ছবি : সংগৃহীত

বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে ফের গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম শতকরা ৫ ভাগেরও বেশি বাড়ানো হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেশন কমিশন (বিইআরসি) আইনেরও পরিবর্তন করে সরকারের নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। একই সাথে প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের কথা বলেছেন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী।

বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও আমাদের দেশে কমার নজির তেমন একটা নেই। তবে মাসে মাসে সমন্বয় করার কারণে যদি বিশ্বের সাথে জ্বালানির দাম সমন্বয় হয় তাহলে দেশের ক্রেতারা কিছুটা হলেও লাভবান হবেন এই প্রত্যাশা রাখতেই পারি।

তবে গ্রাহক পর্যায়ে ৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর কারণে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ পড়বে, বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষ নিত্যপণ্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে বিদ্যুতের দামে আরও পিষ্ট হবেন এই আশঙ্কায় থাকেন। কারণ জ্বালানির দাম বিশেষ করে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে নিত্যপণ্য মূল্যসহ আরও অনেককিছুর দাম বেড়ে যায়, মূল্যস্ফীতি আরেক দফা উসকে যাবে। কিন্তু ক্যাবসহ নানা নাগরিক প্রতিষ্ঠান বারবার দুর্নীতি, অনিয়ম, কেনাকাটায় অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ আর অপচয় কমাতে পারলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না বললেও সরকার সেই বিষয়ে তেমন একটা কর্ণপাত করেনি।

আরও পড়ুন >>> মধ্যবিত্তের নতুন আতঙ্ক বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি 

এক দশকেই বিদ্যুতের দাম ৯ দফা বাড়ানো হয়েছে। এই সময় সব মিলিয়ে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১১৮ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ বেড়েছে। মহামারি করোনার প্রভাব কাটিয়ে যখন দেশ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় রয়েছে এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা ঠিক ওই সময়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়। এরপর থেকে দেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম।

দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে দেশের বিদ্যুৎ খাতের চিত্রে সক্ষমতা, বকেয়া, ভর্তুকি ও দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো আলোচনায় থাকলেও আমলে নেয়নি।

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাসে পুরো জনজীবন। এই পরিস্থিতিতে আবার গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয়েছে। এর প্রভাব সবকিছুতে পড়বে, বিশেষ করে মধ্যবিত্তরা আরেক দফা খরচের খাতা টেনে ধরতে বাধ্য হবে। ১ ডিসেম্বর থেকে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।

দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে দেশের বিদ্যুৎ খাতের চিত্রে সক্ষমতা, বকেয়া, ভর্তুকি ও দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো আলোচনায় থাকলেও আমলে নেয়নি। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা এই সময়ে গ্রাহক পর্যায়ে দাম না বাড়ানোর পরামর্শ দেন। কারণ বাজারের যে সার্বিক অবস্থা, গ্রাহক পর্যায়ে এখন বাড়ালে ভোক্তাদের ওপর দ্বিগুণ চাপ পড়বে।

আরও পড়ুন >>> বিদ্যুৎ সংকট : সমাধান হবে কবে? 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো(বিবিএস) এর হিসাবে এখন মূল্যস্ফীতি আট দশমিক পঁচাশি শতাংশ। এর মধ্যেই চলতি মাসেই সঞ্চালন সংস্থা ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানির আয়োজন করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। শুনানিতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম সর্বনিম্ন ১৫.৮ থেকে সর্বোচ্চ ২৭.৪৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করেন বিতরণকারী সংস্থাগুলো।

কিছুদিন আগে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। ফলে গণপরিবহন ভাড়াসহ বাজারের সব জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। এই মুহূর্তে আবার বিদ্যুতের দাম বাড়লে মধ্যবিত্ত পরিবারে সংসার চালানো কঠিন হয়ে যাবে। বছরের শুরুতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি হলে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে ২০২৩ সালের মূল্যস্ফীতি আরেক দফা উসকে দেওয়া হবে।

বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ইচ্ছেমতো মুনাফা করার জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চাচ্ছে। সরকার একদিকে বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি, সিস্টেম লস, অনিয়ম বন্ধে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। অন্যদিকে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে জনগণের কষ্ট ক্রমাগতই বাড়ছে।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সঙ্গে সমন্বিত পরিকল্পনায় সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের সক্ষমতা তৈরি না করায় উৎপাদিত বিদ্যুতের যথাযথ সুফল আসছে না।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সঙ্গে সমন্বিত পরিকল্পনায় সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের সক্ষমতা তৈরি না করায় উৎপাদিত বিদ্যুতের যথাযথ সুফল আসছে না। সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে জ্বালানির ‘জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল’ গঠন করছে না। একদিকে, সরকার বাজেট ঘাটতি মেটানোসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় মেটাতে গিয়ে জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলো দুঃস্থ বানিয়ে ফেলছে। বিষয়টি দেখে আপাতত মনে হতে পারে দাম বাড়ানোই তাদের মূল লক্ষ্য। এই রকম পরিস্থিতি হলে তো জ্বালানি নিরাপত্তা চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।

আরও পড়ুন >>> লোডশেডিং : এত বিপর্যয় কেন? 

তবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা কতটুকু আছে তারচেয়ে এই সময় কি দাম বাড়ানোর উপযুক্ত সময়? এখন দাম বাড়ালে দেশের অর্থনীতির যা অবস্থা তাতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। সেটা সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়বে।

বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে সব ধরনের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। ফলে বাজারে পণ্যের দাম বাড়বে। ভোক্তাদের তার পুরো দায়ভার বহন করতে হবে। একদিকে বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য অতিরিক্ত দাম দিতে হবে, আবার পণ্যের জন্য বেশি দাম দিতে হবে। এই দুই মুখী চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ।

বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষিখাতে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম কম রাখা প্রয়োজন। জ্বালানি তেলের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। সেচের জন্য কৃষকদের কম দামে ডিজেল দেয়ার জন্য কার্ড সিস্টেম চালু করা যায়। বিদ্যুতের বেলায়ও তাই হওয়া উচিত। নয়তো খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।

এখানে ব্যাপক অপচয়, দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং কোথাও কোথাও অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকি আছে। সেগুলো বন্ধ করা গেলে আসলে ভর্তুকি অনেক কমে আসতো।

অন্যদিকে, দফায় দফায় জ্বালানির ক্রমবর্ধমান দাম বৃদ্ধির চাপে জনগণের নাভিশ্বাস। বিদ্যুতের এই দাম বাড়ার প্রভাব শুধু বাসাবাড়িতে পড়বে তা নয়, কৃষি ও শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচও এতে বৃদ্ধি পাবে। এমনিতে সামগ্রিক অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে।

আরও পড়ুন >>> লোডশেডিং : সাশ্রয়েই সমাধান? 

বিশ্ব অর্থনীতিও মন্দার আশঙ্কায়। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অতিরিক্ত মূল্যে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো টিকিয়ে রাখার যৌক্তিকতা নেই।

পাশাপাশি, তথাকথিত সিস্টেম লস, যার আড়ালে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে, সেটা হ্রাস করা গেলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দরকার পড়ে না। এই খাতে অপচয় ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। দেশে যখন রপ্তানি আয়ে মন্দা চলছে, বিনিয়োগ পরিস্থিতিও যখন ভালো নয়, তখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতি ও জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)