জন্য আরেকটি চিন্তার বিষয়।

আমাদের অর্থনীতির আরেকটি নীরব ঘাতক হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী মে, ২০২২-এ মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। চলমান করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভবিষ্যতে মুদ্রাস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আরও পড়ুন : জুয়া এখন অনলাইনে

মূল্যস্ফীতি বাড়লে দরিদ্র মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খাদ্যপণ্য কিনতেই তাদের আয়ের সিংহভাগ খরচ হয়। বর্তমান চাল-ডাল, তেল, লবণসহ নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুরই দাম বাড়ছে। তাই মূল্যস্ফীতি বাড়লে যে সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে তা কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। একারণে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা আর্থিক নীতি নির্ধারকদের জন্য প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। কঠোর আর্থিক নীতি অনিবার্যভাবেই গ্রহণ করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবকাঠামো উন্নয়নে আমাদের ২০টি মেগা প্রকল্পের জন্য ব্যয় হবে ৭০.০৭ বিলিয়ন বা ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। যার ৬১ শতাংশই আসে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান থেকে।

এসব মেগা প্রকল্পের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসবে ২০২৪ ও ২০২৬ সালে। তাছাড়া, সরকারি ঋণের ৫০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ। সেটা পরিশোধ না করলে ব্যাংকগুলো তারল্য পাবে না। তাই, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সরকারি ঋণ পরিশোধের বিরাট ধাক্কা সামলাতে আমাদের কর আহরণ বাড়াতে হবে।

অন্যদিকে, যেসব প্রকল্প শুরু হয়নি, অতি জরুরি না হলে তা স্থগিত করে দিতে হবে। পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে তা আবার পুনরায় শুরু করা যেতে পারে।

সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায়, ভবিষ্যৎ আর্থিক অস্থিরতা অনুমান করেই হয়তো আমাদের সরকার ইতিমধ্যে আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি, এডিবি থেকে ১০০ কোটি, বিশ্বব্যাংক থেকে ৭০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা পেতে ঋণ আবেদন করেছে।

একই সাথে, জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকার কাছ থেকেও সহায়তা নেওয়ার আলোচনা চালাচ্ছে যা আমাদের ভবিষ্যৎ আর্থিক বড় ঝুঁকি এড়ানোর একটি ভালো আগাম সাবধানতা হতে পারে। কেননা, সর্বস্তরে কৃচ্ছ্রতা ও আগাম সাবধানতা অবলম্বন ছাড়া ভবিষ্যৎ আর্থিক অস্থিরতা সামাল দেওয়ার জন্য ভালো কোনো বিকল্প পন্থা আপাতত নেই।

নীলাঞ্জন কুমার সাহা ।। ডিন, ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজ ও সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়