ছবি : সংগৃহীত

স্বাস্থ্যই সকল সুখের চাবিকাঠি। স্বাস্থ্য সুরক্ষার সাথে অ্যান্টিবায়োটিক সুরক্ষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু, অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। কারণে-অকারণে অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার জীবন রক্ষার চেয়ে মৃত্যু ঝুঁকি বৃদ্ধি করেছে। ফলশ্রুতিতে, আমাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে।

এখন প্রশ্ন হলো, অ্যান্টিবায়োটিক কী এবং কেনইবা এর সুরক্ষার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চিন্তিত? অ্যান্টিবায়োটিক হলো এক ধরনের জৈব রাসায়নিক ওষুধ, যা বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে এবং তাদের বংশবিস্তার রোধ করে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, অ্যান্টিবায়োটিক হলো, ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের সর্বশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা, যেটি ব্যর্থ হলে রোগী বাঁচানো সম্ভব নয়। অথচ, আমাদের দেশে এই অ্যান্টিবায়োটিকের মারাত্মক অপব্যবহার প্রতিনিয়তই পরিলক্ষিত হচ্ছে, যার ফলশ্রুতিতে রোগীর স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।

আরও পড়ুন : নকল ওষুধ বন্ধ হবে কবে? 

আমাদের দেশে এমন কোনো মানুষ পাওয়া যাবে না, যে জীবনে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করেননি। কখনো ডাক্তারের পরামর্শে, কখনো দোকানদার বা পরিচিত স্বজনদের পরামর্শে আর কখনো নিজের বুদ্ধিতে আমরা অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে থাকি।

যেকোনো সাধারণ রোগে আমরা অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছি এবং জীবাণুগুলো আমরা ওষুধ বিরোধী হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছি, যা আমাদের মারাত্মক মৃত্যু ঝুঁকিতে ফেলছে। 

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, অ্যান্টিবায়োটিক হলো, ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের সর্বশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা, যেটি ব্যর্থ হলে রোগী বাঁচানো সম্ভব নয়। অথচ, আমাদের দেশে এই অ্যান্টিবায়োটিকের মারাত্মক অপব্যবহার প্রতিনিয়তই পরিলক্ষিত হচ্ছে

চিকিৎসকেরা বিভিন্ন ধরনের সাধারণ রোগে (সর্দি, কাশি, জ্বর, সাধারণ কাটাছেঁড়া ইত্যাদি) অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবস্থাপত্র প্রদান করছেন। আর এসব রোগব্যাধি যেহেতু সচরাচর হয়ে থাকে, সেহেতু মানুষ ওই ব্যবস্থাপত্রের ভিত্তিতেই বারবার অ্যান্টিবায়োটিক ক্রয় ও সেবন করছে।

নির্ধারিত সময়ের আগে রোগের প্রকোপ কমে আসায়, রোগীরা ওষুধ সেবন ছেড়ে দিচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি অ্যান্টিবায়োটিকের একটি কোর্স আছে। যেহেতু অ্যান্টিবায়োটিক দামি ওষুধ, তাই রোগীরা সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করছে না। ফলে জীবাণু দুর্বল হলেও মারা যাচ্ছে না এবং তারা একটু একটু করে ওষুধ বিরোধী হয়ে পরবর্তীতে শক্তিশালীভাবে আবার আক্রমণ করছে।

এক্ষেত্রে রোগীরা আবারও কয়েকদিন ওষুধ সেবন করে বাদ দিচ্ছে। ফলে একটা সময়ে ওই জীবাণু সম্পূর্ণভাবে ওই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হচ্ছে এবং অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারাচ্ছে।

আরও পড়ুন : স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে করণীয় কী? 

আমাদের দেশে সিপ্রোফ্লক্সাসিন অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা এইভাবে মারাত্মক হ্রাস করেছে, যা বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

২০১৩ সালে ভারতের খ্রিস্টান মেডিকেল কলেজে আমার ছোট ভাইয়ের ফুসফুসে একটি বড় সার্জারি হয়। এত বড় সার্জারির পর ওকে মাত্র পাঁচদিন অ্যামোক্সিসিলিন সেবন করতে দেওয়া হয়। দেশে ফিরে বিষয়টি নিয়ে আমি যখন আমার চিকিৎসক বন্ধুদের সাথে আলোচনা করি, ওরা জানায় আমাদের দেশে অপারেশন থিয়েটার শতভাগ জীবাণুমুক্ত কি না ওরা নিশ্চিত নয়। তাই ওরা রোগীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে অ্যান্টিবায়োটিক প্রদান করে, কোনো রিস্ক নিতে চায় না। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রা অতিরিক্ত ব্যবহার অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স (এ এম আর) বিষয়ক গ্লোবাল লিডার উদ্বোধনী সভায় অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রা অতিরিক্ত ব্যবহার কমিয়ে নিতে বৈশ্বিক পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে ৬টি প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন। এছাড়া তিনি আশঙ্কা করেছেন যে, এ এম আর করোনার চেয়ে প্রাণঘাতী মহামারিতে পরিণত হতে পারে।

অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার এখনই রোধ করতে না পারলে, দেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। তাই এখনই উদ্যোগী হতে হবে। এই বিষয়ে কতিপয় সুপারিশ হচ্ছে—

প্রথমত, চিকিৎসকদের সতর্কতার সাথে ওষুধের ব্যবস্থাপত্র প্রদান করতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবস্থাপত্র দিলে অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পন্ন করার জন্য রোগীকে বলা এবং কেন এটি জরুরি তা তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে।

আরও পড়ুন : নকল ও ভেজাল ওষুধের প্রভাব ও প্রতিকার 

এছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া একই ব্যবস্থাপত্র দিয়ে পুনরায় অ্যান্টিবায়োটিক সেবন যে বিপদজনক সেই বিষয়ে সতর্ক করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, ওষুধ প্রস্তুতকরণ, মান-নিয়ন্ত্রণ, ডোজ সমন্বয় ও প্রয়োগ বিষয়ে সম্যক ধারণা রাখেন ফার্মাসিস্টরা। তাই অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধে হাসপাতালগুলোয় ‘এ’ গ্রেড ফার্মাসিস্ট নিয়োগ করতে হবে। এছাড়া উন্নত বিশ্বের মতো রিটেইল ফার্মেসিগুলোয় ‘এ’ গ্রেড ফার্মাসিস্টদের কাজের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।

তৃতীয়ত, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ব্যতীত অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রিতে যে নিষেধাজ্ঞা জারি আছে, তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ওষুধের দোকানে কর্মরত টেকনিশিয়ানদের ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে হবে এবং প্রয়োজনে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এছাড়া গ্রাম্য চিকিৎসক যাতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবস্থাপত্র প্রদান করতে না পারে, সেই বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। 

যেহেতু অ্যান্টিবায়োটিক দামি ওষুধ, তাই রোগীরা সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করছে না। ফলে জীবাণু দুর্বল হলেও মারা যাচ্ছে না এবং তারা একটু একটু করে ওষুধ বিরোধী হয়ে পরবর্তীতে শক্তিশালীভাবে আবার আক্রমণ করছে।

চতুর্থত, ওষুধ কোম্পানি শুধুমাত্র ব্যবসামুখী চিন্তা করলে হবে না। তাদেরও সামাজিক দায়িত্ব আছে। প্রয়োজনবোধে তাদের ওষুধ প্রমোশন নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে।

পঞ্চমত, সরকারি বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ, অপারেশন থিয়েটার জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কঠোর নজরদারি থাকতে হবে।

আরও পড়ুন : অ্যাসিডিটি ও ডায়াবেটিসের ওষুধের ব্যবহার : আশঙ্কা ও প্রতিরোধ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স-এর কারণে বিশ্বে ২০৫০ সাল নাগাদ ১ কোটি মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হলে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও দেশের জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা হুমকির মুখে পড়বে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা জন্য অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্সের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বন্ধে আইন তৈরি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা সম্প্রতি মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রেস ব্রিফিং করে উল্লেখ করেছেন।

এছাড়া রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদমাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বিষয়ে জোর প্রচারণা চালাতে হবে, যাতে জনগণ এই বিষয়ে সচেতন হয়।

ড. আ. স. ম. মঞ্জুর আল হোসেন ।। সহকারী অধ্যাপক, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ