ছবি : সংগৃহীত

ইদানীং সামাজিক অপরাধের কারণে আমরা যখন সংখ্যালঘু বলছি, তখন তা স্বভাবতই হিন্দু ধর্মের নিপীড়িত মানুষদের কথা নিয়ে আসে। শব্দের ব্যবহার কোনো বিষয়ের গুরুত্ব বা গভীরতার নির্ণায়ক হতে পারে? ‘সংখ্যালঘু’ বা ‘মাইনরিটি’ ন্যারেটিভ-এর পরিবর্তে ‘ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষ’ বললে ব্যাপারটার গুরুত্বকে লঘু করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অপবাদ জুটবে।

মাইনরিটি শব্দটায় একটা ভিকটিম ফ্লেভার থাকে এই ধারণাটা একটা মিডিয়া প্রসূত মেজরিটি বিলিফ। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা অন্য ধর্মের মানুষ বলা তাদের নির্যাতিত হওয়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে এড়ানো হয় বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ সংখ্যালঘু’ শব্দটার মাঝে নির্যাতন বিষয়টা নিহিত বলে ধরা হয়।

ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়, চীনের উঁইঘুর মুসলিম সম্প্রদায় বা আমাদের দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে সংখ্যালঘু ট্যাগ এজন্য দেওয়া হয় কারণ এই গোষ্ঠীত্রয়কে রাজনৈতিক, ধর্মীয় গোঁড়ামি, প্রতিহিংসা পরায়ণতা, সামাজিক বিশৃঙ্খলাসহ নানা কারণে ঐ সংখ্যাগুরুর দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নির্যাতনের শিকার হতে হয় হরহামেশাই।

আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন 

প্রকৃতপক্ষে সংখ্যালঘু শব্দটা দিয়ে যেন তাদের আরও পর করে দেওয়া হচ্ছে, তারা দেশের নাগরিক হয়েও যেন আলাদা কেউ—এটা বোঝানো হয়। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো এই যে, সংখ্যালঘু বিতারণ বা নির্যাতন এতই প্রকট হচ্ছে যে, শব্দটাই এই জনগোষ্ঠীদের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরার প্রতীক হয়ে উঠছে।

ধর্মের উপর আঘাত হানা হয়েছে তা মনে করে সেই বোধ থেকে নানান অপরাধের উৎপত্তি ঘটে, আবার ধর্মকে রাষ্ট্র তৈরির হাতিয়ার করে নিয়েও যুগে যুগে অনেক গোষ্ঠীর উপর নির্মমতার চিহ্ন রাখা হয়েছে।

সব ধর্মই পরার্থপরতা ও পরোপকারিতার দীক্ষা দেয় আমাদের। কিন্তু ধর্মকে নিয়েই আমাদের সবচেয়ে বেশি হঠকারিতা, সংকীর্ণতা ও অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পায়। ধর্মকে ব্যবহার করে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি সমাজকে ক্ষতি করে আর ধর্মকেই কলুষিত করে।

আমাদের মন মননে ‘ধর্ম’ অনেকটা ডি-অক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডের (ডিএনএ) মতো অবিচ্ছেদ্য গাঁথুনি নিয়ে এঁটে আছে। একটি স্বাধীন, ‘স্ব’ তন্ত্র দেশ হিসেবে আমাদের জন্ম যতটা না ভাষা ভিত্তিক তারচেয়েও বেশি এর শেকড় ধর্ম নিয়ামক-এ প্রোথিত, ধর্মের শক্তি অগ্রাহ্যের লেশমাত্র সুযোগ নেই বটে।

ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বড় দৃষ্টান্ত হলো ১৯৪৭ সালের পর অখণ্ড ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়ার ইতিহাস। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় ব্রিটিশদের ভারতীয় উপমহাদেশে শাসনকাল দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার মোক্ষম হাতিয়ার ছিল জনগণের মাঝে ধর্মভিত্তিক ‘সাইকোলজিক্যাল সিগ্রেগেশন’ বা মানসিক বিভক্তি তৈরি করা।

আরও পড়ুন : সম্প্রীতি ফিরে আসার প্রত্যাশায়

ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ (বিভক্ত করো, শাসন করো) পলিসির অন্যতম কৌশল ছিল হিন্দু মুসলিম এই দুটো ধর্মানুসারীদের পরস্পর বিরুদ্ধবাদে জড়ানো যাতে করে নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বে লিপ্ত থেকে তারা তাদের রাজনৈতিক চেতনা, স্বাধীনতা, স্বাধিকার, স্বদেশ নিয়ে ধারণার চর্চা না করে।

এই নীতি এতটাই কার্যকর হয় যে, ’৪৭ পরবর্তী রাজনীতিতে আসা দুটি দেশ থেকে ’৭১-এ আর একটি দেশের উদ্ভব ঘটে। এক্ষেত্রে যদিও ধর্মই একমাত্র কারণ নয় তবে ধর্ম ছিল মূল ভিত্তি যা নিজেদের আলাদা সত্ত্বা ভাবার বীজ বপন করে দেয়।

পরবর্তীতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা, সম্মান স্বীকৃতি সহ নানামুখী শোষণ চলেছে যা এই বিভক্তি ত্বরান্বিত করেছে। এই শোষণ এর উৎপত্তিও সেই ধর্মই।

পশ্চিম পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের যে স্বপ্ন ছিল তা গড়ে ওঠে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কারণে। সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হয় ১৯৭১ এর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের শুভ উদয়ের দ্বারা।

আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সত্যিই বেদনাদায়ক 

তাই ধর্ম দিয়ে একটি জাতি গঠনের সূত্রপাত সম্ভব হয় কারণ ধর্ম আমাদের চিন্তা চেতনার সিংহ ভাগ জুড়ে রয়েছে। তবে এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বেদি ছিল স্বাধিকার আন্দোলন যা এখনকার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির চেয়ে একেবারে ভিন্ন।

এই যে ধর্মের বীজ বুনে দেওয়া এটিকে জাতিগত দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে তা কিছুটা বিতর্কিতই ঠেকে। ১৯৭১ এর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের নির্মমতার ইতিহাস থেকে জানা যায় পাকিস্তানের নির্লজ্জ আগ্রাসনের বড় হাতিয়ার ছিল হিন্দু নির্যাতন, পাকবাহিনী দ্বারা বহু হিন্দু ও মুসলিম নারীদের ধর্ষণ ও নিকৃষ্ট সব উপায়ে নির্যাতন করা হয় সে সময়টায়।

হিন্দুদের ‘কাফের’ উল্লেখ করে তাদের নির্বিচারে হত্যা করার পেছনে ‘হিন্দু নিধন’ নয় বরং তা ছিল ‘পরিকল্পিত জাতি নিধন’ যা আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যা নামক আন্তর্জাতিক অপরাধের একটি উপাদান।

সেইসাথে মুসলিম জনগোষ্ঠী যারা পাকিস্তানের শাসনকে অস্বীকার করেছিল তাদের উপর চলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। এখানে নির্যাতনের ভিত্তি হিসেবে বিধর্মী নিধন বা মুসলমানদের রাজত্ব স্থায়ী করা নয় যদিও এটি তাদের এজেন্ডায় ছিল, মূল কারণ ছিল জাতি হিসেবে সুপরিকল্পিত রূপে একটি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করা।

আরও পড়ুন : সম্প্রীতি কোথায়?

সুতরাং, অনেকটা জাতিগত বৈষম্য, কিছুটা ধর্মযুদ্ধ ও পূর্ণ স্বৈরাচারী মনোভাবের সংমিশ্রণে পাকিস্তান বাংলাদেশকে নির্মূল করতে চেয়েছিল। পুরো ব্যাপারটায় ধর্মের প্রভাব থাকলেও ‘অপরাধ প্রবণ মানসিকতা বা ইচ্ছে’ মুখ্য।

সাংবিধানিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের একটি স্পষ্ট ও বিশদ চিত্র দেখতে পাই। বাংলাদেশ সংবিধানের ২(ক) অনুচ্ছেদটি ১৯৮৮ সালের আগ পর্যন্ত ছিল না, অর্থাৎ ধর্মকে সংবিধানে আনার প্রয়োজনীয়তা ১৯৭২ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণপরিষদের সদস্যগণ ও রাজনৈতিক নেতারা বোধ করেননি।

১৯৮৮ সালে তৎকালীন সামরিক শাসক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সংবিধান (অষ্টম সংশোধনী) আইন, ১৯৮৮ প্রণয়ন করে প্রথম এই অনুচ্ছেদ সংবিধানে সংযোজন করেন।

যে সময়টায় এরশাদ টের পেলেন তার বিরুদ্ধে জনরোষ তুঙ্গে আর বিরোধী রাজনৈতিক দল তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে সক্রিয়, ঠিক ঐ সময়টাকেই তিনি বেছে নেন এই বিধানটি সংবিধানে যুক্ত করবার জন্যে। অর্থাৎ, ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজের মৃতপ্রায় জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে ধর্মভিত্তিক চেতনাকে পুঁজি করে ক্ষমতায় তিনি টিকে থাকতে চেয়েছিলেন।

তবে তিনি সকল ধর্মের মানুষের সহানুভূতি আকৃষ্ট করতে তথা বিতর্ক এড়াতে উক্ত বিধানে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ইসলামকে ঘোষণার পাশাপাশি ‘তবে অন্যান্য ধর্মও শান্তিতে পালন করা যাইবে’ এই অংশ ২ (ক) অনুচ্ছেদে জুড়ে দেন।

আরও পড়ুন : তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?

১৯৮৮ সালে এই সংযুক্তির বৈধতাকে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হলে তা খারিজ হয়। ২০১১ সালে ২ (ক) অনুচ্ছেদে আনা সংশোধনী পুনরায় বিতর্কের জন্ম দেয় কেননা বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্ম বলতে কিছু ছিল না।

২৮ বছর আগের দায়ের করা এই রিট পুনরায় একটি সাপ্লিমেন্টারি পিটিশন দিয়ে পুনর্বিবেচনার জন্য ২০১৫ সালে দাখিল করে কমিটি ফর রেসিস্ট্যান্স এগেইনস্ট অটোক্রেসি অ্যান্ড কমিউনালিজম নামক সংগঠনসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। কিন্তু সেটিও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গ্রহণ করেননি।

তৎকালীন সময়ে বিজ্ঞ বিচারপতি রেজাউল হক-এর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্য বিশিষ্ট বেঞ্চ পিটিশনারদের ‘লোকাস স্ট্যান্ডই’ (আইনত হস্তক্ষেপের অধিকার বা আদালতে কোনো বিষয়ে আবেদন করার অধিকার) নেই এই আইনি যুক্তিতে ২ (ক) অনুচ্ছেদকেই বহাল রেখে রায় দেন।

পিটিশনারদের যুক্তি ছিল যে, ২(ক) অনুচ্ছেদ ১৯৭২ সালের সংবিধানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কারণ ওতে রাষ্ট্র ধর্ম ছিল না তাই এহেন সাংবিধানিক সংশোধনী অযৌক্তিক।

তারা আরও আলোকপাত করেন যে, ২ (ক) অনুচ্ছেদ সংবিধানের ১২ নং অনুচ্ছেদ—ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা একটি সাংবিধানিক মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক আর মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক আইন বাতিল করার বিধান দেওয়া আছে ৭ (ক) অনুচ্ছেদে।

আরও পড়ুন : রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!

যেহেতু বাংলাদেশ সংবিধানে ৭ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধানের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক আইন বাতিল বলে গণ্য হবে ও সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম আনার অর্থ সাংবিধানিক মূলনীতি অস্বীকার করা, তাই অষ্টম সংশোধনী আইন বাতিল করা হোক।

পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্ট অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী এবং অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ, এএলআর (এইচসিডি) ২০১৬(২) ১৬, যা ষোড়শ সংশোধনী মামলা হিসেবে সুপরিচিত, মামলার রায়ের ১৩১ নং অনুচ্ছেদে অসন্তোষ প্রকাশ করে ধর্মনিরপেক্ষতা অপসারণের বিষয় আলোকপাত করে নিম্নের আইনি পর্যবেক্ষণ দেন—

“ধর্মীয় অনুভূতির সাথে মোকাবিলা করার জন্য, একটি উপাদান (ধর্মীয় আমন্ত্রণ), যা সরাসরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে যায় এবং যা ১৯৭৯ সালে সামরিক আইন শাসন দ্বারা সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছিল... এর ফলে, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি যেমন ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রতিশ্রুত হয়েছিল, তা সম্পূর্ণরূপে আপস করা হয়েছিল এবং এইভাবে মূল সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কবর দেওয়া হয়েছিল।”

বাংলাদেশে রাষ্ট্র ধর্ম ধারণার প্রবর্তক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ কেবলমাত্র রাজনৈতিক গদি বাঁচানোর তাগিদে যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেই থেকে ‘ধর্ম’ দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে মূল দুই রাজনৈতিক দলের এজেন্ডায় অন্যতম স্থান পেয়ে এসেছে।

আরও পড়ুন : সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস কীভাবে ছড়ায়? 

পরবর্তীতে ২০১১ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আমলে সংসদ সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধনী) আইন, ২০১১ পাস করে যার দ্বারা উক্ত ২ (ক) অনুচ্ছেদে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ‘সমমর্যাদা ও সমঅধিকার’ নিশ্চিত করার অংশ সংযুক্ত করা হয়, যা দেশের ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর ধর্ম পালনের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করে এবং একইসাথে এই সমতাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে তাদের নাগরিক হিসেবে সাংবিধানিক সুরক্ষা পাওয়ার পথ প্রশস্ত করে।

এই সাংবিধানিক ইতিহাসের অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় তা হলো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণের বিষয় বাংলাদেশের জন্য অনভিপ্রেত। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তাহীনতা কেন অবহেলিত তার একটি কারণ হিসেবে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দায়ী করা গেলেও এক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ বাস্তবায়ন কতখানি দৃশ্যমান তাও দ্রষ্টব্য।

দেশের সর্বোচ্চ আইনে সকল ধর্মের মানুষকে তাদের ধর্মকর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে যা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতির মানদণ্ডকে নির্দেশ করে এবং এই মর্মে সরকার তথা রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতাকেই ইঙ্গিতবহ করে। 

আরও পড়ুন : আর কত মাটির কান্না?

ধর্মীয় উপদেশ বা এর নীতি নৈতিকতাগুলোর সঠিক জ্ঞান, পালন ও চর্চা সমাজে সকল ধর্মের জন্যে সহাবস্থান তৈরি করে অপরাধ করা থেকে মানুষকে নিবৃত্ত রাখে যা বৃহত্তর পর্যায়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যে মঙ্গলজনক।

ঠিক তেমনি স্বদেশ কল্যাণ নিয়ে চর্চা করাকে ধর্মের মতো একটি পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করলে স্বধর্ম ও স্বদেশ উভয়েই উপকৃত হয়। দেশপ্রেম পবিত্রতার অঙ্গ। এখানে মানুষের মানসিকতা, ধর্ম ও রাষ্ট্র উভয়ের মাঝে ব্যালেন্স করে সমাজকে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-জাতি নির্বিশেষে সবার জন্যে বসবাসযোগ্য করে তুলতে হলে অপরাধ দমনই মুখ্য। 

আমরা ধর্মপ্রাণ জাতি হিসেবে খ্যাত, ধর্মের প্রাণ ধর্ম পালনকারীদের মাঝেই জিইয়ে থাকে তবে ধর্মের কারণে প্রাণ কেড়ে নেওয়া জিঘাংসা মূলক বা এতে পরার্থপরতা বা সহনশীলতা থাকে না—এই ব্যাপারে ধর্মের অনুসারীদের মাঝে ঐকমত্য একেবারে নেই বললে চলে।

ধর্মের প্রতি আসক্ত না হয়ে ধর্মীয় বিষয়ে অজ্ঞতার বা ভুল ধারণার প্রতি আসক্তি প্রাণহানি ঘটানোর ক্ষমতাও রাখে তা আমরা নিত্য দেখতে পাই বহির্বিশ্বে।

ধর্ম ভিত্তিক জাতি গঠন এর সুফল হিসেবে সমমনা গোষ্ঠী এক সাথে বসবাসকে ধরে নিলেও এতে তাদের মাঝে অপরাধ প্রবণতা থাকবে না বা সমাজ ‘ক্রাইম ফ্রি’ থাকবে এই ভাবনা অরণ্যে রোদন বৈ কিছু নয়।

আরও পড়ুন : ধর্ম যার যার থাকুক, উৎসব হোক সবার  

স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার আগে এদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি ও বন্ধন অনেক সুদৃঢ় ছিল কেননা তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যেকটি মানুষের ধ্যান-জ্ঞানে একটিই আকাঙ্ক্ষা, একটিই স্পৃহা, পুরো জাতি জুড়ে একমাত্র স্বপ্ন- স্বাধীনতা। তখনকার মানুষের কাছে কারো পরাধীন হয়ে বাঁচবার চেয়ে মৃত্যুকে বেছে নেওয়া শ্রেয়তর ছিল।

১৯৫২-১৯৭১ এর সময়টায় ভিন্ন ধর্মের মাঝে পারস্পরিক সম্মান-সহমর্মিতা-সহনশীলতা না থাকলে, আত্মচিন্তায় নিমগ্ন থাকলে, স্বার্থপরতা নিয়ে বাঁচলে, জাত ধর্ম বাঁচানোর চিন্তায় অস্থির রইলে—এই জাতি কি কখনো স্বাধীন বাংলা ভূমি অর্জন করতো?

যদি না হয়, তবে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন কেন আজকের বাংলাদেশের সমাজগুলোয় আমরা আশা করতে পারি না? কেন সবকিছুতে ধর্মীয় পরিচয় বড় হয়ে দাঁড়ায়? কেন সবকিছুকে ধর্মীয় প্রলেপ দিয়ে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চালাই আমরা? সচেতন পাঠক সমাজের কাছে প্রশ্ন রাখা হলো।

’৭১ এর সেই সামাজিক সম্প্রীতির স্থানে ফিরে যেতে হলে আমাদের এখনই ভাবতে হবে আমরা এই দেশকে কেমন দেশ হিসেবে দেখতে চাই। যদি নিজেদের অস্তিত্বে বিশ্বাসী হই, স্বাধীন দেশ হয়ে জন্ম নেওয়ার ইতিহাস দেখি, পূর্বপুরুষদের উপর হওয়া নির্যাতন নিপীড়নের ইতিহাস জানি এবং দেশের সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই তবে ধর্মীয় ও পরমত সহিষ্ণুতার বিকল্প নেই।

ধর্মীয় সম্প্রীতি, ধর্মীয় সহাবস্থান, ধর্মীয় সমাজে যতটা না পরিলক্ষিত তারচেয়ে বেশি তা সেকুলার সমাজে প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ধর্মীয় সহিংসতা রোধে ও সুশৃঙ্খল শান্তিপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের যে স্বপ্ন এই জাতির স্রষ্টা, বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রয়াসই পারে সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দান করতে।

ইভনাত ভূঁইয়া ।। রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, রেডলিফ পাব্লিশিং