“আমি কখনো ব্যক্তিগত আক্রমণ করে কথা বলিনি”—২০০০ সালে বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে সংবাদমাধ্যমে দেওয়া বেগম খালেদা জিয়ার এই এক বাক্য আজ, তার মৃত্যুর পর, নতুন করে গভীর তাৎপর্য নিয়ে সামনে এসেছে। এই একটি বাক্যই যেন তার পুরো রাজনৈতিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। এই উচ্চারণেই সংক্ষেপে ধরা আছে তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ভাষা, আচরণ ও নৈতিক অবস্থান।

বেগম খালেদা জিয়া আজ আর নেই। কিন্তু তার অনুপস্থিতি আমাদের সামনে কেবল একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নয়, বরং একটি মৌলিক প্রশ্নও রেখে গেছে—বাংলাদেশের রাজনীতি কোন ভাষায় কথা বলবে, কোন সংস্কৃতিকে ধারণ করবে? প্রতিহিংসা ও ব্যক্তিগত আক্রমণের ভাষায়, না শালীনতা ও সংযমের নীতিতে?

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বেগম খালেদা জিয়া কখনোই তার প্রতিপক্ষকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করার পথে হাঁটেননি। মতবিরোধ ছিল, সংঘাত ছিল, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল— কিন্তু সেগুলো কখনো ব্যক্তিগত অবমাননা, কটূক্তি বা নোংরা বক্তব্যে রূপ নেয়নি। তিনি রাজনৈতিক বিরোধকে দেখেছেন আদর্শ, নীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার প্রশ্ন হিসেবে; ব্যক্তিগত চরিত্রহননের হাতিয়ার হিসেবে নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়— বরং বিরল।

বিশেষ করে গত দেড় দশকে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলে রাজনীতির ভাষা ক্রমে কঠোর থেকে কটু, কটু থেকে অশালীন ও হিংস্র হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত আক্রমণ, বিদ্রূপ, অপমান ও ঘৃণার ভাষা রাজনৈতিক বক্তব্যের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থান ছিল শুধু ব্যতিক্রমী নয়—সচেতনভাবে ভিন্ন এবং নৈতিকভাবে উচ্চতর।

শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘতম ও সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায়গুলোর একটি। কিন্তু এই দ্বন্দ্বের ভাষা ও আচরণে দুই নেত্রীর মধ্যে ছিল মৌলিক পার্থক্য। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বক্তব্যে ব্যক্তিগত আক্রমণ, কটূক্তি ও বিদ্রূপ রাজনীতিকে বিষাক্ত করেছে। বিপরীতে বেগম খালেদা জিয়া তার বক্তব্যে রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, নির্বাচন ও মানুষের অধিকারের প্রশ্নকেই সামনে রেখেছেন। ব্যক্তিগত আক্রমণকে তিনি সচেতনভাবেই পরিহার করেছেন। এই বৈশিষ্ট্য তাকে আলাদা করেছে, অনন্য করেছে—এবং কোটি কোটি বাংলাদেশিকে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থায় আবদ্ধ করেছে।

গত ১৫ বছরের শাসনামলে বিরোধী রাজনীতিকে কার্যত অপরাধে পরিণত করা হয়েছিল। মামলা, গ্রেপ্তার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ভোটাধিকার হরণ— সব মিলিয়ে দেশ এক দীর্ঘ দমন–নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপি। তাকে কারাবন্দী করা হয়েছে, গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে, একের পর এক মামলা ও কারাদণ্ড দিয়ে রাজনৈতিকভাবে নিশ্চুপ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

কিন্তু তার ভাষা প্রতিহিংসাপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। তিনি দমন-পীড়নের কথা বলেছেন, গণতন্ত্রহীনতার সমালোচনা করেছেন, ভোটাধিকার হরণের প্রশ্ন তুলেছেন— কিন্তু কখনো ব্যক্তিগত কুৎসা বা অশ্লীল আক্রমণে নামেননি। আঘাতের জবাব দিয়েছেন ধৈর্যে, অপমানের জবাব দিয়েছেন নীরব কিন্তু অনমনীয় দৃঢ়তায়। এখানেই তার রাজনৈতিক চরিত্রের প্রকৃত শক্তি।

বেগম খালেদা জিয়া বুঝতেন— ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়; কিন্তু ভাষা ও আচরণ ইতিহাসে থেকে যায় এবং সমাজকে প্রভাবিত করে। রাজনীতির উত্তাল মুহূর্তেও তিনি একটি নৈতিক সীমারেখা অতিক্রম করেননি। আজকের বাংলাদেশে, যেখানে রাজনীতি মানেই গালাগাল, কটূক্তি ও ব্যক্তিগত আক্রমণ— সেখানে এই অবস্থান প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিন্তু তিনি সেটিই করে দেখিয়েছেন।

গৃহবধূ থেকে দেশের শীর্ষ গণতান্ত্রিক নেত্রী হয়ে ওঠার পথটি ছিল কঠিন সংগ্রামে ভরা। কোনো রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ছাড়া, সেনাশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি নিজেকে আপসহীন নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ক্ষমতায় থাকাকালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন, আর ক্ষমতার বাইরে থাকাকালে হয়েছেন দেশের সবচেয়ে নির্যাতিত বিরোধী নেত্রী। কিন্তু দুই অবস্থাতেই তার আচরণে ছিল মার্জিত দৃঢ়তা।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে শালীনতাকে প্রায়ই দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া দেখিয়ে গেছেন—শালীনতা দুর্বলতা নয়; এটি শক্তিরই একটি রূপ। এটি আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ এবং ভবিষ্যতের প্রতি দায়বদ্ধতা। তিনি প্রমাণ করেছেন, কণ্ঠে দৃঢ়তা রেখেও কথায় সংযত থাকা যায়; সংগ্রামে আপসহীন থেকেও ভাষায় ভদ্র থাকা সম্ভব।

খালেদা জিয়ার দীর্ঘ ৪৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তিনি নানা সময়ে সরকার ও বিরোধী দলে থেকেছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে রাজনৈতিক কারণে বহু সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা বিতর্ক ও সমালোচনার জন্ম দেয়। সব রাজনৈতিক নেতার মতো তিনিও এর ঊর্ধ্বে ছিলেন না। কিন্তু রাজনীতির ভাষা ও আচরণে তিনি যে মানদণ্ড স্থাপন করেছেন, তা আজকের বাংলাদেশে বিরল—এবং তাই আরও মূল্যবান।

শেষ বয়সে এসে তিনি শুধু একজন বিরোধী নেত্রী নন, হয়ে উঠেছিলেন জাতির ঐক্যের প্রতীক। তার মৃত্যু আমাদের সামনে আবারও সেই প্রশ্নটি হাজির করেছে—আমরা কোন রাজনীতিকে উত্তরাধিকার হিসেবে নিতে চাই? এমন রাজনীতি, যেখানে ভিন্নমত মানেই শত্রু, আর ভাষা মানেই আক্রমণ? নাকি এমন রাজনীতি, যেখানে দৃঢ়তা থাকবে, কিন্তু শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করা হবে না?

বেগম খালেদা জিয়া তার জীবদ্দশায় এই প্রশ্নের একটি স্পষ্ট উত্তর দিয়ে গেছেন। তার মৃত্যু সেই উত্তরের দায় আমাদের ওপরই রেখে গেল।

লেখক: এস এম রাশিদুল ইসলাম
সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ইআরএফ