স্ট্যাটিস্টা (Statista)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে সারা বিশ্বে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের বাজার ছিল প্রায় সাড়ে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের এবং ২০২২ সালের মধ্যে এই বাজার গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলারে।

ডিজিটাল বিজ্ঞাপনগুলো মূলত পিসি, ল্যাপটপ এবং বিভিন্ন রকমের মোবাইল ডিভাইসে দেওয়া হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের সার্চ ইঞ্জিন ফলাফল, ডিজিটাল ব্যানার, ভিডিও ইত্যাদি নানা ধরনে এই বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়ে থাকে। ফেসবুক, টুইটার এবং লিঙ্কডইনসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের জন্য বেশ জনপ্রিয়।

বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে এই অনলাইন বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যে প্রায় ৫০ ভাগ বাজার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে গুগল, ফেসবুক (মেটা) এবং অ্যামাজন।

২০২১ সালে বিশ্বের ডিজিটাল বিজ্ঞাপন ব্যয়ের প্রায় ৭০ ভাগ খরচ হয়েছিল এই তিনটি কোম্পানিতে, যেটি বৈশ্বিক মোট বিজ্ঞাপন ব্যয়ের ৪৭ ভাগ। অতএব, বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই ডিজিটাল বিজ্ঞাপনই এখন হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক বিজ্ঞাপন বাজার নিয়ন্ত্রণের অন্যতম মাধ্যম। এগুলোর মাধ্যমেই প্রভাবিত করা হচ্ছে ক্রেতা-বিক্রেতা, নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বাজার। 

ডিজিটাল জগৎ, বিশেষ করে ইন্টারনেট, একটি গ্লোবাল ব্যবস্থা এবং যে প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান। 

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই ডিজিটাল বিজ্ঞাপনই এখন হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক বিজ্ঞাপন বাজার নিয়ন্ত্রণের অন্যতম মাধ্যম। এগুলোর মাধ্যমেই প্রভাবিত করা হচ্ছে ক্রেতা-বিক্রেতা, নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বাজার।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রে, অথবা অন্যভাবে বলতে গেলে, গ্রাহক প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি মেনে চলছে কি না? তারা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে গোপনীয়তা (প্রাইভেসি) রক্ষায় গুরুত্ব কমিয়ে দিচ্ছে কি না? বাকস্বাধীনতা এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করেছে কি না?

ইতিমধ্যে এই ধরনের কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন পর্যায় থেকে অনাস্থা প্রকাশ করা হয়েছে; তারা ব্যবহারকারীর কী ধরনের ডেটা সংগ্রহ করছে, সেই ডেটাগুলো কীভাবে সংরক্ষণ করছে বা ব্যবহার করেছে, সেই ব্যাপারগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

প্রশ্ন উঠেছে, তাদের বিজ্ঞাপন প্রচারণা এবং পরিচালনার নীতি নিয়েও। বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়ত ডিজিটাল বিজ্ঞাপন দেখছি, কিন্তু আমাদের ধারণা নেই এই বিজ্ঞাপনগুলো কেন আমাদের দেখানো হচ্ছে, কীভাবে দেখানো হচ্ছে। এর মধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন নীতিমালা থাকলেও, সেই নীতিমালাগুলো আদৌ মানা হচ্ছে কি না, সেটিই বা কে নিরীক্ষণ করছে, সেই ব্যাপারেও ব্যবহারকারীর স্পষ্ট ধারণা নেই।

বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, অনেক ভুল তথ্য সমৃদ্ধ বিজ্ঞাপনও ডিজিটাল মাধ্যমগুলো বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়া প্রচার করে ফেলেছে। এজন্য কখনো তারা তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের দুর্বলতার কথা বলা হয়েছে, কখনো যথেষ্ট লোকবলের অভাবের কথা বলেছে। কারণ যাই হয়ে থাকুক না কেন, এর ক্ষতিকর প্রভাব কিন্তু থেমে থাকেনি।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমার রিপোর্টস পরীক্ষা করার জন্য, করোনা প্রতিরোধের জন্য ব্লিচ সেবন’ করার কথা বলে বিজ্ঞাপন দিলে, ফেসবুক সেটিও প্রচার করতে শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটি করোনা নিয়ে এই ধরনের ভুয়া তথ্য সমৃদ্ধ সাতটি বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য ফেসবুকে প্রদান করা হয়, ফেসবুক সিস্টেম একটি বিজ্ঞাপনও ভুয়া তথ্য সমৃদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেনি।

এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকেই বিজ্ঞাপন প্রদান করার জন্য ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত ও স্পর্শকাতর তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে থাকে, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হওয়ার সুযোগ থাকে।

এইসব ব্যক্তিগত তথ্য যদি প্রতিষ্ঠান থেকে বেহাত হয়ে অপরাধীদের হাতে চলে যায়, সেক্ষেত্রেও ব্যবহারকারীরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই ধরনের বিজ্ঞাপন প্রক্রিয়া সাধারণত সার্ভেইল্যান্স অ্যাডভার্টাইজিং (নজরদারীর ভিত্তিতে বিজ্ঞাপন) নামে পরিচিত।

বিভিন্ন জায়গায় আওয়াজ উঠেছে এই সার্ভেইল্যান্স অ্যাডভার্টাইজিং-এর পরিবর্তে কন্টেক্সটুয়াল অ্যাডভার্টাইজিং (প্রসঙ্গের ভিত্তিতে বিজ্ঞাপন) ব্যবহার করা যায় কি না, যেখানে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্যের পরিবর্তে ব্যবহারকারী যে ডিজিটাল কন্টেন্টের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে, তার উপর নির্ভর করে বিজ্ঞাপন দেখানো হবে। যদিও, এই পদ্ধতির প্রস্তাবনা তুলনামূলকভাবে নতুন এবং এর বেশকিছু চ্যালেঞ্জও আছে।

ব্যক্তিগত তথ্য যদি প্রতিষ্ঠান থেকে বেহাত হয়ে অপরাধীদের হাতে চলে যায়, সেক্ষেত্রেও ব্যবহারকারীরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

বর্তমানে ডিজিটাল দুনিয়ায় এক দেশে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশে সেবা দিচ্ছে বা ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছে। কিন্তু, এক দেশে যেটি আইনি হতে পারে, সেটি অন্য আরেকটি দেশে সেটি হতে পারে বেআইনি; এক দেশে যেটি হয়তো সংস্কৃতি বিরুদ্ধ নয়, অন্য আরেকটি দেশে সেটি সংস্কৃতি বিরুদ্ধ।

অন্যদিকে, বিভিন্ন প্রসঙ্গে প্রতিটি দেশের জন্য আলাদা-আলাদাভাবে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে বা পরিচালনা করতে গেলে, সেটি ইন্টারনেট বা ডিজিটাল মাধ্যমের বৈশ্বিক (গ্লোবাল) ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায়, সারা পৃথিবী একটি চ্যালেঞ্জের মুখে অবতীর্ণ হয়ে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহারকারীদের এই ধরনের উদ্বেগের বিষয়সমূহ কতটুকু গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।

সময় হয়েছে রাষ্ট্রীয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে ডিজিটাল দুনিয়ার এইসব মাধ্যমগুলো বা এইসব ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন প্রচার সুনির্দিষ্ট নীতির মধ্যে নিয়ে আসার। বিশেষ করে কী পদ্ধতিতে তারা তাদের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন ও পরিচালনা করছে সেটি স্পষ্ট করা, ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা, গোপনীয়তা এবং অধিকার যে সুরক্ষিত থাকছে সেটি নিরীক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়ে ব্যবহারকারীদের আপিলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবী। তবে, এই ধরনের পদক্ষেপ যেন আবার নিয়ন্ত্রণমূলক না হয়ে ওঠে; নিয়ন্ত্রণ নয়, নীতির প্রয়োজন।

ডিজিটাল ব্যবসা পরিচালনাকারী বা সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলোর জন্য ব্যবসা পরিচালনা করাটাই যেন কঠিন না হয়ে পড়ে, সেটি খেয়াল রাখা জরুরি।

বস্তুত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য নিশ্চিত করতে হবে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ, আর ব্যবহারকারীদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে ডিজিটাল নিরাপত্তা, অধিকার এবং তথ্য-উপাত্তের সুরক্ষা।

 

ড. বি এম মইনুল হোসেন ।। সহযোগী অধ্যাপক, তথ্য প্রযুক্তি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

bmmainul@du.ac.bd