ছবি : সংগৃহীত

অন্যের সবকিছু দেখার জন্য আমরা উদগ্রীব। জানার জন্য উতলা। হোক তা যতই ব্যক্তিগত। আমাদের ‘এই পরচর্চা’ বা ‘অন্যের চর্চা’ মানসিকতাকে পুঁজি করে অনেকেই ব্যবসা বাণিজ্য করে নিচ্ছে। তারা ভালোভাবেই জানে আমাদের স্বভাববৃত্তান্ত। ফলে পুঁজি যেখানে ফ্যাক্টর, বাজার যেখানে মুখ্য, বিপন্নতাই যেখানে জীবনের সাফল্য প্রক্রিয়া—সেইখানে টাকার জন্য যে যা পারে করবে, এটাইতো স্বাভাবিক, এতে অবাক বা বিস্মিত হওয়ার কী আছে?

সম বা অসম বিয়ে কোনো নতুন বিষয় নয়। অসম বিয়ে যে কেউ, যে কারও সঙ্গে করতে পারে—প্রচলিত আইন মেনে। এমন নয় যে, এই ধরনের বিয়ে দেশে বা বিশ্ব ভূগোলে এইটাই প্রথম। তবে প্রচলিত সামাজিক রীতির বাইরে গেলে লোকে এক-আধটু তাকাবে, এমনটাই হয়েই থাকে। শুধু আমাদের দেশে নয়; বাইরের দেশেও।

যতই পশ্চিমের কথা বলি তারা খুবই আধুনিক, কাউকে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাদের নেই, যতই সেলফ সেন্টারড বা ইন্ডিভিজুয়্যালিজমের কথা বলি; সেইখানেও উদ্ভট কিছু দেখলে লোকে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।

‘রিপ্লিজ বিলিভ ইট অর নট’ তো—আজব বিষয় দিয়েই ব্যবসা করে গেছে। তবে এটা সত্যিই অপ্রচলিত হোক, অনিয়মিত হোক, অস্বাভাবিক হোক—আমাদের মতো অন্যের বিষয় নিয়ে এতো বেশি কাউকে পড়ে থাকতে দেখিনি। এমনকি খোদ আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলোয়ও নয়। অন্যের বিষয়ে আমাদের কৌতূহল-আগ্রহ রীতিমতো দুর্নিবার এবং ভয়াবহ।

অবকাঠামোগত উন্নতি আমাদের বেশ হয়েছে। একথা অস্বীকারের সুযোগ নেই। কিন্তু মানসিকতার, মানবিকতার যে শ্রেণি উত্তরণ আমাদের ঘটেনি একথা স্বীকার করতে হবে নির্দ্বিধায়।

চারপাশের পরিবেশ—প্রতিবেশী তা বলে দিচ্ছে। এখানে প্রায় প্রতিটি মানুষ চাইছে রাতারাতি ধনাঢ্য হতে। যাকে বলে ‘ওভার নাইট এলিট’। অনেকটা এক রাতে বড়লোক হয়ে যাওয়ার মতো। ফলে এখানে যে যা পারে করতে চাচ্ছে, করতে যাচ্ছে এবং করছেও।

আর এই করতে গিয়ে যার যে কাজ নয়, তাও করতে দ্বিধাবোধ করছে না কেউ। যে গায়ক নয় তাকে দিয়ে গান গাওয়ানো হচ্ছে, যে অভিনেতা নয় তাকে দিয়ে নাটক, সিনেমা করানো হচ্ছে, যে লিখতেই জানে না তাকে দিয়ে বই লেখানো হচ্ছে, যে কোনোদিনই সাংবাদিকতা করেননি, তাকে সম্পাদক করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই—অর্থ উপার্জন। নিয়ম-অনিয়ম, অভিজ্ঞতা-অনভিজ্ঞতা, নৈতিকতা-অনৈতিকতার ধার কেউ ধারছে না।

এখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুব ভয়ংকর। নিম্ন রুচির চাষাবাদের রীতিমতো উর্বর ক্ষেত্র বলা চলে। ফলে তাবৎ অসভ্যতা, অশ্লীলতা করে লোকে নজর কাড়ছে। কেউ কেউ কথিত ‘বিখ্যাত’ বনে যাচ্ছে। কার কত ক্লিক, কার কত ভিউ তা দিয়ে বিচার হচ্ছে বিখ্যাত হওয়ার মানদণ্ড। কারণ এর পেছনে অর্থ।

লাইভে এসে কাপড় পরেন, লোকে গালি দিলে আবার রসিয়ে উত্তর দেন—এমন এক মেয়ের ফলোয়ার এখন লাখ লাখ। মূলত তার পুঁজি অশ্লীল গালাগালি। মেইনস্ট্রিম মিডিয়াও এখন তার পেছনে ছুটছে, স্টোরি করছে, সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। এই যখন পরিস্থিতি, গণমাধ্যমের রুচি ও পরিবেশ তখন বই মেলায় প্রকাশকদের ভর্ৎসনা করতেও আমার রুচিতে বাধে। বই যে একটা জ্ঞান ও সৃজনশীলতার অন্যতম বাহন তারা তা ভুলতেই বসেছে।

প্রকাশনা আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ও উপার্জনের অন্যতম অবলম্বন অনেক দিন ধরে। এদেশের বহু গুণী লেখকের বই প্রকাশিত হয়েছে আমাদের প্রকাশনা সংস্থা থেকে। কিন্তু কখনই অলেখককে লেখক তৈরির প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে দেখিনি পরিবারের কাউকে।

অর্থ বা অনুরোধ কোনো ছুতোয় নয়। এমনকি ক্ষমতার প্রভাবও নয়। সম্প্রতি একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মুশতাক আহমেদ ও তার স্ত্রী সিনথিয়া তিশাকে রাতারাতি লেখক বানিয়ে ফেলল। লেখক যে কেউ হতে পারে, যেকোনো বয়সে। মুশতাক আহমেদ ৫০, ৬০, ৭০ বা ৮০ যেকোনো বয়সে এসে লিখতে পারে, বই প্রকাশও করতে পারে। কিন্তু যে বিষয়ে তিনি ও তার স্ত্রী সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল সেইসব বিষয়বস্তুকেই বইয়ের আদলে নিয়ে আসতে হবে?

তাদের ভাইরাল ইমেজকে পুঁজি করে বই প্রকাশ নেহাত রুচিহীনতা ভিন্ন আর কিছু নয়। তারা তাদের বিতর্কিত ব্যক্তিগত জীবনকে বাজারে নিয়ে আসছে শুধুমাত্র বিক্রির স্বার্থে।

সাজাপ্রাপ্ত আলোচিত ও বিতর্কিত আসামি ডা. সাবরিনা করোনাকালে শত শত মানুষের সাথে প্রতারণা করেছে, ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে, মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। সেই ডা. সাবরিনা তার গ্ল্যামার ইমেজ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল, তার বই প্রকাশও একই প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে।

প্রকাশকরা তাদের ভাইরাল ইমেজ কাজে লাগিয়ে বই বিক্রি করতে চাচ্ছে। ভয় হয় প্রকাশকরা কবে যেন বইয়ের সঙ্গে এই জাতীয় লেখকদের, ভাইরাল ইমেজকে আরও কাজে লাগাতে সঙ্গে ভিডিও সিডি দিয়ে দেয়!

পুঁজির এই উৎকট বাজারে এই ধরনের ‘অলেখক’ ও ‘অপ্রকাশক’ দুই শ্রেণিই শর্টকাটে অর্থ উপার্জনের প্রজেক্ট নিয়েছে। যে প্রজেক্টগুলো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খুবই ভয়াবহ।

বইমেলায় অনেক কিশোরী মেয়েদের বলতে শুনেছি, আমরা মুশতাক আহমেদ চাই, নিশ্চিত জীবন চাই। এসব ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুললেই ভেসে ওঠে।

কাল আপনার মেয়ে বা বোন যদি এমন একজন মুশতাক আহমেদকে জীবনের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে চায়, ভালো লাগবে আপনার? কিংবা আপনার মেয়ে যদি ডাক্তার সাবরিনা হতে চায়, কেমন লাগবে তখন?

আমরা আসলে সমাজের কোন চরিত্রকে প্রচার করছি, তা কি ভেবে দেখেছি একবারও? শুধুমাত্র উপার্জনের জন্য রুচি, চরিত্র, নৈতিকতা সব কি হারাতে বসেছি? সানাই মাহবুব বা সেফুদার সঙ্গে ‘মুশতাক-তিশা’ দম্পতি কিংবা ডা. সাবরিনার খুব বেশি দূরত্ব নেই।

তারপরও আমি কাউকে বইমেলা থেকে দুয়োধ্বনি দিয়ে বের করে দেওয়ার পক্ষপাতী নই। তবে তাদের জন্য শুধু বলতে চাই, জীবন একটাই, শুধুমাত্র অর্থের জন্য নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে খোলাবাজারে এনে বিক্রির পর অবশিষ্ট থাকে না আর কিছুই।

জীবনের সব তো পুঁজি আর উপার্জনের জন্য নয়। জীবনের কিছুটা নিজের জন্য রাখতে হয়। যা একান্ত, নিজস্ব—শুধুই ব্যক্তিগত।

জব্বার হোসেন ।। সম্পাদক, আজ সারাবেলা; সদস্য, ফেমিনিস্ট ডট কম