অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা কীভাবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়তা করে?
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন আজকের বিশ্বে প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্য শুধু নৈতিক প্রতিশ্রুতি নয় বরং একটি অপরিহার্য উন্নয়ন-নকশা। দারিদ্র্য হ্রাস, বৈষম্য মোকাবিলা, মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, জলবায়ু সহনশীলতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি এসব লক্ষ্য পূরণ করতে হলে যে মূল ভিত্তির ওপর একটি রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হয়, সেটি হলো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা।
রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, দুর্বল প্রতিষ্ঠান, দুর্বল অবকাঠামো এবং অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রাস্ফীতি এসব একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অগ্রগতি থামিয়ে দিতে পারে। তাই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা শুধু অর্থনীতির ভাষায় ‘কেন্দ্রীয় শর্ত’ নয়; এটি টেকসই উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত।
বিজ্ঞাপন
একটি রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির জন্য প্রথম প্রয়োজন একটি রাজনৈতিক স্থিতিশীল ও পূর্বানুমেয় পরিবেশ। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি কমাতে চায়। অরাজকতা, দুর্নীতি, বা আইনের শাসনের অভাব তাদের সিদ্ধান্তকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। তাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সুশাসন একটি রাষ্ট্রের শক্ত অর্থনীতির ভিত্তি। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন এবং দুর্নীতিবিরোধী কার্যকর কাঠামো নিশ্চিত করতে পারে একটি নিরাপদ ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যবসায়িক পরিবেশ।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো মানবসম্পদ উন্নয়ন। দক্ষ, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং শিক্ষিত কর্মশক্তি একটি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত না হলে কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা কমে যায়; মানসম্মত শিক্ষার অভাব দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি তৈরি করে।
বিজ্ঞাপন
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রতি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ অপরিহার্য। এর পাশাপাশি, পদ্মা সেতু থেকে চার লেন সড়ক, বন্দর সম্প্রসারণ থেকে আধুনিক আইসিটি অবকাঠামো, মেট্রোরেল এই সবকিছু প্রমাণ করে কীভাবে শক্তিশালী ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকলে উৎপাদন ব্যাহত হয়, ব্যবসা ব্যয়বহুল হয় এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও নিরুৎসাহিত হয়।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার আরেকটি জরুরি উপাদান হলো সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও বৈষম্য কমানো। যখন উন্নয়নের সুফল সমাজের নির্দিষ্ট অংশে সীমিত হয়ে পড়ে, তখন সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে যায়, সামাজিক অসন্তোষ বাড়ে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার সংকুচিত হয়। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করে, তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে শক্ত ভিত্তি দেয়। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্থিতি আসে।
যেকোনো অর্থনীতির স্থিতিশীলতা মূলত নির্ভর করে এর সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কতটা দক্ষ এবং টেকসই তার ওপর।
প্রথমত, মূল্য স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত ও অস্থির মুদ্রাস্ফীতি শুধু ভোক্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করে না, এটি বিনিয়োগ পরিকল্পনাকে ব্যাহত করে, ব্যবসার ব্যয় বাড়ায় এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিচক্ষণ নীতি সুদের হার নিয়ন্ত্রণ এবং মুদ্রা সরবরাহ ব্যবস্থাপনা এই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার আরেকটি জরুরি উপাদান হলো সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও বৈষম্য কমানো। যখন উন্নয়নের সুফল সমাজের নির্দিষ্ট অংশে সীমিত হয়ে পড়ে, তখন সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে যায়, সামাজিক অসন্তোষ বাড়ে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার সংকুচিত হয়।
দ্বিতীয়ত, প্রয়োজন রাজস্ব শৃঙ্খলা। সরকারের ব্যয় যদি তার রাজস্বের চেয়ে ধারাবাহিকভাবে বেশি হয়, তবে ঋণ বাড়তে থাকে, যা পরবর্তীতে সুদ পরিশোধের চাপ ও রাষ্ট্রীয় ব্যয় সংকোচন তৈরি করতে পারে। এর প্রভাব পড়ে সামাজিক সেবা, অবকাঠামো এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্পে। তাই ব্যয়-রাজস্বের সামঞ্জস্য বজায় রাখা প্রতিটি দেশের জন্য অপরিহার্য।
তৃতীয়ত, প্রয়োজন স্থিতিশীল আর্থিক খাত। ব্যাংকিং খাত দুর্বল হলে ঋণ খেলাপি বাড়ে, গ্রাহকের আমানত ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, আর্থিক সংকট সৃষ্টি হয়। ব্যাংকিং খাতের শক্তিশালী নিয়মকানুন, স্বচ্ছতা, এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি সুদৃঢ় করে।
সবশেষে, একটি শক্তিশালী অর্থনীতির জন্য প্রয়োজন টেকসই কর্মসংস্থান। কর্মসংস্থান শুধু আয়ের উৎস নয়; এটি উৎপাদন, ভোগ এবং বিনিয়োগের একটি চক্র তৈরি করে যা অর্থনীতিকে গতিশীল রাখে। কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়লে দারিদ্র্য কমে, জনসাধারণের জীবনমান উন্নত হয় এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথটি সরল নয়; এটি বহুমাত্রিক ও দীর্ঘমেয়াদি। কিন্তু এক সত্য অস্বীকার করা যায় না অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া এই লক্ষ্যগুলো অর্জন সম্ভব নয়। স্থিতিশীলতা থাকলে উন্নয়ন পরিকল্পনা সহজ হয়, বিনিয়োগ বাড়ে, অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য ঘটে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় এবং দারিদ্র্য কমে।
সমাজে আস্থা বাড়ে, রাজনৈতিক সংকট কমে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। ব্যর্থ উন্নয়ন নীতি কোনো রাষ্ট্রকে সাময়িক প্রবৃদ্ধি দিতে পারে, কিন্তু টেকসই উন্নয়ন চাইলে দরকার একটি সুসংহত, স্থিতিশীল, ন্যায়ভিত্তিক এবং শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো।
বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা সাধারণত ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করেন এবং তাদের সিদ্ধান্ত অনেকাংশে নির্ভর করে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের মানের ওপর। যখন কোনো দেশে অরাজকতা, দুর্নীতি, বা আইনের শাসনের অভাব দেখা দেয়, তখন বিনিয়োগকারীরা সেই দেশের বাজারে প্রবেশে হেলাফেলা করেন, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই একটি শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন অপরিহার্য।
স্বাধীন ও স্বচ্ছ বিচারব্যবস্থা, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন, দুর্নীতিবিরোধী কার্যকর কাঠামো এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করলে ব্যবসায়িক পরিবেশ নিরাপদ ও বিশ্বাসযোগ্য হয়। এটি স্থানীয় উদ্যোক্তা ও বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করে এবং নতুন ব্যবসায়িক কার্যক্রম, বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সুশাসন কেবল প্রশাসনিক প্রয়োজন নয় বরং একটি শক্তিশালী, স্থিতিশীল এবং প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির মূল ভিত্তি। এটি রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের জন্য অপরিহার্য, যা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা কোনো দেশ একা অর্জন করতে পারে না; এটি একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং বিভিন্ন স্তরের প্রস্তুতির ফল। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বা প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাপ্যতা যথেষ্ট নয়। একটি দেশকে প্রয়োজন সুসংগঠিত অর্থনৈতিক কাঠামো, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ এবং কার্যকর সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তাই কেবল উন্নয়নের একটি অংশ নয়, বরং এটি সমগ্র উন্নয়ন কাঠামোর ভিত্তি ও প্রধান চালিকাশক্তি।
টেকসই উন্নয়ন তাই শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি সামাজিক ন্যায় ও নৈতিক দায়িত্বেরও একটি প্রতিফলন, যা দেশের স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক মর্যাদাকে শক্তিশালী করে...
যে রাষ্ট্রগুলো এ সত্যটি উপলব্ধি করে, তারা তাদের নীতি ও পরিকল্পনায় দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টি বজায় রাখে, যা তাদের উন্নয়নকে টেকসই ও স্থায়ী করে তোলে। অপরদিকে যারা আর্থিক স্থিতিশীলতাকে উপেক্ষা করে, তারা প্রায়ই অপ্রত্যাশিত সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক বৈষম্যের কারণে অগ্রগতি হারায়। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রকে প্রয়োজন কার্যকর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, ন্যায়সংগত বিতরণ এবং সামাজিক অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি, উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
তাই টেকসই উন্নয়নের মূল লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রথম ধাপ হওয়া উচিত একটি স্থিতিশীল, সমতাভিত্তিক, ন্যায়সংগত এবং শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে তোলা। শুধুমাত্র এই ভিত্তির উপর নির্ভর করে সমাজের সব স্তর সমানভাবে উন্নতির সুফল পেতে পারে এবং দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি দীর্ঘমেয়াদে নিশ্চিত হয়। টেকসই উন্নয়ন তাই শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি সামাজিক ন্যায় ও নৈতিক দায়িত্বেরও একটি প্রতিফলন, যা দেশের স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক মর্যাদাকে শক্তিশালী করে।
বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বিনিয়োগ আকর্ষণ, সামাজিক সুসমন্বয় এবং নীতি প্রণয়নের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে। একই সঙ্গে সুসংগঠিত অর্থনৈতিক কাঠামো জাতীয় সম্পদের কার্যকর ব্যবহার, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান দেশকে দুর্নীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং নীতি বাস্তবায়নে ব্যর্থতার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ নিশ্চিত করে যে উন্নয়নের সুফল দেশের সব স্তরে পৌঁছায় এবং সামাজিক বৈষম্য হ্রাস পায়। কার্যকর সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি যেমন সঠিক করনীতি, বৃত্তিমূলক বিনিয়োগ নীতি এবং দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামোগত পরিকল্পনা, জাতীয় অর্থনীতিকে টেকসইভাবে বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।
তাই টেকসই উন্নয়নের মূল ভিত্তি হলো একটি স্থিতিশীল, সমতাভিত্তিক, ন্যায়সংগত এবং শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তোলা, যা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে সমন্বিতভাবে কাজ করে। এই ভিত্তি তৈরি হলে বাংলাদেশ শুধুমাত্র আর্থিক স্বনির্ভরতা অর্জন করবে না, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি স্থিতিশীল ও দৃষ্টান্তমূলক রাষ্ট্র হিসেবে নিজ অবস্থান দৃঢ় করতে পারবে। এমনভাবে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করলে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণ সম্ভব।
ড. সুজিত কুমার দত্ত : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
datta.ir@cu.ac.bd