ছবি : সংগৃহীত

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহত্তর ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়াতে ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার জন্মদিন। জন্মদিনে তাকে জানাই শুভেচ্ছা!

প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে, আমরা সকলেই তাকে আজ জন্মদিনের শ্রদ্ধা এবং শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। কিন্তু তার জীবনে আচরিত কিছু মহৎ শিক্ষা এবং মানবিক মূল্যবোধ আমরা চাইলে আমাদের জীবনে প্রতিফলিত করতে পারি। তবে আমাদের সমাজ এবং মানবিক বোধ আরও জাগরিত হতো।

একজন ব্যক্তির প্রকৃতি কেমন, তা টের পাওয়া যায়;  তিনি তার অনুগত মানুষের সাথে কেমন আচরণ করেন তার ওপর। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা চলে গেছে, সামন্তবাদী জমিদারদের রাজত্বের অবসান হয়ে গেছে; কিন্তু তাদের নাক উঁচা ভাব আমাদের অধিকাংশর মধ্যে আজও রয়ে গেছে।

আরও পড়ুন : কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গমাতা

মুখে আমরা বড় বড় বক্তব্য দিলেও, মানবিক বোধগুলো দিনে দিনে আমাদের থেকে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাচ্ছে বা হারিয়ে যাচ্ছে। এখনো দেখতে পাই, একজন সরকারি চাকরিজীবী প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তারা চাকরিক্ষেত্রে বাবার বয়সী বৃদ্ধ মানুষদেরও নাম ধরে ডাকেন। এটাই নাকি চাকরির নিয়ম, ভাবা যায়! কারণ তারা তৃতীয় শ্রেণি, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।

বিষয়টি অত্যন্ত অমানবিক এবং দৃষ্টিকটু। বিষয়গুলো প্রতিনিয়ত ভাবায় আমাকে। তা নিয়ে কাউকেই খুব একটা মুখ খুলতে দেখিনি কখনো। কিন্তু ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, বুধবার, জাতীয় সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মানবিক বোধের বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। আমার মনে হয়ে বিষয়গুলো নিয়ে এখন থেকেই খোলামেলা কথা বলার সময় এসেছে। যদি দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলতে পারেন, তবে আমরা পারব না কেন? 

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন আমাদের সকলের মনে জমে থাকা কথাগুলোই বলেছেন। আমি দেশের একজন সাধারণ নাগরিক। আমাদের সকলের মুখের অস্ফুট কথা যখন তিনি উপলব্ধি করতে পারেন বলেই তিনি জনমানুষের নেত্রী।

জাতীয় সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ ছিল রিকশাওয়ালাকে আপনি করে বলতে হবে। ড্রাইভারকে ড্রাইভার সাহেব বলতে হবে, আর কাজের লোকজন তাদের কখনো চাকর-বাকর বলা যাবে না। হুকুম দেওয়া যাবে না। তাদের সাথে সম্মান করে, ভদ্রভাবে চাইতে হবে।’

জাতীয় সংসদ অধিবেশনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমামের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে এভাবেই সুস্পষ্টভাবে উত্তর দেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন জাতীয় সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রত্যেকটি কথার মধ্যেই আমাদের বহুদিনের না বলা কথাগুলোই বারংবার ব্যক্ত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন আমাদের সকলের মনে জমে থাকা কথাগুলোই বলেছেন। আমি দেশের একজন সাধারণ নাগরিক। আমাদের সকলের মুখের অস্ফুট কথা যখন তিনি উপলব্ধি করতে পারেন বলেই তিনি জনমানুষের নেত্রী।

আরও পড়ুন : তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?

জনমানুষের চিন্তা চেতনাই প্রতিফলিত হয়, তার চিন্তায়। বাড়ির কাজের মানুষ বা অনুগত মানুষের সাথে কেমন ব্যবহার করা উচিত, এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া। তিনি এটা বিশ্বাস করতেন। আর তার আদর্শে অনুপ্রাণিত আমরাও সেটাই বিশ্বাস করি। আমরা ছোটবেলা থেকে সেভাবেই শিক্ষা নিয়েছি।

প্রধানমন্ত্রী হতে পারি এখনো বাড়িতে যে ছোট কাজের মেয়ে আছে বা যারাই আছে কারো কাছে যদি কখনো এক গ্লাস পানিও চাইতে হয়, যতদূর পারি নিজে করে খাই। যদি চাইতে হয় তাহলে তাদের জিজ্ঞেস করি আমাকে এটা একটু দিতে পারবে কি না। এই শিক্ষা আমরা নিয়ে এসেছি, এটা এখনো আমরা মেনে চলি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাবা শুধু বলেছেন তা নয় শিক্ষাও দিয়ে গেছেন। গরিব দেখলে, ভালো পোশাক না পরলে তাকে অবহেলা করতে হবে আমাদের কাছে সেটা না। আমাদের কাছে সকলে সমান সমাদর পায়। বরং যাদের কিছু নাই তাদের দিকে আমরা একটু বেশি নজর দৃষ্টি দেই।’

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের অত্যাচার বা অমানবিকতা সম্পর্কে যখন এদেশীয় আমরা কিছু লিখি বা বক্তব্য দেই তখন তাদের বিরুদ্ধে অনেক কথাই বলি। ব্রিটিশরা আমাদের তৃতীয় শ্রেণির, চতুর্থ শ্রেণির মানুষ মনে করতো; তাদের ক্লাবে এদেশীয় ন্যাটিভ ইন্ডিয়ানদের প্রবেশ করতে দিত না ইত্যাদি।

আরও পড়ুন : ধর্ম যার যার থাকুক, উৎসব হোক সবার

পরাধীন ভারতবর্ষে বিট্রিশদের ক্লাবগুলোর সামনে লেখা থাকতো, ‘এখানে ন্যাটিভ ইন্ডিয়ান এবং কুকুরদের প্রবেশ নিষেধ।’ সভা সেমিনারে ব্রিটিশের অমানবিকতা নিয়ে বক্তব্য দিয়ে হাততালি পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মানবতাবাদী জনপ্রিয় শিক্ষকও যখন ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রশ্ন আসে, তখন তাকে ভিন্নভাবে পাওয়া যায়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বরাদ্দকৃত বাথরুমে লেখা থাকে, ‘এখানে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ নিষেধ।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাবা শুধু বলেছেন তা নয় শিক্ষাও দিয়ে গেছেন। গরিব দেখলে, ভালো পোশাক না পরলে তাকে অবহেলা করতে হবে আমাদের কাছে সেটা না। আমাদের কাছে সকলে সমান সমাদর পায়।

সত্যি বিচিত্র সেলুকাস আমরা! কথার ফুলঝুরি এবং দ্বৈত চরিত্রের যদি কোনো নোবেল থাকতো তবে বাংলাদেশের কিছু তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্রলোকেরাই প্রতিবছর পেত।

ব্রিটিশরা তাদের অধস্তন এই দেশের কর্মচারীদের সমানাধিকার দেয়নি, ব্রিটিশ অফিসারদের সামনে দেশের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চেয়ারে বসতে পারতো না; বিষয়টি যেমন অমানবিক এবং দৃষ্টিকটু। 

ব্রিটিশরা চলে গেছে, কিন্তু তাদের সেই ঔপনিবেশিক ভাব বহু মানুষের রক্তের মধ্যে এখনো ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। এই কারণেই আমরা নীতিশিক্ষার বড় বড় কর্মশালা, সেমিনার করার পরেও, সেই জ্ঞান সমাজে ব্যবহার করতে পারি না।

বিষয়টি আজও আমার মাথায় বোধগম্য হয় না, চাকরির ক্ষেত্রে পদে অধস্তন হলে, একজন বাবার বয়সী মানুষকে কেন নাম ধরে ডাকতে হবে?

আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন 

দেশের প্রধানমন্ত্রীকে মানুষ নিঃসঙ্কোচে ‘আপা’ বলে সম্বোধন করতে পারে; তার একান্ত সান্নিধ্যে যেতে পারে, তার হাত ধরতে পারে, তার সামনে বসে মনের সকল দুঃখ বেদনা জানাতে পারে। বিপরীতে তিনিও সবাইকে জড়িয়ে ধরে আপন করে নেন, মাথায় হাত রাখেন, মানুষের দুঃখে কেঁদেও ফেলেন। কিন্তু সেই দেশের একজন উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাকে আপামর জনসাধারণের 'স্যার' বা 'ম্যাডাম' ডাকতেই হবে।

‘স্যার' বা 'ম্যাডাম' বলে না ডাকলে তারা ক্ষেপে যান। সরকারি কর্মকর্তাদের 'স্যার' বা 'ম্যাডাম' বলে সম্বোধন এবং কর্মকর্তাদের বাবার বয়সী মানুষকে নাম ধরে ডাকা—এই আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী। এর থেকে উত্তরণের উপায় আমাদেরই খুঁজতে হবে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর মানবিক বোধ দৃষ্টান্ত হিসেবে, আমাদের সকলের অনুসরণীয়।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়