ছবি : সংগৃহীত

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় ক্যাম্পাসে এখনো উত্তেজনা বিরাজ করছে। ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, রাত সাড়ে ৯টার দিকে জাবির মীর মশাররফ হোসেন হলে স্বামীকে আটকে রেখে গৃহবধূকে হল সংলগ্ন জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করে কয়েকজন।

এই ঘটনায় মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী নারীর স্বামী। মামলার আসামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান এবং অন্য চারজন সবাই ছাত্রলীগের নেতা। জাহাঙ্গীরনগরে এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। আমরা ছাত্রলীগ নেতা সেঞ্চুরি মানিকের কথা জানি। সে এই ক্যাম্পাসে ধর্ষণের শতক পূর্ণ করেছিল।

৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সময় টিভি অনলাইনে একটি নিউজ করেছে যার শিরোনাম—গত ৯ বছরে জাবি ছাত্রলীগের যত নারী নিপীড়ন। টাইম লাইন ধরে প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, নয় বছরে এই ক্যাম্পাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বহিরাগত নারীকে শারীরিক হেনস্তার ১০টিরও বেশি ঘটনা ঘটেছে।

এগুলোর সবটিতেই এসেছে ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীর নাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।

এবারের ঘটনায়ও কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে না যদিও ক্যাম্পাস এখন উত্তাল। মাহমুদুর রহমান জনি নামের একজন শিক্ষকের কথা আসছে যিনি আগে ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন এবং তার নৈতিক মান ও আচার-আচরণ নিয়ে ক্যাম্পাসে বহু কাহিনি চালু আছে। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজগুলোয় নারী নিপীড়ন, সহিংসতা, কোন্দল, নিজেদের মধ্যে খুনাখুনির প্রায় সব ঘটনায় জড়িয়ে আছে ছাত্রলীগের নাম।

নয় বছরে এই ক্যাম্পাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বহিরাগত নারীকে শারীরিক হেনস্তার ১০টিরও বেশি ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর সবটিতেই এসেছে ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীর নাম।

জাহাঙ্গীরনগরের এখনকার ঘটনার মতো ঘটনা ঘটেছিল সিলেটের এমসি কলেজেও। ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিকালে দক্ষিণ সুরমার এক যুবক তার নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরতে এসেছিলেন। সন্ধ্যার পর কলেজের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান করছিলেন তারা। এই সময় কয়েকজন যুবক তাদের ঘিরে ধরে।

একপর্যায়ে তাদের জোরপূর্বক জিম্মি করে গাড়িতে তুলে কলেজের ছাত্রাবাসের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বামীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে স্ত্রীকে ধর্ষণ করে তারা। এরা সবাই ছাত্রলীগের নেতা। বিচার আজও হয়নি।

বিচার হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর হত্যার। ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে স্যার এ এফ রহমান হলে সিট দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় আহত হয়ে একদিন পর মারা যান। ওই সংঘর্ষে ৩০ জন আহত হন। হত্যা মামলায় ছাত্রলীগের সাবেক ১০ নেতা-কর্মীর সবাই বেকসুর খালাস পেয়েছেন।

বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যা, পুরোনো ঢাকার বিশ্বজিৎ হত্যার মতো নৃশংস খুন ছাত্রলীগের নেতারা কীভাবে করেন এটা বড় জিজ্ঞাসা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিনতাই তো নিয়মিত ঘটনা এবং তার সাথেও ছাত্রলীগের নামই বেশি আসছে।

নারীর জন্য ক্যাম্পাস কেন এত অনিরাপদ? দেশের সর্বোচ্চ পদ থেকে নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা আসীন, তবু কেন সমাজে যৌন হয়রানির মতো ক্ষত দূর হচ্ছে না—এটাই প্রশ্ন।

ক্যাম্পাস এত অনিরাপদ কেন? রাজনৈতিক সহিংসতা, আধিপত্য চর্চা, হল দখল, সিট দখল, ভিন্নমতের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, চাঁদাবাজির অভিযোগ ঐতিহাসিককাল ধরেই আছে। কিন্তু প্রায় দেড় দশকে দেখা যাচ্ছে অনেক ছাত্র রাজনৈতিক নেতাকর্মী একেবারে আতঙ্কজনক হারে দাগি অপরাধী হয়ে উঠছে। এরা ধর্ষক, এরা খুনি, এরা একেকজন ভয়ংকর সমাজ বিরোধী।

নারীর জন্য ক্যাম্পাস কেন এত অনিরাপদ? দেশের সর্বোচ্চ পদ থেকে নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা আসীন, তবু কেন সমাজে যৌন হয়রানির মতো ক্ষত দূর হচ্ছে না—এটাই প্রশ্ন। নারী-সুরক্ষা নিয়ে কত কথা। স্বাধীনতার পাঁচ দশকেরও বেশি পার করে প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তমনস্ক এই গণতন্ত্র নারীর জন্য এত অনিরাপদ?

শুধু নারী নয়, সাধারণ শিক্ষার্থী এমনকি শিক্ষকরাও কি নিরাপদ? দুই একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি শাসক দলের ছাত্র নেতাদের চাপে বিপর্যস্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজগুলোর প্রশাসন। ঢাকার ইডেন কলেজ, বদরুন্নেসার মতো নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয়ও চলছে ভয়ংকর অরাজকতা।

এখন স্পষ্ট করে বলবার সময় এসেছে ছাত্র রাজনীতি বলে যা আছে তা পড়ুয়াদের কোনো কাজে আসছে না। এই রাজনীতি শিক্ষা স্বার্থবিরোধী। ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে, হিংসাত্মক হানাহানি চলছে, পড়ুয়ারা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, শিক্ষক-অধ্যাপকরাও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। এটা তাহলে কোন ধরনের ছাত্র রাজনীতি? এই রাজনীতিতে ছাত্রছাত্রী এবং প্রতিষ্ঠানের কল্যাণ কোথায়?

ক্যাম্পাস সমূহে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে শাসক দলের একচ্ছত্র আধিপত্য স্থায়ী করার ফলে তারা নিজেরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে, দাগি অপরাধী হয়ে উঠছে। বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। যাদের ভাববার কথা বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষক সমাজ নিজেরাও কদর্য রাজনীতি করছেন শিক্ষাঙ্গনে।

একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যেখানে ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরকার রাজনীতি একটা বিচারহীনতার সুযোগ তৈরি করে রেখেছে। অত্যন্ত গর্হিত কুকর্ম করেও আইনের ফাঁক গলে নিশ্চিন্তে থাকার আয়োজন আছে এখনকার রাজনীতিতে। এই ছাত্ররাজনীতি করা যেমন তেমনি রাজনৈতিক শিক্ষকরাও নিজেদের এর বাইরে ভাবতে পারছে না।

প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজ সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্ররা দখল করে রেখেছে। শিক্ষা প্রশাসন বলে কিছু আর নেই। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। দেশে সুশাসন চাইলে ক্যাম্পাসগুলো অপরাধীমুক্ত করতে হবে। কারণ আমরা জানি অন্তরালে থেকে রাজনীতিবিদরা তাদের প্ররোচনা ও রসদ জোগায়, রাজনৈতিক দুর্বলতা কিংবা স্পর্ধাই অপরাধীদের শক্তির প্রধান উৎস।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন