রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রদানের মাধ্যমেই তার কাজ সমাপ্ত করেননি। বরং জাতির সাংস্কৃতিক চেতনা নির্মাণেও সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তার ভাষণ পর্যবেক্ষণ থেকে শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি বাঙালির সংস্কৃতি বিষয়ে তিনি যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা অনুসন্ধানের প্রয়াস নেওয়া যেতে পারে।

১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর হোটেল পূর্বাণীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সেখানে প্রধান অতিথির ভাষণে বলেন, শিল্পী, সাহিত্যিক এবং কবিরা আমাদের মানুষ, মাতৃভূমি ও সংস্কৃতির জন্য শিল্পচর্চা করবেন।

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য সাহিত্যিকদের আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানান। কেননা নতুন রাষ্ট্র গঠনের পর্যায়ে চিন্তার উপাদান নির্মাণে শিল্পী-সাহিত্যিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে তিনি সাহিত্যিকদের নতুনতর স্থান নির্মাণের প্রয়াস নিয়েছেন। এখানে তিনি বলেন, ‘শিল্পী, কবি ও সাহিত্যিকবৃন্দের সৃষ্টিশীল বিকাশের যে কোনো অন্তরায় আমি এবং আমার দল প্রতিহত করবে।’ তার মানে সৃষ্টিশীল মানুষেরা নিজ ভূমি, ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য কাজ করে যাবেন আর রাজনৈতিক দল এই বিকাশে সহযোগী ভূমিকায় থাকবে।

১৯৭১ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ‘পূর্ব পাকিস্তান সংগীত শিল্পী সমাজ’ বঙ্গবন্ধুর সম্মানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বেগম লায়লা আর্জুমান্দ বানুর সভাপতিত্বে শিল্পীদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত সংবর্ধনায় শিল্পী আবদুল আহাদ বঙ্গবন্ধুকে ‘বঙ্গ সংস্কৃতির অগ্রদূত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। শিল্পীদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে সরোদ, সেতার, একতারা এবং জয় বাংলার রেকর্ড উপহার দেওয়া হয়। এখানে বঙ্গবন্ধু শিল্পীদের আহ্বান জানান গণমুখী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানোর জন্য।

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে, গণমানুষের সুপ্ত শক্তি ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে অবলম্বন করে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য আপনাদের কাজ করতে হবে।’ তার এই ভাষণ সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিনির্মাণের পাশাপাশি একজন শিল্পতাত্ত্বিকের সঙ্গে পরিচয় ঘটায়।

জনগণের শিল্প তৈরির ক্ষেত্রে শিল্পী সমাজের ভূমিকা অনন্য। পরাধীন রাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিনির্মাণে দেশজ শিল্পের চর্চা যেমন জরুরি, তেমনি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সুখ-দুঃখকে চিত্রায়নের মাধ্যমে জনগণকে ভবিষ্যৎ লড়াইয়ে প্রস্তুত করতে হবে। এখানে তিনি বলেন, ‘সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে, গণমানুষের সুপ্ত শক্তি ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে অবলম্বন করে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য আপনাদের কাজ করতে হবে।’

তার এই ভাষণ সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিনির্মাণের পাশাপাশি একজন শিল্পতাত্ত্বিকের সঙ্গে পরিচয় ঘটায়। বঙ্গবন্ধুর এই বিশ্লেষণধর্মী ভাষ্য তাকে রাজনীতিবিদ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে তাত্ত্বিকের স্থানে নিয়ে যায়। এই সমাবেশে তার আরেকটি ভাষ্য ছিল রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে কেন্দ্র করে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে বাদ দিলে বাংলা সাহিত্য অস্তিত্বহীন হয়ে যায় কি না। সমাবেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমরা যদি ৬ দফা ও ১১ দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন লাভ করতে পারি, তবে শিল্পী ও সাহিত্যিকরা সবকিছু পাবেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত পাওয়া যায় তার ভাষণে। তিনি বলেছিলেন, ‘জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে একটি জাতীয় ললিতকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হবে।’ এ থেকেই বোঝা যায়, শিল্প সংস্কৃতির বিকাশে তিনি কতটা সক্রিয় ছিলেন। 

জাতীয় সংস্কৃতির গৌরবময় বিকাশকে আন্দোলন হিসেবে গড়ে তুলতে ১৯৭৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে গৃহীত ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি অ্যাক্ট ১৯৭৪’ অনুসারে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়।

একাডেমির প্রথম মহাপরিচালক ছিলেন অধ্যাপক ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। সাংস্কৃতিক বিষয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করা, বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ ও উন্নয়নের মাধ্যমে গুণী শিল্পীদের যথাযথ মূল্যায়ন করা এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যাবলির অংশ। বিভিন্ন পুরস্কার এবং সম্মাননা প্রদানসহ সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলোকে অনুদান প্রদান করে থাকে এই প্রতিষ্ঠান। এছাড়া এই একাডেমি, চারুকলা ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী, নাটক, সংগীত ও নৃত্যানুষ্ঠান, আন্তর্জাতিক উৎসব এবং প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। পাশাপাশি চারুকলা, সংগীত, নৃত্য, নাটক ও চলচ্চিত্র বিষয়ক গ্রন্থাদি প্রকাশ, গবেষণা এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে।

কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা। তার সব সাংগঠনিক কার্যক্রমে শিল্পী-সাহিত্যিকদের যুক্ত করার চেষ্টা করতেন। একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম।

স্বাধীন জাতি হিসেবে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সাংস্কৃতিক চুক্তি এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রমের মাধ্যমে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় ১৯৭২ সালে ‘সংস্কৃতি ও ক্রীড়া’ বিষয়ক একটি বিভাগ গঠন করা হয়। দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বিকাশে এ বিভাগ কাজ শুরু করেছিল। পরবর্তী সময়ে এর পথ বেয়ে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি, যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পহেলা বৈশাখ ছুটির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। ছাত্রলীগ নেতাদের তিনি নির্দেশ দিলেন তারা যেন মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। ছাত্রনেতারা পহেলা বৈশাখ ছুটি প্রদানের বিষয়ে নিজেদের সমর্থনের কথা মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে আসে।

একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, মুসলিম লীগসহ সাম্প্রদায়িক দলগুলো সে সময়ে পহেলা বৈশাখ সরকারি ছুটি ঘোষণার বিরোধিতা করেছে। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর সরকারি বাসভবনের এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি কামরুজ্জামান, ঢাকা জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি বজলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মুস্তাফা সারওয়ার। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে পহেলা বৈশাখকে জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি দেন।

কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা। তার সব সাংগঠনিক কার্যক্রমে শিল্পী-সাহিত্যিকদের যুক্ত করার চেষ্টা করতেন। একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। বাঙালি জাতির পথচলা এই জাতির নেতা হিসেবে তিনি ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি জানতেন চিন্তাবিদ আর জনগণের মাঝে সেতু তৈরি করতে না পারলে রাজনৈতিক সংগ্রাম ফল পাবে না। সেদিকে তিনি বিশেষ নজর দিয়েছেন তার যে কোনো রাজনৈতিক লড়াইয়ে বুদ্ধিজীবী এবং সংস্কৃতি কর্মীদের জন্য দায়িত্ব নির্ধারিত ছিল। 

ড. তানভীর আহমেদ সিডনী ।। গবেষক ও নাট্যকার