ছবি : সংগৃহীত

স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীর গৌরবগাঁথা ‘ধর্ষিত ও নির্যাতিত’ নারীর ভূমিকায় অদৃশ্য হয়ে আছে অনেকটা। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস রাজাকার, আল বদরদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নারীর ওপর নিপীড়ন, ধর্ষণ, লাঞ্ছনা ও সহিংসতা ঘটিয়েছে নির্বিচারে। নারীরা ধর্ষিত বা অত্যাচারিত হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটা যেমন সত্য, তার চেয়েও বড় সত্য হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রণাঙ্গনে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছেন দেশের নারীরা। ঝুঁকি নিয়ে নিজের বাড়িতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, রক্ষা করেছেন। 

বীর মুক্তিযোদ্ধা (বীর প্রতীক) তারামন বিবি, কাঁকন বিবি বা সেতারা বেগমের কথা তো সবাই জানি। ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা তাদের বীরত্বগাঁথা। কিন্তু এমন অসংখ্য নারী বীর তো আছেন। তাদের কজনের কথাই বা জানি? বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের নেপথ্যে অসংখ্য তারামন বিবির অবদান লুকিয়ে আছে৷  

১৯৭১ সালের উত্তাল ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ঘোষণা দিলেন, ‘...আর যদি একটি গুলি চলে... প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’। তখন ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার’ কাজটি করেছিলেন দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর নারী সমাজ। বাড়িতে বাড়িতে কালো পতাকা উড়তে দেখা গিয়েছিল। এই কাজে নারীসমাজ অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। ২৫ মার্চ কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হলে শুরু হয় চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে দেশের নারী সমাজের ভূমিকা ছিল বহুমাত্রিক। অতীতের নানা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সম্পৃক্ততার ধারাবাহিকতায় রেখেছেন নানা ভূমিকা। 

আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ? 

মা ছেলেকে, বোন ভাইকে, স্ত্রী স্বামীকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন, প্রেরণা দিয়েছেন। ক্ষেত্রবিশেষে সঙ্গী হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক-সামাজিক ভূমিকা রেখেছেন। যুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের অনেক নারী হারিয়েছেন পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষ সদস্য যেমন বাবা, ভাই, স্বামী, ছেলেকে। পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরোচিত হামলায় কোনো পুরুষ জীবিত না থাকায় আমাদের দেশের অনেক গ্রাম পরিচিতি পেয়েছিল ‘বিধবার গ্রামে’। তখন এসব পরিবার ও সমাজের হাল ধরেছিলেন এই সাহসী নারীরাই।
 
তাই বলতে হয় ৯ মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের নারীর অবদান রয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যারা হাতে অস্ত্র তুলে নেননি, তারা দিয়েছেন সেবা। ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সর্বাত্মক এই যুদ্ধে শামিল হন। ২৫ মার্চের কালরাতের পর পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন পুরো বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে, সেই সময় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিবাদী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করতে সচেষ্ট থেকেছেন। 

আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সত্যিই বেদনাদায়ক 

গ্রামবাংলার মায়েরা নিজের ছেলেদের যুদ্ধে যেতে উদ্দীপনা জুগিয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধিতে তাদের অনুপ্রাণিত করতে ১৯৭১ সালের সাংস্কৃতিক দলগুলোর ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধাহত সৈনিকদের সহায়তা করতে নারীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে মুজিবনগর সরকার একটি নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে। নারীরা বিভিন্ন হাসপাতালে ও শরণার্থী শিবিরে সেবাদান করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে এভাবেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলার নারী সমাজ পাক সেনাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছেন। 

মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে নারীরা নানা কৌশল নিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ক্যাম্পে রান্নার কাজ করেছেন যারা, তারা অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহরী হিসেবেও কাজ করেছেন। আবার শত্রুদের বিষয়ে, খানসেনা ও রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবরও পৌঁছে দিয়েছেন সময়ের প্রয়োজনে। বাড়িতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, অস্ত্র এগিয়ে দেওয়া অথবা যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও চিকিৎসা করা, তাদের জন্য ওষুধ, খাবার ও কাপড়ের ব্যবস্থা ইত্যাদি নানা কর্মকাণ্ডে নারী যুক্ত থেকেছেন। আবার পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা নারী নির্যাতন ও পাশবিকতার কথা প্রচার করে নারী সমাজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমতও গড়ে তোলে। 

এক মহান আত্মত্যাগ ও বীরত্বগাঁথা সংগ্রামে এভাবেই বাংলাদেশের নারী সমাজ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালে সর্বমোট ৬৭৬ জন বীর যোদ্ধাকে বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন নারীও রয়েছেন। একজন হলেন ডা. সেতারা বেগম ও অন্যজন তারামন বিবি, যাদের ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন >>> সম্প্রীতি কোথায়?

মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসর আলবদর, রাজাকার, আলশামস বাহিনী গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগে নির্যাতিত মেয়েকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সমাজে এই নারীরা যেন মাথা উঁচু করে চলতে পারেন, এ জন্য তাদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাদের এই আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান দেখান। অনেকের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তাদের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করেন। 

যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অত্যাচারিত নারীরা এ সমাজে যখন নিগৃহীত নিপীড়িত হতে থাকে, তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। সত্যিকারের পিতার ভূমিকায় থেকে বলেছেন, 'ধর্ষিতা মেয়ের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দাও। আর ঠিকানা লেখ ধানমন্ডি ৩২…। মুক্তিযুদ্ধে আমার মেয়েরা যা দিয়েছে সেই ঋণ আমি কীভাবে শোধ করব?'

যে নারীদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো, তাদের যথাযোগ্য সম্মান দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরশ্রেষ্ঠ, বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়ার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা নারীদের জন্য দিয়েছেন বীরাঙ্গনা খেতাব। আমাদের প্রিয় লাল সবুজ পতাকায় পুরুষের রক্তের পাশাপাশি মিশে আছে নারীর রক্ত, নারীর আত্মত্যাগ। 

আরও পড়ুন >>> রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবও স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মত্যাগী, লাঞ্ছিতা মা-বোনদের পাশে দাঁড়ান। তিনি তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করাসহ ব্যক্তিগতভাবে তাদের পাশে গিয়ে সান্ত্বনা দেন এবং সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি যুদ্ধে লাঞ্ছিত মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করে তাদের সামাজিক মর্যাদাপূর্ণ জীবন দান করে জীবনের আলোর সন্ধান দেন এবং মুখে হাসি ফোটান। এভাবে তিনিও স্বাধীন দেশের নারী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করেছেন।

সুলতানা রাজিয়া পাননা ।। পরিচালক, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন ও পরিকল্পনা।। রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়