ছবি : সংগৃহীত

জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। তারপর থেকে সরকারের মন্ত্রী এবং সরকারি দলের নেতারা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পক্ষে এমন সব অকাট্য যুক্তি তুলে ধরছেন, এই কয়দিনে আমি প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছি, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ছাড়া সরকারের আর কিছু করার ছিল না। আসলেই কি তাই?

দাম বাড়ানোর মূলত তিনটি যুক্তি তুলে ধরছে সরকার—আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের বাড়তি দাম, বিপিসির লোকসান, ভারতের পাচার রোধ। যদিও অনেকে বলছেন, শুল্ক কমিয়ে জ্বালানি তেলের দাম না বাড়িয়েও বিপিসির লোকসান কমানো যেত।

আবার কেউ কেউ বলছেন, ৮ মাসে বিপিসির ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসানের হিসাব যেমন সত্য, আবার আগের ৭ বছরে ৪৩ হাজার কোটি টাকা লাভের হিসাবও মিথ্যা নয়।

আরও পড়ুন : জ্বলছে জ্বালানি তেল 

সরকার চাইলে আগের লাভ থেকে কিছু ভর্তুকি দিয়ে হলেও দাম কিছুটা কম বাড়াতে পারতো। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনীতির ওপর যে প্রবল চাপ তৈরি হয়েছে, তা থেকে বাঁচতে সরকার কোনো বিকল্প পথে না হেঁটে সরাসরি ভর্তুকি শূন্য করার দিকে গেছে।

জ্বালানি তেল এমন এক কৌশলগত পণ্য, যার দাম বাড়লে প্রায় সবকিছুর দাম বেড়ে যায়। দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনযাত্রায় এর প্রভাব পড়ে। যেমন জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে রিকশা ভাড়াও বাড়ে, কারণ রিকশাওয়ালাকেও বাজার থেকে পণ্য কিনতে হয়। আর এটা তো সবাই জানেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে পরিবহন ব্যয় বাড়ে, তাই সব পণ্যের দামই বাড়ে। 

দাম বাড়ানোর মূলত তিনটি যুক্তি তুলে ধরছে সরকার—আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের বাড়তি দাম, বিপিসির লোকসান, ভারতের পাচার রোধ। যদিও অনেকে বলছেন, শুল্ক কমিয়ে জ্বালানি তেলের দাম না বাড়িয়েও বিপিসির লোকসান কমানো যেত।

তাই হয়েছে, বাজারে সব পণ্যেরই দাম বেড়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। বরং করোনার সময় থেকে অনেকের আয় কমেছে, অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের ব্যবসায় ধস নেমেছে। সাধারণ মানুষ যখন করোনার ধাক্কা সামলানোর লড়াই করছিল, তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব মানুষকে বিপাকে ফেলে দেয়।

আরও পড়ুন : আইএমএফের ঋণ : জ্বলছে কি জ্বালানি বাজার? 

নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে আগেই। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর বাজারে আরেক দফা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। মানুষের আয় না বাড়লেও ব্যয় বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, মানুষ তাহলে কীভাবে টিকে থাকছে। উত্তর খুব সহজ—মানুষ আসলে মানিয়ে নিচ্ছে। সাধারণ মানুষ বিলাসিতা বাদ দিয়েছে অনেক আগেই।

বেড়ানো-খেলানো মানুষ ভুলে গেছে। কোপ পড়েছে চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যয়ে। কোপ পড়েছে পুষ্টিতে। এখন মানুষ যতটুকু না হলেই নয়, ততটুকু খেয়ে বেঁচে থাকছে। মাছ, মাংস, দুধ, ডিমে টান পড়েছে। কিন্তু পিঠ ঠেকানোর মতো দেয়ালও ধসে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন : অনিপরাদ সড়কে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন

বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে সরকারকে শেষ বছরে এসে জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধির মতো অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। সবই মানলাম। কিন্তু এই দুঃসময়ে সরকারি দলের নেতারা, মন্ত্রীরা একটু সংবেদনশীলতা নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন।

অনেক সময় পিঠে হাত বুলিয়ে কড়া কথা বললেও মানুষ একধরনের সান্ত্বনা পায়। কিন্তু অনেকদিন ক্ষমতায় থাকলে মনে হয় মানুষের সংবেদনশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। হয়তো সাধারণ মানুষের বেদনা তাদের আর স্পর্শ করে না।              

কদিন আগে এক অনুষ্ঠানে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান ব্যয় সাশ্রয়ে গমের আটার রুটির বদলে চালের রুটি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘গমের আটার রুটি খাব না। তাহলে গম ইমপোর্ট করতে হবে না। আমার ফরেন কারেন্সি যেটা আছে, সেটাতে শর্ট পড়বে না। আমার ডলার শর্ট পড়বে না। কিন্তু আমরা সবাই যেন গমের আটার রুটি খাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গেছি। আমরা তিন মাস গমের রুটি না খাই। দেখি না কী হয়। আমরা চালের আটার রুটি খাব। অসুবিধা কোথায়?’ কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী গমের বদলে চালের আটার রুটি খেতে হলেও তো চাল কেনার টাকা থাকতে হবে। যার কাছে গম কেনার টাকা নেই, তার কাছে চাল কেনার টাকাও থাকবে না।

আরও পড়ুন : সন্নিকটে সংকট, শঙ্কিত কি অর্থনীতি! 

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘গ্রাম-গঞ্জের কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। প্রত্যেক মানুষ খেতে পারছে। প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামাকাপড় আছে।’

আমি বুঝতে পারছি না, গায়ে জামাকাপড় থাকা কবে থেকে উন্নয়নের সূচক হলো। কিছুদিন আগেও সরকারের মন্ত্রীরা বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুরের সাথে তুলনা করেছেন। আড়াই হাজার ডলার মাথাপিছু আয়ের উন্নয়নশীল দেশের মানুষের গায়ে জামাকাপড় আছে কি না, সেটা দেখতে হবে কেন? 

বাজারে সব পণ্যেরই দাম বেড়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। বরং করোনার সময় থেকে অনেকের আয় কমেছে, অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের ব্যবসায় ধস নেমেছে....

একই সুর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের কণ্ঠেও। সুনামগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘কিছু মানুষ আছে, আমাদের পছন্দ করে না, দেশের বিরুদ্ধে কথা বলে, তারা বলছে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, মানুষ মরে যাবে। দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ার বিষয়টি অস্বীকার করব না। কিন্তু এখনো কেউ জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মারা যায়নি, আশা করি মরবেও না। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মানুষ না খেয়ে মারা যায়নি, যাবেও না।’

আরও পড়ুন : পরিবহন নৈরাজ্য! 

সরকারের একজন মন্ত্রীর মুখে মানুষ না খেয়ে মারা না যাওয়ার কথা বেমানান লাগে। এম এ মান্নান খুবই সজ্জন ব্যক্তি। তিনি ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ান নন, ক্যারিয়ার আমলা। কিন্তু তার মতো একজন সিনিয়র মন্ত্রীর মুখে এই কথা আমাদের বেদনার্ত করে।

আমার কেন জানি মনে হয়, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায়, সরকারের মন্ত্রীরা জনগণের সেই বেদনা আর ধরতে পারছে না।

আর গত দুটি নির্বাচনে জিততে তাদের অত কষ্ট করতে হয়নি, জনগণের কাছেও যেতে হয়নি। তাই তারা হয়তো জনগণকে থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের কথা মনে পড়ছে। গল্পের সেই কাদম্বিনীর মতো সাধারণ মানুষকেও কি মরেই প্রমাণ করতে হবে, তারা এতদিন বেঁচে ছিলেন?

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
probhash2000@gmail.com