ছবি : সংগৃহীত

মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে স্কাইওয়ানের আকাশ জুড়ে বিশ্বের অগণিত মানুষের চোখ সেদিন আটকে ছিল চরম গভীরতায়। ২ আগস্টের রাত বিমূর্ত হয়ে ধরা দেয় যখন তাইওয়ানের আকাশসীমায় প্রবেশ করে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি ন্যান্সিকে বহনকারী ফ্লাইট এম এপিআর-১৯।

এই সময়ে তাকে ফলো করছে তাইওয়ান এয়ারফোর্সের বেশকিছু যুদ্ধবিমান এবং যুক্তরাষ্ট্রের ৮টি ফাইটার ও ট্যাংকার। পাশাপাশি তাইওয়ান স্টেটের আশপাশে অবস্থান করছে যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ইউএসএস রোনাল্ড রিগ্যান।

ঠিক তখন ফ্লাইট পর্যবেক্ষণ করছিল প্রায় ৮ লাখেরও অধিক মানুষ। এভাবেই সারা বিশ্বের নজর কেড়ে বেইজিংয়ের প্রবল আপত্তির মুখে তাইওয়ানে প্রবেশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। এরপরই বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারকারী দুই পরাশক্তি মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়। চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে পৃথিবীতে দগদগে ক্ষত যখন গভীর পর্যায়ে রয়েছে ঠিক তখন চীন-তাইওয়ান ইস্যুতে মার্কিন তৎপরতায় প্রশ্ন উঠেছে তাহলে কি আরেক যুদ্ধ আসছে?

চীনা মন্ত্রিসভার দফতর ৩ আগস্ট এক বিবৃতিতে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তাইওয়ান দখলের হুমকি দিয়েছে। তাইওয়ানকে ঘিরে অনির্দিষ্টকালের জন্য সামরিক মহড়ার মাঝে চীন এমন ইঙ্গিত দিলো। 

আরও পড়ুন : চীন যেভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হলো

পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ সফর করতে ১ আগস্ট ওয়াশিংটন ত্যাগ করেন ন্যান্সি পেলোসি। এই সফরে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান সফরের কথা। তবে তিনি ওয়াশিংটন ছাড়ার আগেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে চাউর হয়ে যায় চলতি এই সফরে তাইওয়ানেও যাবেন। যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ান সরকারের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এই বিষয়ে নিশ্চিত করেন।

ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ানে আসতে পারেন এই খবর প্রচারিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্কবার্তা দেয় চীনের সরকার। দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান ১ আগস্ট বেইজিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যদি ন্যান্সি পেলোসি সত্যিই তাইওয়ান সফরে আসেন, তাহলে তার পরিণতি খুবই গুরুতর হবে। চীনের সেনাবাহিনী এক্ষেত্রে 'চুপচাপ অলসভাবে বসে থাকবে না' বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

তারপর ২ আগস্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রণালয়ের অপর মুখপাত্র হুয়া চুনইয়িং বলেন, ন্যান্সির এই সফর কোনোভাবেই ব্যক্তিগত নয় এবং যদি যুক্তরাষ্ট্র একে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়, সেক্ষেত্রে চীন ‘বৈধভাবেই প্রয়োজনীয় পাল্টা পদক্ষেপ নেবে।’ কিন্তু চীনের দফায় দফায় হুঁশিয়ারির মধ্যেই তাইওয়ানে পৌঁছান ন্যান্সি পেলোসি।

এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন পেলোসি। বৈঠকে চীনের কবল থেকে তাইওয়ানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে সার্বিক সহায়তা দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন : ইউক্রেনের যুদ্ধ : কেন হচ্ছে, কী হতে চলেছে?

১৯৪০ সালের গৃহযুদ্ধে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হয় তাইওয়ান। তারপর থেকে তাইওয়ানের স্বাধীনতাপন্থী রাজনীতি নিজেদের স্বাধীন ও সার্বভৌম বলে দাবি করলেও চীন এই দ্বীপ ভূখণ্ডকে এখনো নিজেদের অংশ বলে দাবি করে। ৩৬ হাজার ১৯৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপের রয়েছে নিজস্ব সংবিধান, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতৃত্ব এবং প্রায় ৩ লাখ সক্রিয় সদদ্যের সেনাবাহিনী।

এখন পর্যন্ত অবশ্য খুবই অল্প কয়েকটি দেশ তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও তাইওয়ানে এখন পর্যন্ত নিজেদের কোনো দূতাবাস খোলেনি দেশটি। তবে তাইওয়ানে একটি আইনের আওতায় স্বাধীনতাকামী দ্বীপ ভূখণ্ডকে গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকেই সামরিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।

বর্তমান অঞ্চলে উত্তেজনার পারদ চরমে উঠেছে। তাইওয়ানের পূর্বাঞ্চলের জলসীমায় একটি যুদ্ধ বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে চীন। আকাশে চক্কর দিয়েছে চীনা যুদ্ধবিমান। ২৫ বছরের মধ্যে তাইওয়ান সফর করা সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ মার্কিন রাজনীতিবিদ পেলোসি। তবে তার এই সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সমর্থন দেননি।

রাশিয়া ও চীন যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে বলেছে, পেলোসির সফর উসকানিমূলক এবং তা এই অঞ্চলের জন্য অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করবে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের তীব্র নিন্দা করেছে এবং একে চীন নীতির গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তারা বলেছে, এই সফর চীন-মার্কিন সম্পর্কের রাজনৈতিক ভিত্তির উপর গুরুতর প্রভাব ফেলবে।

আরও পড়ুন : ইউক্রেনের যুদ্ধ ও সঙ্গীহীন পুতিন 

হাইভোল্টেজ এই বৈঠকে তাইওয়ানের প্রতি অটল সমর্থন ও মনোযোগ দিয়ে যাওয়ার কারণে পেলোসিকে গভীরভাবে ধন্যবাদ জানান প্রেসিডেন্ট সাই। এই সময় ন্যান্সি পেলোসি বলেন, 'আমরা তাইওয়ানে এসেছি এটি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিতে যে, আমরা তাইওয়ানের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার থেকে সরে আসব না এবং আমাদের স্থায়ী বন্ধুত্ব নিয়ে আমরা গর্বিত। তাইওয়ানের সঙ্গে আমেরিকার সংহতি এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর আজ আমরা এখানে এই বার্তাই নিয়ে এসেছি।’ এমন খবর ফাঁস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেইজিং হুঁশিয়ার করে বলেছিল, ওয়াশিংটন ‘আগুন নিয়ে খেলছে’।

এরপরই দ্রুত চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করে। ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পর দ্বীপকে শায়েস্তা করতে উঠে পড়ে লেগে যায় চীন। তাইওয়ান থেকে আমদানিতে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। নিজেদের মোট রপ্তানির ৩০ ভাগই চীনে পাঠায় তাইওয়ান। তাই চীনের যেকোনো নিষেধাজ্ঞাই বড় প্রভাব ফেলবে দেশের ওপর। 

এককথায় ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ানে সফর করার পর স্বশাসিত দেশকে ঘিরে সামরিক মহড়া চালাচ্ছে চীন। এরই অংশ হিসেবে তাইওয়ানের জলসীমার ভেতর মিসাইল ছুঁড়েছে তারা।

এছাড়া চীনের 'কৌশলগত' মহড়ার মধ্যেই তাইওয়ানের দক্ষিণ-পূর্বে সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে মার্কিন বাহিনীর রণতরী ইউএসএস রোনাল্ড রিগ্যান। ৪ আগস্ট বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর মুখপাত্র। রণতরীর উপস্থিতিতে অঞ্চলটিতে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আনোয়ার বারী পিন্টু ।। গণমাধ্যমকর্মী