ছবি : সংগৃহীত

কথায় বলে, ‘কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস’। এর অর্থ, মুকুলেই যদি আপনি আপনার পরিকল্পনা মাফিক বিষয়ের কাঠামো তৈরি না করেন সেক্ষেত্রে সেটি যখন বহুদূরে চলে যায়, তখন সে বিষয়টিকে সেই কাঙ্ক্ষিত কাঠামোতে রূপ দেওয়াটা হয়ে পড়ে অসম্ভব।

কথাগুলো মূলত বলছিলাম বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামের উত্থান, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আর সেগুলোর সাথে নানাবিধ সলুক সন্ধানের সূত্র ধরে প্রাসঙ্গিক ভাবনার প্রেক্ষিতে।

২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ বিচারের দাবিতে যে গণজাগরণ মঞ্চের উত্থান সেটি একটা পর্যায়ে আলোচিত আর সমালোচিত হয়ে ওঠে। এর গায়ে ধর্মবিরোধী/বিদ্বেষী/নাস্তিক ইত্যাদি তকমা জুড়ে যায়। ফলে মুসলমান অধ্যুষিত এই দেশে এই সেক্যুলার মঞ্চ, যারা বিচারহীনতার সংস্কৃতি রোধে এগিয়ে এসেছিল তারা বাঙালি মুসলমানের জন্য হয়ে ওঠে অস্বস্তির এবং একই সাথে ক্রমান্বয়ে এটি হয়ে ওঠে একটি ‘পাঞ্চিং ব্যাগ’।

এটি এমনই এক ‘পাঞ্চিং ব্যাগ’ হয়ে ওঠে যাকে সবাই সব জায়গা থেকে আঘাত করতে থাকে নিজেদের সুবিধা আর ইচ্ছামতো। ঠিক এই সময়েই কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সংগঠন ‘হেফাজতে ইসলাম’কে গণজাগরণ মঞ্চের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেয় ডানপন্থী একটি চিহ্নিত মহল।

জাতীয়তাবাদী দলের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত দৈনিক আমার দেশ ও তার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এই পুরো ঘটনায় অনেকটা নেতৃত্ব দেন বললেও অত্যুক্তি হবে না। হেফাজতের এই উত্থানের পেছনে একই সাথে আঙ্গুল ওঠে নয়া কৃষি আন্দোলনের ফরহাদ মজহারের ওপরও।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক আর সাংগঠনিক শক্তিকে যদি বিবেচনায় ধরি, সেক্ষেত্রে হেফাজত ছিল এক রুগ্ন শিশু।

বলা হয়, সুপরিকল্পিত উপায়ে গণজাগরণ মঞ্চের বিপরীতে এই রাতারাতি গঠিত হওয়া হেফাজতে ইসলামকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে একদিকে যেমন জাতীয়তাবাদী দলের সহযোগী হিসেবে নতুন আরেক ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব ঘটানো হয় অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে রাজনৈতিকভাবে চাপে ফেলার জন্যও এই শক্তিকে ব্যবহারের পরিকল্পনা হয়।

হেফাজতের যে সদস্য সংখ্যা এবং তাদের যে গত চার/পাঁচ দশকের সংখ্যার বিকাশ হয়েছে সেটা হঠাৎ করেই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে স্পষ্ট অনুভূত হয়। এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক এই সংগঠনটি যেভাবেই মঞ্চে আবির্ভূত হোক না কেন, ভোট রাজনীতিতে এই সংগঠনটির একটি তাৎপর্যপূর্ণ অভিঘাত রয়েছে।

হেফাজতে ইসলামকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরোধীপক্ষ তাদের নিয়ে যে লাভ-লোকসান, হিসাব-নিকাশ আর ভাবনার জগৎ খুলে দিয়েছে এটি তারা অচিরেই বুঝতে পারে এবং এই বুঝতে পারার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের রাজনীতি প্রবেশ করে ‘কম্প্রোমাইজের’ নতুন ভুবনে।

দেশ ভাগের যে ধর্মীয় তত্ত্ব আর পাকিস্তান পর্বে তার যে চরম ব্যর্থতা সেটির ফলশ্রুতিতেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের পরপর রাষ্ট্র পরিচালনার প্রথম ধাপেই এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির গতিপথ বন্ধ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী ধর্মভিত্তিক রাজনীতির যেই ধারা আমাদের দেশে জেঁকে বসেছিল সেটিকে আর বন্ধ করা যায়নি।

হেফাজতে ইসলাম এই ধারাটিকে কুড়িয়ে নিয়েছিল এবং সেই সূত্র ধরে তারা প্রথম আঘাত হানে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায়। স্বরবর্ণ পরিচয়ের ধারাপাত থেকে শুরু করে উচ্চ মাধ্যমিক বইতেও তারা ছুরি চালায় ধর্মকে কেন্দ্র করে। এই স্বাধীন বাংলাদেশে তারা দাবি তোলে পাঠ্যপুস্তকে হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ থাকতে পারবে না।

বিশেষ করে ২০১৩ সালের তাদের যে ১৩ দফা সেটি দেখেই বোঝা যায় হেফাজতে ইসলাম এই দেশটিকে মূলত একটি তালেবান রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যেতে চায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জাতীয়তাবাদীদের ট্রাম্প কার্ডকে ‘আপাত নিউট্রাল’ করে একটা নিয়ন্ত্রণমূলক আবহ তৈরি করার অভিপ্রায়ে প্রতিবারই হেফাজতে ইসলামের এই সমস্ত নানাবিধ অন্যায় দাবি দাওয়া মেনে নিয়েছে।

ফলে গণজাগরণ মঞ্চের ন্যায্য দাবিতে আঘাত থেকে শুরু করে একে একে পাঠ্যপুস্তক, নারী স্বাধীনতা, সুপ্রিম কোর্টে গ্রিক থেমিসের ভাস্কর্য অপসারণ, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর সবখানেই তারা হাত দিয়েছে এবং বললে অত্যুক্তি হয় না যে, অনেকটা সফলও হয়েছে।

আজকে প্রমাণিত হয়েছে হেফাজত একটা কাগুজে বাঘ ছাড়া আর কিছুই ছিল না যারা রাজনীতিতে জন্মই নিয়েছে মিথ্যার জন্য, বস্তুগত ভোগের জন্য এবং ব্যক্তি উন্নতি সাধনের একটা সহজ রাস্তার জন্য।

স্বাধীনতার ৫০ বছরের সময় হেফাজতের যেই তাণ্ডব সেটি আর শেষ পর্যন্ত সরকার নিতে পারেনি এবং শেষ পর্যন্ত হেফাজতের এই ঔদ্ধত্যের মাত্রাটা বোধগম্য হয়েছে কিন্তু এটি বলার অপেক্ষাই রাখে না যে, এরই মধ্যে ক্ষতি যা হওয়ার সেটি হয়ে গেছে অনেক।

হেফাজতে ইসলামের নিয়ন্ত্রণাধীন মাদ্রাসা, তাদের ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা আর সেটির উপরেও তাদের ভোটের সংখ্যা হিসেব করলে দেখা যায় ভোটের রাজনীতিতে অত্যন্ত একটি নগণ্য অবস্থায় ছিল এই সংগঠনটি।

অন্ততপক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক আর সাংগঠনিক শক্তিকে যদি বিবেচনায় ধরি, সেক্ষেত্রে হেফাজত ছিল এক রুগ্ন শিশু। কিন্তু জাতীয়তাবাদী দলের আরেকটি সহযোগী সংগঠন হিসেবে এই শিশুটিকে বেড়ে উঠতে না দেওয়ার যে ‘আওয়ামী লীগ পরিকল্পনা’, সেটি আজ আমাদের টেনে এনেছে এই হেফাজতের তাণ্ডবের সামনে।

প্রশ্ন আসতেই পারে, যদি আজকে হেফাজতের এই অবস্থা করতে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাহলে ৮ বছর আগেই নয় কেন? এটি ছিল আওয়ামী লীগের চরম ভুল।

আজকে প্রমাণিত হয়েছে হেফাজত একটা কাগুজে বাঘ ছাড়া আর কিছুই ছিল না যারা রাজনীতিতে জন্মই নিয়েছে মিথ্যার জন্য, বস্তুগত ভোগের জন্য এবং ব্যক্তি উন্নতি সাধনের একটা সহজ রাস্তার জন্য। বলা হয়, ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’ আর সেই প্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন সরকারের এই বোধোদয় দেরিতে হলেও কার্যকরী হয়েছে।

দীর্ঘ সংগ্রাম করে এই দেশটি অর্জিত হয়েছে পাকিস্তানের ধর্ম ব্যবসার নতুন রূপ দেখার জন্য নয় বরং যে সেক্যুলার বাংলাদেশের স্বপ্ন আমাদের পূর্ব-পুরুষরা দেখেছিলেন, সেটিকে সামনে তুলে ধরার জন্য। হেফাজতের এই উত্থান আর এই পতন আমাদের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিতই দেয়। তা হচ্ছে, ‘বাংলাদেশ হেরে যাবে না’।

ব্যারিস্টার নিঝুম মজুমদার ।। আইনজীবী ও গবেষক